বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

হাওরের কৃষকদের ফসল রক্ষার লড়াই

| প্রকাশের সময় : ৯ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০৯ এএম

প্রায় প্রতি বছরই অসময়ে পাহাড়ি ঢলে হাওরাঞ্চলের ফসলাদি ডুবে যায়। এটা অনেকটা সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বিস্তৃত হাওরাঞ্চলে সরকার ফসলাদি রক্ষার জন্য বিভিন্ন বাঁধ নির্মাণ করেছে। শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এসব বাঁধ পাহাড়ি ঢলও সামলাতে পারছে না, ফসলও রক্ষা করতে পারছে না। ঢলের তোড়ে বাঁধ ভেঙ্গে ফসলি জমি তলিয়ে যাচ্ছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জের বেশ কয়েকটি হাওর তলিয়ে গেছে। এতে হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। কৃষকরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ নিরুপায় হয়ে আধাপাকা ধান কেটে কোনো রকমে ঘরে তুলছে। এ ধান দিয়ে যে তেমন কোনো লাভ হবে না, তা জানা সত্ত্বেও প্রাণের টানে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে আধাপাকা ধানই তারা কেটে তুলছে। ফসল রক্ষা ও বাঁধ ভাঙনের কবল থেকে সুরক্ষার জন্য কৃষকদের অবিরাম চেষ্টার কোনো কমতি নেই।তারা স্বেচ্ছায় বাঁধ রক্ষার কাজ করছে। স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডও কাজ করছে। ফসল রক্ষার এ লড়াইয়ে তাদের জিততেই হবে। না জিতলে জীবন সংসারে বিপর্যয় অবধারিত। অনেক কৃষক আছে যারা ধারদেনা করে ফসল ফলিয়েছে। সময়মতো ফসল উঠলে তা পরিশোধ করে নিজেরাও জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। তাদের সে আশায় গুড়ে বালি পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

দেশে উৎপাদিত বোরো ধানের শতকরা ৪৫ ভাগের জোগান আসে হাওরাঞ্চল থেকে। এ প্রেক্ষিতে, হাওরাঞ্চলকে অন্যতম খাদ্যভাণ্ডার বলা হয়। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রেও এ অঞ্চলের ভূমিকা ব্যাপক। সাধারণ মানুষের সিংহভাগই এ অঞ্চলের বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীল। এসব অঞ্চল মূলত একফসলী। ফলে সারা বছরের খাদ্য উৎপাদনে কৃষকরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। ফসলও ভাল ফলে। নিজেদের চাহিদা পূরণ করে অতিরিক্ত ধান বিক্রি করে লাভাবান হয়। তাদের বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় অসময়ের পাহাড়ি ঢল। পাহাড় থেকে তীব্র বেগে নেমে আসা এ ঢল সামলানো অত্যন্ত কঠিন। এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে হাওরাঞ্চল রক্ষার্থে বিভিন্ন বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ বহু আগে থেকেই নেয়া হয়েছে। এজন্য বছরে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। বাঁধও নির্মিত হয়। তবে সেগুলো টেকসই হয় না। এমন বাঁধ নির্মাণ করা হয় যে, পাহাড়ি ঢলের চাপে তা ভেঙ্গে যায়। এর সাথে কৃষকের ফসল যেমন তলিয়ে যায়, তেমনি কোটি কোটি টাকায় নির্মিত বাঁধও ভেসে যায়। বাঁধ নির্মাণ ও ভেঙ্গে যাওয়া নিত্যকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কোনো স্থায়ী প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে শুরু করে বিভিন্ন অঞ্চলের বাঁধ বছরের পর বছর ধরে এক ধরনের ভাঙ্গা-গড়ার খেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এতে সরকারের শত শত কোটি টাকা প্রতি বছর ব্যয় হচ্ছে। বাঁধের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এমন অনেক বাঁধ রয়েছে, বছরের পর বছর ধরে রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার করা হয় না। অথচ একটি বাঁধ নির্মাণ করলে তার স্থায়িত্বের জন্য নিয়মিত তদারকি প্রয়োজন। এ কাজটির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট গাফিলতি পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। যেসব বাঁধ নির্মিত হয়, তাতে নির্মাণজনিত ত্রুটি থাকার অভিযোগ বহু আগে থেকেই রয়েছে। নিম্নমানের সামগ্রী ও দুর্বলভাবে নির্মাণের ফলে সেগুলো টেকসই হয় না। বন্যা বা ঢলে নিমেষেই ভেঙ্গে যায়। এসব নিম্নমানের বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে একশ্রেণীর ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসৎ কর্মকর্তার মধ্যে যোগসাজস থাকে। বরাদ্দকৃত অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় এবং বাঁধ নির্মাণ না করে দুর্নীতির মাধ্যমে লোপাট করে দেয়া হয়। এতে নামকাওয়াস্তে বাঁধ নির্মিত হয় এবং তা সহজে পানির তোড়ে ভেসে যায়। অন্যদিকে যেসব বাঁধ নির্মিত হয়েছে, সেগুলো যথাসময়ে তদারকি ও দেখভাল করা হয় না। এতে নির্মিত বাঁধ দুর্বল হয়ে প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। হাওরে বাঁধ ভেঙ্গে ফসলের যে বিপুল ক্ষতি হয়, তা এই দুর্বল বাঁধের কারণেই হয়। এসব বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে যারা রয়েছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

উজানের দেশ হওয়ায় আমাদের এখানে বন্যা ও পাহাড়ি ঢল হওয়া অনিবার্য বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। এ অনুযায়ী, তা মোকাবেলার প্রস্তুতিও আমাদের থাকতে হবে। বিশেষ করে বন্যাপ্রবণ এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণ ও তা রক্ষণাবেক্ষণ করা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। সামনে বর্ষা মৌসুম। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বন্যা হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। গত বছরও দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে ব্যাপক বন্যা দেখা দিয়েছিল। এতে ঘর-বাড়ি, কৃষিজমি ও ফসলাদি তলিয়ে গিয়েছিল। বন্যা নিয়ন্ত্রণের যেসব বাঁধ ছিল তা ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভেসে গিয়েছিল। সে সময় বাঁধের নির্মাণজনিত ত্রুটি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবকে স্থানীয়রা দায়ী করেছিল। সামনে যে বন্যা হবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। কাজেই বন্যা সম্পর্কে সতর্ক হওয়া উচিৎ। যেসব বাঁধ রয়েছে, সেগুলোর মেরামত, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ এখন থেকেই শুরু করতে হবে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের বাঁধগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্ব দিতে হবে। ফসলের ভাণ্ডারখ্যাত এ অঞ্চলের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা আমাদের খাদ্যনিরাপত্তাকেও ব্যাহত করবে। ইতোমধ্যে যেসব কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
Robiul Islam Sagor ৯ এপ্রিল, ২০২২, ১১:১৭ এএম says : 0
সুনামগঞ্জ জেলার ১২ উপজেলার হাওরপাড়ের মানুষ আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠায় দিন পার করছে। পাহাড়ি ঢলের পানি থেকে ফসল বাঁচাতে হাওর এলাকার কৃষক প্রাণপণ চেষ্টা করছে। জেলাটি হাওর অধ্যুষিত হওয়ায় এখানে বছরে একটি মাত্র ফসল ফলে। আর এই ফসল ফলাতে হাওরপাড়ের মানুষকে কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়।
Total Reply(0)
Masud Rana ৯ এপ্রিল, ২০২২, ১১:১৮ এএম says : 0
মানুষ চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে। প্রশাসন, পাউবো বিপদে পড়লেই তখন মানুষকে ডাকে। বাঁধের নির্মাণকাজ শুরুর সময় যদি মানুষকে ডাকা হতো, পরামর্শ নেওয়া হতো, তাহলে এই সমস্যায় পড়তে হতো না।
Total Reply(0)
Imran Mahmud ৯ এপ্রিল, ২০২২, ১১:১৮ এএম says : 0
মূল সমস্যা, বাঁধের কাজে কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নেই। যত দিন কাজে দুর্নীতি–অনিয়ম বন্ধ না হবে, তত দিন হাওরে সমস্যা থাকবেই।
Total Reply(0)
Kingdom Kingdom ৯ এপ্রিল, ২০২২, ১১:১৯ এএম says : 0
গোরাডুবা হাওরে ১৩৬. বাঁধটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বাঁধের নীচ দিয়ে পানি চুয়ে চুয়ে হাওরের ভেতর ঢুকছে। ফলে যে কোন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
Total Reply(0)
MD AZGOR ALI ৯ এপ্রিল, ২০২২, ১১:২০ এএম says : 0
এবার হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের প্রকল্প কাজ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। তদারকিতেও যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। তাই এগুলো এখন হাওরের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।অ
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন