ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো উন্নয়ন প্রক্রিয়া ও জনজীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে, তেমনি মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
ভারতের বিহার রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার বিগত ২০১৭ খ্রি. ২৩ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করে বিতর্কিত ফারাক্কা বাঁধকে পুরোপুরি সরিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ফারাক্কা বাঁধের জেরে গঙ্গাতে যে বিপুল পরিমাণ পলি পড়েছে তার জন্য প্রতিবছর বিহারকে বন্যায় ভূগতে হচ্ছে এবং এর একটা স্থায়ী সমাধান হলো ফারাক্কা বাঁধটাই তুলে দেয়া। ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের নানা আপত্তি আছে দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু ভারতের একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও মূখ্যমন্ত্রী এই প্রথম ফারাক্কা বাঁধ একেবারে প্রত্যাহারের দাবী তোলেন।
ভারতের ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির ওপর বিরাট প্রভাব পড়ছে। ফারাক্কা বাঁধের ফলে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বন্ধ হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ ন্যায্য পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, পলি জমে নদী তল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানির চাপ সহ্য করতে পারছেনা নদী। ফলে প্রায়ই দেখা দিচ্ছে বন্যা। তেমনি শীত মৌসুমে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশ মারাত্মক পানিশূণ্যতার সম্মুখীন হচ্ছে, যা ক্ষুদ্র দেশটির সার্বিক জীবনযাত্রা ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া মারাত্মক ভাবে ব্যাহত করছে। শুকনো মৌসুমে হ্রাসকৃত পানি প্রবাহের ফলে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকার কৃষিক্ষেত্র মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। বিশেষ করে হার্ডিঞ্জ সেতুর কাছে পানি প্রবাহ সর্বকালের সর্বনিম্ন ১৪ ফুটের নিচে নেমে আসায় জমির ফসল বিনষ্ট হচ্ছে এবং এর ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা বলে জানা যায়। এছাড়া সেচের পানির অভাব, জমির আর্দ্রতা হ্রাস ও জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে দেশের গঙ্গাবাহিত ৫০ লক্ষ একর জমি মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় ১৯৭৬ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত শুধুমাত্র কৃষিক্ষেত্রেই বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বছরে ৫০০ কোটি টাকারও অধিক। আর প্রাকৃতিক ও নীতিসম্মত এ প্রবাহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ২৩০০ কোটি টাকার মত ক্ষতি হচ্ছে। এতেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ফারাক্কা কত ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে।
ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে পরিবেশগত বিপর্যয়ের শিকারে পরিণত হয়েছে। হুগলী নদীর উজান স্রােতে একদিকে যেমন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশের কারণে সুন্দরবন অঞ্চলের বিরাট অংশ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, অন্যদিকে এ বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে বাংলাদেশের একমাত্র ‘ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল’ সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সেখানকার প্রধান অর্থকারী গাছ সুন্দরী ধ্বংসের মুখোমুখি। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ধারণা সুন্দরবনের ৬০ শতাংশ বনজ সম্পদের এ মূল্যবান বৃক্ষের সঙ্গে গেওয়া, কেওড়া ইত্যাদি গাছ উল্লেখযোগ্য হারে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এতে পরিবেশের এক বিরাট ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। অতিমাত্রায় লবণাক্ত পানি মৎস্য সম্পদ ও উপকূলবর্তী কৃষি সম্পদেরও মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে চলেছে। বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, ফরিদপুর ও রাজশাহী জেলার জলবায়ু ক্রমাগত মরুময়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। হ্রাসকৃত পানি প্রবাহের ফলে নদী ভরাট হয়ে যাওয়া, গতি পরিবর্তিত হওয়া, উজানে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ ইত্যাদি কারণে মৎস্য সম্পদ দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। সত্তর দশকে যেখানে খোলাপানির মাছের পরিমাণ ছিল ২৭৮ হাজার মেট্রিক টন সেখানে ১৯৯১-৯২ সালে তা মাত্র ১৮৫ হাজার মেট্রিক টনে নেমে এসেছে। বর্তমানে টাকার অংকে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। ফারাক্কা সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান না হলে ভবিষ্যতে মৎস্য সম্পদের ওপর আরো নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশংকা রয়েছে। ফারাক্কা প্রভাবিত বন্যার ফলে কোটি কোটি টাকার সম্পদ এবং জানমালের ক্ষতি হচ্ছে। বন্যা সমস্যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলে চলেছে।
আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে গঙ্গা নদীর ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেকটি তীরবর্তী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে আন্তর্জাতিক নদীকে এমনভাবে ব্যবহার করা যাতে অন্যান্য তীরবর্তী রাষ্ট্রের সহজাত অধিকার ও স্বার্থের ক্ষতি না হয়। আন্তর্জাতিক নদীর যথেচ্ছ ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত নয়। ১৯৬৬ সালের Helsinki Rules এর নীতিতে বলা হয় যে, আন্তর্জাতিক নদী কোন দেশ যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারবেনা। ১৯৩৩ সালের মন্টিভিডিও ঘোষণা, ১৯১১ সালের মাদ্রিদ ঘোষণা ও ১৯৬১ সালের সলস্ বার্গে ঘোষণায় উক্ত নীতির প্রতিফলন ঘটে। ১৯৫৯ সালে মিশর ও সুদানের মধ্যে নীলনদ চুক্তি, ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধুনদী চুক্তি, ১৯৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে কলম্বিয়া নদী চুক্তিসমূহ আন্তর্জাতিক নদীর উপর স্ব স্ব তীরবর্তী দেশের সমান অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক নদীর উপর কোন প্রকল্প নির্মাণের পূর্বে বিশেষ করে যদি সেই প্রকল্পের প্রতিক্রিয়া অন্য দেশে বিরূপ প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে তবে সেই নির্মাণকারী রাষ্ট্র অপর তীরবর্তী রাষ্ট্রসমূহকে সেই প্রকল্প সম্পর্কে “অগ্রিম অবহিত” (Prior Notice) করতে হবে।
দেখা যাচ্ছে, গঙ্গা নদীর উপর ভারত যে বাঁধ নির্মাণ করেছে তা আন্তর্জাতিক রীতিবিরুদ্ধ । আন্তর্জাতিক আইনের এটি সুস্পষ্ট লংঘন। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গাকে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক পানি প্রবাহের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। ভারত নিজ দায়িত্বে ফারাক্কা বাঁধ সম্পর্কে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারকে অবহিত করেনি। ১৯৬০ সাল থেকে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলাকালে ভারত ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রাখে এবং পরবর্তী সময়ে সমঝোতা ব্যতিরেকে গঙ্গার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে চলেছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, ফারাক্কা সমস্যা ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ক্ষতিকর ফেলছে। এ সমস্যা বাংলাদেশের জীবন মরণ সমস্যা হিসাবে পরিগণিত। ১৯৬০ সালে ভারত সিন্ধু নদীর সমঝোতা সংক্রান্ত বিষয়ে পাকিস্তানের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। কিন্তু গঙ্গা নদীর ব্যাপারে ভারত শীতল ও দ্বৈতনীতি গ্রহণ করে। বাংলাদেশের সার্বিক স্বার্থে ফারাক্কা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান ও প্রতিবেশী ভারতের সাথে স্বাভাবিক ও সুস্থ সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কুটনৈতিক প্রচেষ্টাকে আরো জোরদার করা উচিত।
লেখক: সাহিত্যিক, কলামিস্ট, গবেষক, ইতিহাসবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন