সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য যিনি সমগ্র জাহানের প্রতিপালক। সকল প্রশংসা ও সকল ইবাদত-আরাধনা একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য এবং কথা , কর্ম ও আচরণগত সকল আদবই তাঁর দরবারের ক্ষেত্রেই যথোপযুক্ত, শোভনীয়। এর দ’ুটি মৌলিক কারণ রয়েছে:
০১। মহান আল্লাহ নিজ সত্তা ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে এক ও একক । তারঁ কোন শরীক নেই। মানব ইতিহাস এ বিষয়ে সাক্ষী, যে-পরিমাণ এ জগতে আল্লাহ তা‘আলাকে আরাধ্য করা হয়েছে, যে-পরিমাণ তাঁকে প্রেম-ভালোবাসা নিবেদন করা হয়েছে, যে-পরিমাণ তাঁকে স্মরণ করা হয়েছে, যে-পরিমণ তাঁকে ডাকা হয়েছে, যে-পরিমাণ তাঁর উদ্দেশ্যে প্রাণ ও সম্পদ উৎসর্গ করা হয়েছে এবং যে-পরিমাণ তাঁর সামনে নির্জনে আহাজারী করা হয়েছে-তাঁর সমান্তরালে তেমন আর কারও অস্তিত্ব খুঁজে পওয়া যায়নি। সুতরাং সকল সম্মান- মর্যাদা ও মহত্ব-বড়ত্বের শীর্ষ অবস্থান এবং প্রেমাবেগ-আকর্ষণ, ইচ্ছা-আকাঙ্খা, উপাসনা-আরাধনার সর্বশেষ ঠিকানা হচ্ছেন মহান আল্লাহ রাব্বুল-আলামীন। যে-কারণে মানুষকে প্রতিটি বাক্য ও কর্মের ক্ষেত্রে তাঁর ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদব-সম্মান বজায় রাখতে হবে।
০২। এটা একটা সৃষ্টিগত ও স্বভাবজাত দাবী যে, নিজ প্রভু ও অনুগ্রহকারীর প্রতি আদব-সম্মান প্রতি মুহূর্তে, যে-কোন মুল্যে, যে-কোন অবস্থায় বজায় রাখতে হবে। মানুষ যদি চিন্তা করে তাহলে নিজেকে তার অস্তিত্বের প্রতিটি রন্দ্রে রন্দ্রে , জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে মহান আল্লাহর অনুগ্রহের সাগরে ডুবন্ত দেখতে পাবে। আল্লাহ তা‘আলা যদি সম্মান না দেন তাহলে মানুষ অপমান-অপদস্ত, তিনি সুস্থতা না দিলে সে রোগী,অসহায় ; তিনি বিবেক-বুদ্ধি প্রদান না করলে মানুষ পাগল-বোকা ; তিনি শ্রবণ শক্তি না দিলে মানুষ বধির ; তিনি কথা বলার শক্তি না দিলে মানুষ বোবা ; তিনি দৃষ্টি শক্তি না দিলে মানুষ অন্ধ। সুতরাং ওই আল্লাহ তা‘আলাই প্রকৃত অনুগ্রহদান ও উপকারকারী। যে-কারণে ইবাদত-আনুগত্য,আরাধনা-বিনয়ের ললাটও তাঁরই সম্মুখপানে অবনত হওয়া চাই এবং সর্ব-প্রকার বিনয়-আদব তাঁরই সকাশে উৎসর্গিত হওয়া চাই। যেসব সম্মানীত মনীষীদের স্বীয় মনিব ও মাওলার মা‘রিফাত ভাগ্যে জুটেছে তাঁদের জীবনের প্রতিটি দিক ও কর্ণারই আদবের সুবাসে মোহিত ও মুগ্ধ ছিল। নি¤েœ কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হচ্ছে:
পবিত্র কুরআন হতে উদাহরণ
০১। হযরত নূহ (আ)-এর উদাহরণ: হযরত নূহ (আ) নিজ সম্প্রদায়কে হিদায়েতের পথে নিয়ে আসার জন্য সাড়ে নয়শত বৎসর পর্যন্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু তাঁর জাতি স্বীয় পথভ্রষ্টতা, সীমালঙ্ঘণ, বে-আদবী ও নাফরমানীতে অবিচল থাকলো। যেমনটি মহান আল্লাহ ইরশাদ করছেন- “নিশ্চিত তারা ছিল অন্ধ (অন্তর চক্ষু/বিবেক-চক্ষু) জাতি-সম্প্রদায়”।সুরা-আ’রাফ:৬৪) একদা তাঁর স্বীয় জাতির সীমালঙ্ঘণ ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হযরত নূহ (আ) প্রার্থনা করলেন: “হে প্রভু!এসব কাফির-অবিশ্বাসীদের একটি গৃহও যেন ধরাপৃষ্ঠে অবশিষ্ট না থাকে।”-(সুরা-নূহ : ২৬)
মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীর প্রার্থনা কবূল করে ওহী অবতীর্ণ করলেন, আপনি নৌকা প্রস্তুত করুন! অচিরেই ঝড়-বন্যা এসে পড়বে। আপনাকে ও আপনার পরিবারস্থদের বাঁচানো হবে এবং কাফিরদের নাম-চিহ্ন মিটিয়ে দেয়া হবে। হযরত নূহ (আ) একটি নৌকা বানালেন এবং লোকজনকে তাতে আরোহণ করালেন। তাঁর এক পুত্র অবাধ্য ছিল। সে নৌকায় উঠতে অস্বীকার করলো। হযরত নূহ (আ) বার বার তাকে বোঝালেন ; কিন্তু সে তার হঠকারিতায় অনড় রইলো ; শেষ পর্যন্ত মহাপ্লাবনে ডুবে গেল। এমতাবস্থায় তিনি পিতৃ-স্নেহ মমতার আবেগে প্রার্থনা করেন:
“হে প্রভু! আমার পুত্র তো আমার পরিবারস্থদের অন্তর্ভুক্ত । আর আপনার ওয়াদা তো অবশ্যই সত্য এবং আপনি তো বিচারকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিচারক”। (সূরা-হুদ : ৪৫)
উক্ত প্রার্থনার প্রতিটি শব্দই মহান আল্লাহর মহা দরবারের আদবের উজ্জল দৃষ্টান্ত। চিন্তা করুন! হযরত নূহ (আ) এমনটি বলেননি-“হে আল্লাহ আমার পুত্র ডুবে গেল! অথচ আপনার অঙ্গিকার পূর্ণ হলো না।” তার পরও আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করলেন :
“হে নূহ! সে আপনার পরিবারস্থদের অন্তর্ভুক্ত নয়। সে অবশ্যই অসৎকর্মপরায়ণ। সুতরাং যে-বিষয়ে আপনার জ্ঞান নেই সে বিষয়ে আমাকে অনুরোধ করবেন না। আমি আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি,আপনি যেন অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত না হন।” (প্রাগুক্ত-৪৬)
হযরত নূহ (আ) আল্লাহ তা‘আলার উক্ত সতর্কবাণীতে ভয়ে কম্পমান হলেন এবং নিবেদন করলেন:
“হে আমার রব! যে -বিষয়ে আমার জ্ঞাননেই,সে বিষয়ে যাতে আপনাকে অনুরোধ না করি, এ জন্য আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন এবং আমাকে দয়া না করেন,তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অর্ন্তভুক্ত হবো।” (প্রাগুক্ত-৪৭)
আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানী (র) আয়াতটির তাফসীরে এভাবে লিখছেন,“হযরত নূহ (আ) কেঁপে উঠলেন এবং তাওবা করলেন। এমনটি বললেন না যে,পুনরায় এমনটি করবো না,কারণ তাতে দাবি করা প্রকাশ পায়। বান্দার কি ক্ষমতা আছে! সমীচীন হচ্ছে তাঁর আশ্রয় প্রার্থনা করা যে,আমার দ্বারা যেন তেমনটি সংঘটিত না হয় এবং তেমনটি না করার সংকল্প অন্তরে থাকা চাই। হযরত আদম (আ) ও হযরত ইউনুস (আ) এর তাওবার যে বাক্য পবিত্র কুরআনে উদ্ধৃত হয়েছে তাতেও এই একই আদব রক্ষিত হয়েছে।”
২। হযরত ইবরাহীম (আ) এর উদাহরণ
হযরত ইবরাহীম (আ) আপন মূর্তিপুজারী সম্প্রদায়কে একত্ববাদের প্রতি আহ্বান জানালেন এবং নিজ প্রভুর পরিচয় পেশ করলেন এমনসব বাক্যে-
“তিনি হচ্ছেন সেই প্রভু যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনিই আমাকে হেদায়াত দিয়েছেন।আর তিনিই খাওয়ান ও পান করান। এবং রোগাক্রান্ত হলে তিনিই আরোগ্য দান করেন;” (সূরা-আশ-শু‘আরা : ৭৮-৮০)
সুবহানাল্লাহ! কত আদবপূর্ণ বক্তব্য। এতে কত সূক্ষতা,দূরদর্শিতা,বিনয় ও ন¤্রতা বিদ্যমান যে, সবগুলো গুণের সংশ্লিষ্টতা আল্লাহর প্রতি (সৃষ্টি করা, হেদায়াতদান,পানাহার করানো ও আরোগ্যদান করা) সাব্যস্ত করেছেন এবং রোগকে নিজের প্রতি সম্পৃক্ত করেছেন। যদিও রোগ-বালাইও আল্লাহর পক্ষ হতেই এসে থাকে ; কিন্তু বাহ্যিকভাবে রোগকে একটা দোষ বা ত্রæটি হিসাবে দেখা হয় বিধায় সেটির সম্পৃক্ততা আল্লাহর প্রতি করতে যাওয়া আদব-পরিপন্থী ছিল। যে-কারণে এভাবে বলেননি,“যিনি আমাকে রোগ দিয়েছেন তিনিই আমাকে আরোগ্যদান করেন”। বরং বাক্যের ভাবধারা পরিবর্তন করে এভাবে বলেছেন,“যখন আমি অসুস্থ হই তখন তিনিই আমাকে শিফা দান করেন”। সন্দেহাতীতভাবে মহান আল্লাহর এই কালামই তাঁর দরবারের শোভনীয় সর্বোত্তম আদবের উদাহরণ্।
৩। হযরত আইয়ূব (আ) এর উদাহরণ
হযরত আইয়ূব (আ)-কে আল্লাহ তা‘আলা প্রথমদিকে সবদিক থেকে জাগতিকভাবে সুখ-সম্বৃদ্ধি দান করেছিলেন। রিযিকের প্রশস্ততা এ পরিমাণ যে, তিন হাজার উট, তিন হাজার ঘোড়া, এক হাজার ছাগল,পাঁচ শত খাদেম ও কাজের লোক এবং ফল-ফসলের অনেক বড় বড় বাগান দান করেছিলেন। তার অতিরিক্ত নেক সন্তান ও পুণ্যবতী, সৎ চরিত্রের অধিকারীণী ও রূপসী স্ত্রী দান করেছিলেন। মহান আল্লাহর ইচ্ছায় এক পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে তাঁর উপর বিপদ-আপদের যুগ শুরু হল। সবগুলো বাগান জ্বলে গেল, চতুষ্পদ জন্তুগুলো মরে গেল, সন্তানগুলো ঘর বিধ্বস্থ হয়ে মারা গেল। শারীরিক রোগ-ব্যাধি তাঁকে ঘিরে ধরলো। প্রথম প্রথম শরীরে ফোস্কার জন্ম হলো, যা ক্ষতস্থানে রূপ নিল। হযরত আইয়ূব (আ) ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতার প্রতীক হয়ে গেলেন। এক পর্যায়ে এমন বাক্যে প্রার্থনা জানালেন- “তিনি তাঁর রবকে ডেকে বলেছিলেন,আমি তো দুঃখ-কষ্টে পড়েছি,আর আপনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু! (”সূরা-আল-আম্বিয়া : ৮৩)
উক্ত প্রার্থনায় কাকুতি-মিনতির এক অবাকজনক ধারা বিদ্যমান। তিনি যদি - “হে আল্লাহ! আমাকে আরামদায়ক অবস্থা ও আরোগ্যদান করেন”-বাক্যে প্রার্থনা করতেন তাও বৈধ হতো ; কিন্তু দাসত্বের দাবী ছিল,আদবের বহিপ্রকাশ। তাই তিনি ধৈর্য ও আদবের সম্মিলিত এমন শ্রেষ্ঠ উদাহরণ পেশ করলেন যে,মহান প্রভু তাঁর প্রতি বাণী পাঠিয়ে দিলেন- “নিশ্চয় আমি তাকে পেয়েছি ধৈর্যশীল। কতই না উত্তম বান্দা তিনি! নিশ্চয় তিনি ছিলেন আমার অভিমুখী”। (সুরা-সোয়াদ : ৪৪) মহান আল্লাহ তিনটি শব্দ-বাক্যে-‘ধৈর্যশীল’,‘কতই না উত্তম বান্দা’ ও ‘আল্লাহ-অভিমুখী’ -হযরত আইয়ূব (আ)-কে সম্মানীত করেছেন। কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক মুসলমানই কুরআন তিলাওয়াত কালীন উক্ত বাক্যগুলো পাঠ করে মহান আল্লাহর প্রতি আদব প্রদর্শনে প্রাপ্ত বিনিময়ের কথা স্মরণ করতে থাকবে।
৪। হযরত মূসা (আ) এর উদাহরণ: ‘তারীখুর-রুসুল ওয়াল-মুলূক’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে,হযরত মূসা (আ) যখন একাধারে সাতদিন ও সাত রাত সফর করে মাদ্য়ান পৌঁছলেন তখন মারাত্মক ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর হয়ে এভাবে দু‘আ করলেন-“হে প্রভু! আপনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করবেন আমি তার কাঙ্গাল”। (সূরা-কাসাস : ২৪)
হযরত মূসা (আ) যদি স্বীয় প্রার্থনায়-“হে আল্লাহ! আমাকে খাবার দান করুন!”-এভাবে বলতেন,তা-ও সুযোগ ছিল। কিন্তু তিনি এমন বাক্যে প্রার্থনা করলেন যা মহান আল্লাহর শাহী দরবারের আদব রক্ষার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হয়ে আছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন