সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওরের মাউতি বাঁধে গতকাল দুপুরে বাঁধ ভেঙে ঢলের পানি ঢুকছে। উজানের এই ঢলে ডুবছে কৃষকের স্বপ্ন। গতকাল ভোরে শাল্লা উপজেলার ছায়া হাওরের ৮১ নম্বর পিআইসি মাউতির বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকতে শুরু করে। এই হাওরে সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার ৪ হাজার ৬৩৭ হেক্টরসহ কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলার বোরো জমিও রয়েছে। এ ছাড়া পানির চাপে বাঁধগুলো দুর্বল হচ্ছে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে অন্য বাঁধগুলোও। এ অবস্থায় কৃষকরা আধা পাকা ধান কাটতে বাধ্য হচ্ছে। কৃষকরা জানান, এখনো অর্ধেক জমির ধান কাটা বাকি রয়েছে। তবে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তালেব বলছেন, ৯৫ ভাগ ধান কাটা এরইমধ্যে শেষ হয়েছে।
কৃষকরা জানিয়েছেন, হঠাৎ করে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় সুনামগঞ্জের শাল্লা ও দিরাই উপজেলা, নেত্রকোণার খালিয়াজুরি ও কিশোগঞ্জের ইটনা উপজেলার হাজারও কৃষকের ফসল পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। শাল্লা উপজেলার ঘুঙ্গিয়ার গ্রামের কৃষক সুবির সরকার পান্না ও শেকুল মিয়া জানান, ৫০ ভাগ জমির পাকা ধান কেটেছেন। তবে ধান ও খড় হাওরেই রয়ে গেছে। কাটা ধানও আনতে পারবে না। হয়তো জমির ধান ও খড় জমিতেই থাকবে।
শাল্লার বাহাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টু বললেন, ছায়ার হাওরের অর্ধেক জমির ধান কাটা হয়েছে। হঠাৎ করে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় হাওরের কৃষকদের অর্ধেক জমির ধান পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। তবে শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তালেব দাবি করেন, হাওরের ৯০ ভাগ ফসল কাটা শেষ। গত শনিবার রাত ১১টায় কালবৈশাখী ঝড় হয়েছে। রাতের ওই সময় তদারকিতে কেউ না থাকায় বাঁধটি ভেঙে গেছে।
এদিকে সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানান, ‘ছায়ার হাওরে ৪ হাজার ৬০০ হেক্টর জমি রয়েছে। এর মধ্যে গত শনিবার পর্যন্ত প্রায় ৯৫ ভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে। বাকিটুকু ফসল হাওর তলিয়ে যাওয়ার আগেই কৃষকরা কাটার চেষ্টা করছেন। আমাদের আশা কৃষকরা ফসল কেটে তুলতে পারবেন।
শাল্লা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টু বলেন, এই হাওরে সবচেয়ে বেশি জমি শাল্লা উপজেলার। কিছু জমি কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন ও কিছু জমি নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষকদের। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক ধান কাটা হয়েছে। বাকি অর্ধেক ধান কাটা বাকি আছে। এ অবস্থায় হাওর তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
স্থানীয়রা জানান, গতকাল ভোরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পিআইসি নির্মিত বাঁধটিতে ফাটল দেখা দেয়। পরে বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি প্রবেশ করতে থাকে। বাঁধ ভাঙার এ দৃশ্য দেখে হাজারো কৃষক তাদের অবশিষ্ট জমির ধান কাটতে হাওরে নামেন।
কৃষকরা জানান, অকৃষক কৃপেন্দ্র দাসকে সভাপতি করে ২২ লাখ টাকার এই প্রকল্প দেওয়া হয়। পিআইসি সভাপতি কৃপেন্দ্র সিলেটে অবস্থান করেন। তিনি কৃষকও নন। তাই বাঁধের কাজে নানা দুর্বলতা ছিল। এই দুর্বলতার কারণেই বাঁধ ভেঙে হাওরের কাটার বাকি অবশিষ্ট জমির ধান তলিয়ে যাচ্ছে বলে জানান তারা।
শাল্লার ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক তরুণ কান্তি দাস জানায়, বাঁধে তদারকি কম ছিল। এ হাওরে সুনামগঞ্জের শাল্লা ও দিরাই, কিশোরগঞ্জের ইটনা এবং নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার মানুষের ফসল রয়েছে। বাঁধ ভাঙায় জমির ৫০ শতাংশ ফসলের ক্ষতি হবে। এর মধ্যে হাওরে কেটে রাখা ধানও আছে।
তিনি আরো জানান, আফসোস হচ্ছে, নদীর পানি কমেছে। পরিস্থিতি যখন উন্নতির দিকে, তখন বাঁধটি ভাঙল। এ হাওরের ঝুঁকিপূর্ন যেসব স্থান ছিল, সেদিকে বাঁধ ভাঙেনি। যেখানে ভেঙেছে, সেখানকার পিআইসির উদাসীনতার কারণেই কৃষকের ক্ষতি হলো। গতকাল ভোরে যখন বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকতে শুরু হয়, তখনও চিৎকার দিলে মাইকে প্রচার দিলে বাঁধ ঠেকানো যেত।
তার মতে, হাওরের ৩০ ভাগ ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে কৃষকের ৫০ ভাগ ক্ষতি হবে। কারণ তারা ধান কেটে ক্ষেতেই রেখেছিলেন। এই ধান তুলে আনার সময় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে হাজারো কৃষককে। দুই দিনে হাওরে গলাসমান পানি হবে। এরপর অসহায় হয়ে যাবেন তারা।
এর আগে গত ২১ এপ্রিল সুনামগঞ্জের দিরাই ও জগন্নাথপুরের দুটি বাঁধ উপচে হাওরে পানি ঢুকেছে। এর মধ্যে রয়েছে জেলার দিরাইয়ের অন্যতম বৃহৎ হাওর বরাম। হাওরপাড়ের চিপুর-খেজাউড়ার মাঝামাঝি অংশ দিয়ে কালনী নদীর পাড় উপচে পানি ঢুকে পড়ে। এই হাওরে প্রায় চার হাজার হেক্টর জমি চাষ হয়।
এদিকে জগন্নাথপুর, ছাতক ও শান্তিগঞ্জের মাঝামাঝি এলাকার ছোট হাওর দাড়াখাইয়ে পানি ঢুকেছে। হাওরের পাশের কুচিয়ার খাল উপচে পানি ঢুকছে। স্থানীয়ভাবে এই হাওরকে পাঠার হাওর বলা হয়। এই হাওরের বেশিরভাগ ধানই কাটা হয়নি।
নদীর পানি ধীরে কমায় অসময়ে নির্মিত হাওররক্ষা বাঁধের বেশিরভাগেই হয় ধস, না হয় চুঁইয়ে হাওরে পানি ঢোকায় বাঁধ নিয়ে উৎকণ্ঠা কমছে না। জমির পাকা ধান কম সময়ে কেটে গোলায় নিতে হচ্ছে, আবহাওয়া মেঘাচ্ছন্ন থাকায় ধান শুকাতেও বিলম্ব হচ্ছে। এ অবস্থায় বাঁধের কাজে যাওয়া তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে।
গত ২১ এপ্রিল সুনামগঞ্জের হাওর পরিদর্শনে গিয়ে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেন, হাওরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, আগাম বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নৌযান চলাচলের সুবিধার্থে সুনামগঞ্জে দুটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। বছরের শেষের দিকে নদী খনন ও কজওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হতে পারে। এখন সমীক্ষার কাজ চলছে।
মন্ত্রী বলেন, সুনামগঞ্জের মানুষের জন্য আমরা একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। আমরা আশা করছি আগামী নভেম্বর- ডিসেম্বরের দিকে কাজ শুরু করতে পারব। ১ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪টি নদী ও এর সঙ্গে যত সংযোগ খাল রয়েছে তা খননের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যার সমীক্ষার কাজ চলছে। সমীক্ষার রিপোর্ট আমরা সেপ্টেম্বরের ভেতরে পাব। এরপর একনেকে তুলে প্রকল্পটা পাস করাব।
এদিকে সুনামগঞ্জে প্রথম দফা পাহাড়ি ঢল আসে গত ৩০ মার্চ। এতে জেলার নদ-নদী ও হাওরে ব্যাপক পরিমাণে পানি বৃদ্ধি পায়। ঝুঁকিতে পড়ে জেলার সব হাওরের বোরো ধান। হাওরের বাঁধ রক্ষায় ২২ দিন ধরে কৃষকদের নিয়ে দিনরাত কাজ করছেন প্রশাসন, পাউবো কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও প্রকল্প বাস্তাবায়নের কমিটির (পিআইসি) লোকজন। কৃষি বিভাগের হিসাবমতে, এ পর্যন্ত বাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে ঢলের পানি ঢুকে ১৯টি ছোট বড় হাওর ও বিলের প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তবে স্থানীয় কৃষকেরা বলছেন, ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন