বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

উষ্ণায়ন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৭ জুলাই, ২০১৮, ১২:০২ এএম

 

বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার পরিবর্তন চিন্তাশীল মানুষকেই রীতিমত ভাবিয়ে তুলেছে এবং একই সঙ্গে দুশ্চিন্তাও বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের এ সবুজ গ্রহটি নিয়ে এখন শুধু বিজ্ঞানীরাই নন সাধারণ মানুষও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার যে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে সেটিকে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন গুরুতর। আবহাওয়ার এ পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রচÐ ঝড়, জলোচ্ছ¡াস, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, পৃথিবীর আবহাওয়া ক্রমেই উষ্ণ হয়ে উঠছে। গেল ১৩০ বছরের আবহাওয়ার খবর নিতে গিয়ে দেখা গেছে, এ সময়কালের উষ্ণতম দশটি বছর ১৯৮০ থেকে ১৯৯০। এর মধ্যে গড় উষ্ণতম বছরটি ছিল ১৯৯৫।

পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র পানির উষ্ণতাও বেড়ে যায়। এর ফলে বায়ুস্তরে বেশি পরিমাণে সমুদ্র থেকে বাষ্প সঞ্চিত হতে থাকে এবং তীব্র ও ভয়ঙ্কর ঝড়ের সৃষ্টি করে। সা¤প্রতিককালে ঝড়ের বেগ ও ধ্বংস ক্ষমতা কতটা বেড়েছে সেটি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে। এ ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৭০ কিলোমিটার। এর ফলে দশ লক্ষাধিক ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছিল এবং মৃত্যু ঘটেছিল ১,৩৯,০০০ মানুষের। ১৯৯২ সালের আগস্টে হারিকেন এন্ড্রু আছড়ে পড়েছিল ফ্লোরিডার ওপর। এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৩৫ কিলোমিটার। ৮৫,০০০ ঘরবাড়ি ধূলিসাৎ করে প্রায় তিন লক্ষ মানুষকে গৃহহীন করেছিল। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল পঁচিশ বিলিয়ন ডলার বা পঁচিশ হাজার কোটি টাকা। ঝড়ের ইতিহাসে এটিকেই সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ইউরোপ ও আমাদের দেশ আরো কয়েকবার এ ধরনের মারাত্মক ঝড়ের মুখোমুখি হয়েছে।
১৯৯৫ সালে বিশ্ব-উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রাকৃতিক কোনো কারণ ছিল না। প্রতি চার বছর অন্তর প্রশান্ত মহাসাগরে যে প্রচÐ ঝড় এল নিনোর উৎপত্তি হয় সেবার এটিও ছিল না এবং সৌর তাপ বৃদ্ধির যে আবর্ত সেটিও ছিল নিম্নতম স্থানে। তবুও দেখা গেল পৃথিবীর বায়ুমÐলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ থেকেই বিজ্ঞানীদের ধারণা দৃঢ় হলো যে, পৃথিবীর আবহাওয়ার এ পরিবর্তনের জন্য দায়ী বায়ুস্তরে সঞ্চিত হওয়া গ্রিন হাউস গ্যাসগুলো যা মানুষের বিবিধ কর্মের ফলে উৎপন্ন হচ্ছে।
গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া কী এবং কেন: গ্রিন হাউস গ্যাসের মধ্যে বাষ্প, সূ² ধূলিকণার সঙ্গে রয়েছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস। ভূপৃষ্ঠ থেকে যে তাপ বিকিরিত হয়ে ঊর্ধ্বে ওঠে তার অনেকটাই শোষণ করে নেয় এসব গ্যাস। এভাবে পৃথিবীর বায়ুমÐলে এগুলোর দ্বারা তাপ সঞ্চিত হয়, যা মহাকাশে না গিয়ে সঞ্চিত হতে থাকে এবং এর ফলেই তাপ বাড়তে থাকে। এসব গ্যাসের দ্বারা সঞ্চিত তাপের প্রতিক্রিয়াতেই বায়ুমÐলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এটিকেই গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া বা গ্রিন হাউস এফেক্ট বলা হয়। প্রধানত বায়ুমÐলে যত বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড জমবে ততই বেশি তাপ সঞ্চিত হতে থাকবে। খনিজ, জৈব জ্বালানি যত বেশি পোড়ানো হবে তত বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হবে। এর ফলে আবহাওয়ায় তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাবে।
বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লবের সময় বায়ুমÐলের যে তাপমাত্রা ছিল বর্তমানে সে তাপমাত্রা দশমিক ছয় ডিগ্রি বেড়েছে। আর এরই ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবর্তিত হয়ে গেছে জলবায়ু, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। শুরু হয়েছে উভয় গোলার্ধের মেরুঅঞ্চলের বরফ গলা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ধীরগতিতে বেড়ে চলেছে এবং এভাবে চলতে থাকলে আগামী চার-পাঁচ দশকের মধ্যে সমুদ্র উপকূল অঞ্চলগুলোই শুধু পানির নিচে তলিয়ে যাবে না, বরং এর সঙ্গে বহু দ্বীপ ও দ্বীপপুঞ্জও সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। প্রচÐ ঝড়-ঝঞ্ঝা যখন-তখন আছড়ে পড়বে স্থলভাগের ওপর, ফসল উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হবে, পৃথিবীর বুকে দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া নেমে আসবে। এক কথায় সে সময় হবে বড়ই ভয়ঙ্কর। কারণ, শুধু মানুষ নয়, এতে সমগ্র প্রাণিকুলেরও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে।
বিষয়টি কল্প-বিজ্ঞানীদের কাহিনী নয়। চূড়ান্ত এ বাস্তবের দিকেই আমরা ছুটে যাচ্ছি কোনো ধরনের চিন্তা-চর্চা না করেই। তবে সান্ত¦না এখানেই যে, বিশ্বের সব মানুষই লোভ-লালসার দাস নয়, কল্যাণ চিন্তাও অনেকের মধ্যে ক্রিয়াশীল রয়েছে। সে কল্যাণ চিন্তা থেকে প্রথমেই বিজ্ঞানীরা এ ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন এবং পরবর্তীতে কিছু চিন্তাশীল মানুষ বিজ্ঞানীদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বিশ্বাসীকে সচেতন করে তোলায় ব্রতী হয়েছেন।
কিয়োটো প্রটোকল: জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কীয় আন্তঃসরকারি প্যানেল জানিয়েছে, ১৯৯০ থেকে ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বের উষ্ণতা গড়ে ১.৪ ডিগ্রি থেকে ৫.৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রবল। সে জন্যই গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনা নিতান্ত জরুরি হওয়ায় ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে জাপানের কিয়োটা শহরে বিশ্বের ১৬৪ দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন শেষে বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রতিটি দেশকেই মোট কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন ৫৫ শতাংশ কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়। উন্নত দেশগুলোর জন্য এটি বাধ্যতামূলক এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনের মাত্রা বুঝে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়। দেশগুলো এ সিদ্ধান্ত মেনে চলার জন্য একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। সে চুক্তির নামই কিয়োটো প্রটোকল। স্থির হয় ২০০৮ সালের মধ্যে শিল্পসমৃদ্ধ উন্নত দেশগুলো ১৯৯০ সালের তুলনায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনের পরিমাণ কম করেও পাঁচ শতাংশ কমিয়ে আনবে। বলাবাহুল্য, উন্নত দেশগুলোই তাদের শিল্প মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস বায়ুতে ছাড়ছে।
কিন্তু কার্যত দেখা গেল, আমেরিকাসহ অন্যান্য উন্নত দেশ এ গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনার ব্যাপারে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে ২০০১ সালে জার্মানির বন শহরে বিশ্বের ১৮০টি দেশের পরিবেশ মন্ত্রীরা এক বৈঠকে মিলিত হন। বন বৈঠকেও কিয়োটো চুক্তি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রেও আমেরিকা ও ইউরোপের উন্নত দেশগুলো নানা ধরনের ওজর-আপত্তি তোলে এবং পরোক্ষভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঘাড়ে সমস্ত দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। শুধু তাই নয়, তারা কল-কারখানাগুলোর যন্ত্রপাতি বদলে নতুন ধরনের কম গ্যাস নির্গত হয় এ ধরনের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রস্তাব রাখে। নিজেদের দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কলকারখানায় নতুন যন্ত্রপাতি বসাবার এ প্রস্তাবের পিছনে অবশ্য তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থও জড়িয়ে রয়েছে। কারণ শিল্পোন্নত দেশগুলোতেই এ ধরনের যন্ত্রপাতি নির্মাণ হয়ে থাকে এবং সেগুলো উচ্চমূল্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে বিক্রয় করার সুযোগ নিতে চাইছে উন্নত দেশগুলো। ফলে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসের কল্যাণকর চিন্তাটি এখন পর্যন্ত বাস্তবে রূপ লাভ করেনি।
এদিকে উদ্বেগ দিনদিন বেড়েই চলেছে। ইতোমধ্যেই উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে মেরুঅঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করেছে এবং এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৮০ বছরের মধ্যে মেরুঅঞ্চলের সব বরফ গলে গিয়ে পৃথিবীর অধিকাংশ স্থলভাগকে জলমগ্ন করবে। অবশ্য আবহাওয়ার এ পরিবর্তন রোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার কিছু কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কল-কারখানার ধোঁয়া নির্গমন রোধ, যানবাহন থেকে এ বিষাক্ত গ্যাস নির্গমন নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ অনুকূল বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার ইত্যাদি এর মধ্যে রয়েছে।
এছাড়াও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়েও দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন অনুভূত হলো, তাহলো কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে নিজেদের জন্য অক্সিজেন বৃদ্ধি প্রয়োজন। গাছপালা বায়ুতে অক্সিজেন ছাড়ে। কিন্তু মানুষের লোভের মুখে বন-জঙ্গল-অরণ্য খুব দ্রæতহারে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। এটির পরিণতিতে বায়ুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড যে পরিমাণে শোষিত হওয়ার কথা ছিল তা হচ্ছে না। সুতরাং যে কোনোভাবেই হোক, গাছপালার বৃদ্ধি ও বনভূমি সংরক্ষণ ঘটাতে পারলে শুধু কল-কারখানায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি লাগিয়ে বায়ুতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ হ্রাস করা সম্ভব নয়।
কিয়োটো ও বন সম্মেলনে সাফল্য না আসায় সমগ্র মানব সমাজের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য প্রাণিকুলের ওপরও ভয়ঙ্কর বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। এ স্থিতাবস্থা দূর করে গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া রোধে সবাই মিলিতভাবে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে এগিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
লেখক: সাংবাদিক, বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরষ্কার (১ম স্বর্ণপদক) প্রাপ্ত। সদস্য-বন ও পরিবেশ কমিটি, সিলেট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Md Taslim Mia ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ২:১৯ এএম says : 0
খুভ সুন্দর লিখেছেন
Total Reply(0)
Md Taslim Mia ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ২:২০ এএম says : 0
খুভ সুন্দর লিখেছেন
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন