বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ফিলিস্তিন প্রশ্নে ট্রাম্পের উদ্ভট চিন্তা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৪ জুলাই, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

বিংশ শতকের শুরুতে বিশ্ব যে সব নতুন সংকটের সম্মুখীন হতে শুরু করেছিল তার প্রায় সবই ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের হেজিমনিক নীলসকশা থেকে উদ্ভুত। প্রথম মহাযুদ্ধের পরিনতিতে উসমানীয় খেলাফত ভেঙ্গে ফরাসী ও বৃটিশদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা। মধ্যপ্রাচ্যে পরিবারতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের উদ্ভব এবং ফিলিস্তিনি আরবদের বাস্তুচ্যুত করে তাদের জমিতে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার নীলনকশা মধ্যপ্রাচ্যে যে সংকটের জন্ম দিয়েছিল গত ৭০ বছরেও সেই সংকট থেকে মুক্তি পায়নি ফিলিস্তিন ও আরব মুসলমানরা। যেহেতু ইসলাম কোন আঞ্চলিক ধমীয়-সংস্কৃতির নাম নয়, এটি একটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্বজনীন ধর্ম ও মতবাদ। আর মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিন হচ্ছে ইসলামী দুনিয়ার তাৎপর্যময় আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু, এ কারণে মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিনের সংকট শুধু প্যান ইসলামিক বিশ্বকেই প্রভাবিত করেনি, সমগ্র বিশ্বসম্প্রদায়কেই তা প্রভাবিত ও আক্রান্ত করেছে। আজকের বিশ্বসম্প্রদায় যে সব মানবিক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক সংকটের মুখোমুখি দাড়িয়েছে তার প্রায় সবই আবর্তিত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে এবং মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মূল ইস্যুই হচ্ছে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের দখলদারিত্ব, আগ্রাসী মনোভাব এবং বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনীদের পিতৃভ‚মিতে পুর্নবাসন এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও অনিবার্য আকাঙ্খার ন্যায্যতাকে অগ্রাহ্য করার পশ্চিমা মনোবৃত্তি। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বসম্প্রদায় স্পষ্টত দুইভাগে বিভক্ত হলেও জার্মান একনায়ক হিটলারের নাৎসীবাদ ও ইহুদি নিধনের এজেন্ডার সাথে কোন মুসলমান রাষ্ট্র বা শাসকের সম্পৃক্ততা বা সমর্থন ছিলনা। বরং বিগত প্রায় দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে শুধুমাত্র মুসলমান শাসকরাই ইহুদি জনগোষ্ঠির নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। আন্দালুসিয়ার মুসলমান শাসকদের সময়কালকে ঐতিহাসিকরা ইহুদি সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বর্ণযুগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। গ্রীকদের হাতে, রোমানদের হাতে, সেলজুক খৃষ্টানদের হাতে মার খেয়ে উদ্বাস্তু হয়ে হাজার বছর আগে অনেক ইহুদি মধ্যপ্রাচ্য ত্যাগ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসতি ও ব্যাবসা বাণিজ্য গড়ে তুলেছিল। কালের বিবর্তনে অনেক ইহুদি যেমন কৃশ্চানিটি অথবা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল, আবার অনেকেই নিজ ধর্মে অবিচল থেকেও মধ্যপ্রাচ্যের খৃস্টান ও মুসলমানদের সাথে শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করে আসছিল। কোটি কোটি মুসলমান ও খৃস্টানের পাশাপাশি কয়েক লাখ ইহুদি কোন সমস্যা হয়ে দাড়ায়নি। তবে ইউরোপে ইহুদিদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উচ্চাভিলাস প্রায় প্রতিটি দেশেই সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইহুদিরা সমাজে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করলেও উনবিংশ শতকে ইহুদিদের মধ্যে জায়নবাদি রাজনৈতিক চেতনা দানা বাঁধার আগে এই সমস্যা কখনো এতটা প্রকট হয়ে উঠেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ও অক্ষশক্তির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে হিটলারের ইহুদি গণহত্যা একটি স্পর্শকাতর ইস্যু হিসেবে আর্বিভ‚ত হয়। জার্মানীসহ নাৎসীদের অধিকারে থাকা ইউরোপীয় দেশগুলোর বাস্তুচ্যুত ইহুদিদের নিজ নিজ রাষ্ট্রে পুনর্বাসনের বদলে অযৌক্তিক ও অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তাদেরকে ফিলিস্তিনের ভ‚মিতে পুর্নবাসিত করার পেছনে ছিল পশ্চিমাদের সম্মিলিত সা¤্রাজ্যবাদি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নীলনকশা। একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পুরণে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বালফোরের প্রতিশ্রæতির বিনিময়ে ইহুদিরা ইঙ্গ-মার্কিনীদের পক্ষ নিয়েছিল। বালফোরের ডিক্লারেশনের পর তিরিশ বছরেও ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও ইহুদিদের জন্য একটা আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উপযোগি জনসংখ্যা না থাকায় তা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি গণহত্যা নিয়ে ইহুদি প্রভাবিত মিডিয়াগুলো ইহুদি নির্যাতনের ফ্যাক্টসকে মিথে পরিনত করে। এই মিথ এতটাই প্রবল ও একতরফা প্রভাব সৃষ্টিকারী ছিল যে বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী মিত্রশক্তি মধ্যপ্রাচ্যকে তাদের অধিকৃত অঞ্চল হিসেবে ভাবতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিল। প্রথমে রাষ্ট্রকে চার্চ থেকে আলাদা করে ফেলা অত:পর ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পর খৃষ্টবিশ্ব কার্যত ধর্মীয় ভাবাবেগ পরিত্যাগ করলেও তারা কখনো ক্রুসেডের স্মৃতি ভুলে যায়নি। এরপরও ফিলিস্তিনে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার সময় জেরুজালেম নগরীকে একটি বিশেষ মর্যাদা দিয়ে তা ইহুদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা হয়েছে। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার দুই দশক পূর্তির প্রাককালে ৬ দিনের যুদ্ধে জেরুজালেম, গোলান মালভ‚মিসহ আরবদের কাছ থেকে বিশাল ভ‚-ভাগ দখলে নেয়ার পেছনে ছিল পশ্চিমাদের সা¤্রাজ্যবাদি নীলনকশা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং পরবর্তিকালে বিভিন্ন যুদ্ধে বেশকিছু রাষ্ট্রে ভ‚মির দখলদারিত্ব ও ভাগাভাগির শিকার হলেও এসব সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ ও পদক্ষেপ যথেষ্ট ফলপ্রসু হয়েছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিমা সহায়তায় একদিকে ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বশান্তির জন্য একটি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবে পরিনত হয়েছে। অন্যদিকে ৬দিনের যুদ্ধে দখল করা আরবদের ভ‚মি ফেরত দেয়া দূরের কথা উপরস্তু ফিলিস্তিনিদের আওতাভুক্ত এলাকায় নতুন নতুন ইহুদি বসতি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে জায়নবাদের সম্প্রসারণবাদি নীতির বাস্তবায়ন ঘটিয়ে চলেছে। বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের নিজ ভ’মিতে পুনর্বাসন এবং একটি স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে তাদের অধিকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমাদের যেন কোন দায় নেই। ফিলিস্তিনের উপর ইসরাইলী দখলদারিত্ব এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরব প্রতিবেশীদের উপর আগ্রাসী মনোভাব উস্কে দিয়ে ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ প্রকারান্তরে ইসরাইলকে একটি স্থিতিশীল ও গ্রহনযোগ্য রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়নি। এ কারণে গত ৭০ বছরেও সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে প্রতিবেশী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি ইসরাইল। ইসরাইলেল প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের এরকতরফা সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতার পরও ইসরাইল ক্রমশ আরো বেশী বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়ে পড়ছে। এই বিচ্ছিন্নতা এখন খোদ গ্রেট বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও গ্রাস করতে শুরু করেছে। ব্রেক্সিট ঘোষনার মধ্য দিয়ে গ্রেট বৃটেন এখন ইউরোপের বাকি অংশ থেকে অর্থনৈতিকভাবে আলাদা হতে যাচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্বসম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব ও অংশিদারিত্ব থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। মার্কিনীদের এই অপরিনামদির্শ বিচ্ছিন্নতা বিশ্ববাণিজ্য, বিশ্বঅর্থনীতি, বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার জন্য এখন বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। হোয়াইট হ্উাজে অভিষেক হওয়ার পর প্রথমেই ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ(টিপিপি) থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের ঘোষনা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরপর প্যারিসে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বসম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ থেকে সড়ে দাঁড়ানোর ঘোষনা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদের উপর মার্কিনীদের নির্ভরশীলতা এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের বশংবদ রাজা এবং কোটি কোটি শান্তিকামী মানুষের কথা বিবেচনা করে আরব-ইসরাইল শান্তি আলোচনা ও উদ্যোগে মার্কিনীদের আন্তরিকতা থাকলে তা ব্যর্থ হওয়ার কোন কারণ ছিলনা। তারা এতদিন মূলত মধ্যস্থতাকারির ভান করেছিল মাত্র। ডোনাল্ড ট্রাম্প সে মুখোশ ফেলে দিয়ে মার্কিনীদের মধ্যপ্রাচ্য নীতির আসল চেহারা উন্মোচন করেছেন। জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এতদিনের ঘোষিত মার্কিন নীতি ‘টু স্টেট সলিউশন’ বিসর্জন দিয়েছেন। জেরুজালেম প্রশ্নে ট্রাম্প জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঘোষিত সিদ্ধান্ত ও নীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন। জেরুজালেমের উপর ইসরাইলীদের অধিকারের দাবী জাতিসংঘের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো নাকচ করে দেয়ার পর ইসরাইল ইউনেস্কোর সদস্যপদ প্রত্যাহারের ঘোষনা দিয়েছিল। এখন বোঝা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা ট্রাম্প প্রশাসন মার্কিন জায়নিস্ট লবি ও নিওকনদের সমর্থন অব্যাহত রাখতে বরাবর ইসরাইলের দেখানো পথেই হাঁটছে। আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা লঙ্খন করে ইসরাইল বার বার ফিলিস্তিনীদের উপর গণহত্যাসহ বিভীষিকাময় নির্যাতন চালাচ্ছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে গত দেড় দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে একই কাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও করে যাচ্ছে। সম্ভবত এ কারণেই ২০০৬ সালে জাতিসংগের মানবাধিকার পরিষদ গঠিত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট জর্জবুশ এই সংস্থায় যোগ দিতে রাজি হননি। বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ২০০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিংসঘের মানিবাধিকার পরিষদের সদস্য হিসেবে যোগ দেয়। মার্কিনীদের অসহযোগিতার কারনে ইসরাইলসহ বিশ্বের মানবাধিকার লঙ্ঘরকারিদের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ ছাড়া এই সংস্থা তেমন কোন উদ্য্গো নিতে পারেনি। উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমার, দক্ষিন সুদানসহ বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লঙ্খনের বিরুদ্ধে আনীত প্রস্তাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সায় থাকলেও শুধুমাত্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে আনীত প্রস্তাবের বিরোধিতা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা একদিকে ইসরাইলের মানবতা বিরোধি কর্মকান্ডে মদদ দিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে ইসরাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়াকে পক্ষপাতমূলক আখ্যা দিয়ে (ইউএনএইচসিআর) জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ থেকে পদত্যাগ করে সরাসরি ইসরাইলের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এহেন ভ‚মিকায় ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা করেছে ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কট্টর ইসরাইল সমর্থক ও যুদ্ধবাদি ব্যক্তিদের নিয়ে তার প্রশাসন ও ক‚টনৈতিক দল সাজিয়েছেন। এদের মধ্যে মাইক পম্পেও, জন বোল্টনের পাশাপাশি জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালির নাম করা যায়। জাতি সংঘে নিকি হ্যালির ভ‚মিকা ও দেখে বিভ্রান্ত হতে হয় তিনি কি সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি নাকি ইসরাইলীদের নিয়োগ দেয়া এজেন্ট! দীর্ঘদিন ধরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, ন্যাটো, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় প্রভাব সৃষ্টি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা ইরান, ইরাক, উত্তর কোরিয়াম কিউবা, ভেনিজুয়েলাসহ বেশকিছু দেশের উপর বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে সক্ষম হলেও তাদের ঐক্যবদ্ধ ভ‚মিকা ক্রমেই শিথিল হয়ে পড়ায় এবং ইসরাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকে আর ধামাচাপা রাখা সম্ভব না হওয়ায় এখন মানবাধিকার পরিষদের সদস্য হিসেবে নাম প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে আবারো প্রমানীত হয়েছে ইসরাইল আসলে মার্কিনীদের পরিপুষ্ট একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। এতদিন নানা অজুহাতে অবরোধ ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে অনেক দেশকেই তারা ‘প্যারিয়াহ’ বা বিশ্বসম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার পর এখন তারা নিজেরাই বিশ্ব সম্প্রদায় থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। মাত্র ২ বছরের মধ্যেই ট্রাম্প প্রশাসন একে একে টিপিপি, ইরানের পারমানবিক সমঝোতা চুক্তি, ফিলিস্তিন প্রশ্নে ‘টু স্টেট সলিইশন’ নীতি, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে গুটিয়ে নিলেও এসব সংস্থা ও চুক্তি অকার্যকর হয়ে যায়নি।বিশ্বশান্তির পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত মানবিক উদ্যোগগুলো থেকে মার্কিনীদের এই স্বেচ্ছা বিচ্ছিন্নতার অর্থ হচ্ছে নেতৃত্ব এবং বিশ্বের সাধারণ সভ্য হিসেবে নিজেদের অবস্থান গুটিয়ে নেয়া। বিশ্বে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টির নেপথ্য কুশীলব হিসেবে এমনিতেই নেতৃত্বের নৈতিক অধিকার হারিয়েছে মার্কিনীরা। ইসরাইলী আগ্রাসন, দখলদারিত্ব ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বিশ্বজনমত যখন প্রতিবাদে সোচ্চার তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ‚মিকা অমানবিক নির্লজ্জতার নিকৃষ্ট উদাহরণ। সিআইএ’র সাবেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ফিলিপ জিরালদির লেখা একটি নিবন্ধ গত ২৮ জুন আইসিএইচ অনলাইনে প্রকাশিত হয়। ‘দ্য ইউনাইটেড স্টেটস উইথড্রজ ফ্রম দ্য ওয়ার্ল্ড’ শিরোনামের নাতিদীর্ঘ নিবন্ধে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সংস্থা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহার এবং জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালির ভ‚মিকা ও নানা মন্তব্যের কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। গত বছরের ফেব্রæয়ারীতে জাতিসংঘে ক‚টনীতিক হিসেবে সাবেক ফিলিস্তিনী প্রধানমন্ত্রী সালাম ফায়াদের নিয়োগে বাধাঁ দেয়ার প্রসঙ্গে কংগ্রেসনাল হির্য়ারিংয়ে নিকি হ্যালিকে প্রশ্ন করা হয়, এটা কি তোমাদের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত যে ইসরাইলকে সাপোর্ট করার পাশাপাশি যোগ্যতাসম্পন্ন ক‚টনীতিকদের জাতিসংঘে যোগদান থেকে রহিত করা? জবাবে নিকি বলেছিলেন, হাঁ, আমাদের প্রশাসন ইসরাইলকে সমর্থন করার প্রত্যেক ফিলিস্তিনিকে অবরুদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং আন্তর্জার্তিক স্বীকৃতি যখন একটি অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্য রাষ্ট্র এবং বিশ্বের ৮০ ভাগ মানুষ ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছে। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের পিছনে একা দাঁড়িয়ে ক‚টনৈতিক দেউলিয়াত্বের মুখে পড়েছে।
বিশ্বনেতারা বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের শান্তি, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধির কথা ভাববে। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে এশিয়া-আফ্রিকার মানুষদের সম্পদ লুণ্ঠন ও শ্রম শোষনের মধ্য দিয়ে। এসব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল কারিগর এখনো অভিবাসি নাগরিকরাই। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সাথে আফ্রো-এশিয়ান কৃষ্ণাঙ্গ ও তামাটে মানুষদের অবদান অনেক বেশী। বহুভাষা ও সংস্কৃতির মানুষদের একই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পতাকাতলে সামিল করে একটি সমৃদ্ধ মার্কিন জাতি গঠনই ছিল আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদারদের মূল লক্ষ্য। জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিঙ্কন থেকে জনএফ কেনেডি, মার্টিন লুথার কিং থেকে বারাক ওবামা পর্যন্ত এই স্বপ্নের লালন অক্ষুন্ন ছিল। বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্যমুক্ত উদার গণতান্ত্রিক আমেরিকা ও বিশ্ব গড়ে তোলতে মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদারদের সেই স্বপ্ন এখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে চুরমার হতে চলেছে। তাঁর পূর্বসুরী রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ভুল সিদ্ধান্ত ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিনীদের ঐতিহ্য, মার্কিন জনগন ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের স্পৃহা ও প্রত্যাশার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে বিশ্বশান্তির জন্য বড় বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছেন। ইসরাইল একযুগের বেশী সময় ধরে গাজার ফিলিস্তিনীদের উপর সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করে সেখানকার ২০ লাখ মানুষকে একটি অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েই বসে থাকেনি, উপরন্তু আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও রীতিনীতি অগ্রাহ্য করে মিথ্যা, ঠুনকো অজুহাতে বার বার বিমান হামলা, সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে পুরো ফিলিস্তিনি জনপদকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করে তাদের নিশ্চিহ্ন করার পায়তারা করেছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই হচ্ছে ইসরাইলের এসব মানবতা বিরোধি অপরাধের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও মদদ দাতা। এতকিছুর পর টু স্টেট স্যলিউশন নীতি থেকে সরে যাওয়া, জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার পরও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তার জায়নবাদি সহযোগিরা ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে বাস্তবতা বিবর্জিত একটি ‘আলটিমেট ডিল’র কথা বলছেন। যেখানে জেরুজালেমের দাবী পরিত্যাগ করার বিনিময়ে দখলকৃত কিছু ফিলিস্তিনি গ্রাম ছেড়ে দেয়ার পাশাপাশি মোটা অংকের অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়ার অনানুষ্ঠানিক প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মার্কিন প্রখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার জামাতা ও উপদেষ্টা জারেড কুশনারের প্রস্তাবিত ফিলিস্তিন ও আরব-ইসরাইল সংকট সমাধানের সর্বশেষ উপায় বা ’আলটিমেড ডিল’ কে অবাস্তব পাগলামি বলে অভিহিত করেছেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন, গত ৭০ বছরে তিন তিনটি আরব ইসরাইল যুদ্ধ, হাজার হাজার আরব-ফিলিস্তিনীর মৃত্যু, লাখ লাখ আরব মুসলমান উদ্বাস্তু জীবন বেছে নেয়ার পাশাপাশি যারা জীবন বাজি রেখে ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, অকাতরে পঙ্গুত্ব বরণ করছে, জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে, তারা কি ভাল রাস্তা, ভাল বাড়িঘর, কিছু উন্নত ক্লিনিক ও অর্থনৈতিক লাভের জন্য এসব করছে? ফিলিস্তিনে কিছু দালাল রাজনীতিবিদ সৃষ্টি করে নেতৃত্ব দিয়ে তাদের মাধ্যমে অর্থনৈতিক-রাজনৈদিতক সুযোগ সুবিধা দিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও জাতীয়তাবোধের সব আকাঙ্খা পরিত্যাগ করার প্রস্তাবকে‘ইনসেনিটি’ বা পাগলামি বলে মনে করছেন ফিস্ক। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং বায়তুল মোকাদ্দাসের মুক্তি একই সুত্রে গাঁথা। মধ্যপ্রাচ্যে রিজিম চেঞ্জ ও অধিকৃত ফিলিস্তিনে বশংবদ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে কোন অবাস্তব চুক্তি চাপিয়ে দিয়ে জেরুজালেমের অধিকারের দাবী থেকে ফিলিস্তিন ও বিশ্বমুসলিমদের নিবৃত্ত করার পরিকল্পনা অলীক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। দুই রাষ্ট্রের সমাধানের পথ রুদ্ধ করে দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ইসরাইলের অস্তিত্বকেই বড় ধরনের সংকটের মুখে ঠেলে দিতে চাইছে। পৃথিবী অনেক বদলে গেছে, আরবরা এবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসরাইলের উপর আঘাত হানলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তাকে রক্ষা করা আর সম্ভব নাও হতে পারে। bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন