শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস

হাসান সোহেল : | প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০১৮, ১২:১৩ এএম

রাজধানীর বাজারগুলোতে মাছ-মাংসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ক্রেতাদের উঠেছে নাভিশ্বাস। বিশেষ করে খেটে খাওয়া, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবন নির্বাহে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পেঁয়াজ, রসুন, মাছ, গোশত, শাকসব্জি, ডাল, তরিতরকারীসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দফায় দফায় মূল্য বৃদ্ধিতে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে নাগরিক জীবন। আয় নির্ধারিত অথচ বাজারে পঞ্চাশ টাকার নীচে কোন শাক, সবজি, তরিতরকারী মিলছে না। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী যানজট আর কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করেছে বলে অভিযোগ করছেন বিক্রেতারা। কয়েকদিন আগেও ৪০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হওয়া কাঁচা মরিচের দাম ছুঁয়েছে দুই শতকের ঘর। টমেটোর দাম বেড়ে গত সপ্তাহে দাড়িয়েছে ১৩০-১৪০ টাকা কেজি। গত দুই-তিন মাস ৭০-৮০ টাকার মধ্যে প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির ডিম কিনতে পেরেছেন ক্রেতারা। এখন সেই ডিম কিনতে ক্রেতাকে ১০০ টাকা গুনতে হচ্ছে। রোজায় বৃদ্ধি পাওয়া মুরগির দাম যেন কমছেই না। বরং তা বেড়েই চলছে। রোজার মাসে বাড়তি দাম ২০০-২২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া লাল কক মুরগির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। আর ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা কেজি দরেই বিক্রি হচ্ছে সাদা ব্রয়লার মুরগি। এছাড়া গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ থেকে ৫২০ টাকায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন সময়ে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কাজ করার আশ্বাস দেয়া হলেও তার কোনো প্রভাব নেই বাজারে। তাই ক্রেতারা মনে করছেন, নজরদারির অভাবেই সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হলেও বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা। আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন। আর নির্বাচনের আগেই আরেক দফা বেতন বাড়ানোর ঘোষণা আসবে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে সরকারি কর্মচারীদের ভবিষ্যৎ বেতন-ভাতা নির্ধারণ ও পরিবর্ধনের বিষয় পর্যালোচনা কমিটি তাদের প্রতিবেদনও চূড়ান্ত করেছে। এখন থেকে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের বেশি হলেই তাদের বেতন বাড়বে। শুধু তাই নয়, ১৪ লাখ চাকুরের বেতন বাড়ানোর জন্য পে-কমিশনও গঠন করা হবে না। বিকল্প হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে গঠন করা হচ্ছে পৃথক সেল। কিন্তু সাধারণ মানুষকে নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে পড়তে হচ্ছে নিদারুণ ভোগান্তিতে।
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা- মানুষের অত্যাবশ্যকীয় মৌলিক চাহিদা হিসেবে গণ্য করা হয়। এগুলোর একটি উপাদানের ঘাটতিতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। কিন্তু শুধু নিত্যপণ্যই নয়, মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রতিটা স্তরের সেবাই উচ্চমূল্যের দূষণে দূষিত। গরিব মানুষগুলো তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে উঠছে নাভিশ্বাস আর মধ্যবিত্ত খাচ্ছে হিমশিম।
বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল ও সন্তোষজনক বলে মনে করা হলেও চালসহ নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা স¤প্রতি একাধিক জরিপে উঠে এসেছে। বিশেষ করে শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয় না বাড়লেও নানাভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে শহুরে দারিদ্র্য বেড়েছে বলে পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। চালসহ নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষকে তাদের আয়ের বেশিরভাগ খাদ্যের পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে। এর ফলে সুষমখাদ্য তথা পুষ্টির চাহিদা পূরণ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও বাসস্থানের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ বা সংস্থান করতে পারছে না সাধারণ মানুষ। দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে চলছে দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতা, অস্বাভাবিকহারে ও অযৌক্তিক প্রক্রিয়ায় পণ্যমূল্য বৃদ্ধি দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রাকে দূর্বিষহ করে তুলেছে। সরকার একদিকে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল ও দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে, অন্যদিকে জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মূল্য বাড়িয়ে নিজেই পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে।
গতকাল বাজারে প্রতি কেজি শসা, কচুর লতি, করলা, কাঁকরোল, ঢেঁড়স ও বরবটি ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখা গেছে। তারপরও দীর্ঘদিন থেকে অস্বস্তিতে থাকা সবজির বাজারে এটা কিছুটা হলেও স্বস্তি বলা যায়। ঠিক উল্টো চিত্র দেখা গেছে মাছের বাজারে। বাজারে মাছের কিছুটা সংকটের কথা জানালেন বিক্রেতারা। সেই সঙ্গে দামও আগের তুলনায় কিছুটা বেশি। বাজারে ইলিশের সরবরাহ বাড়তে শুরু করলেও দাম নাগালের মধ্যে নেই বলে জানালেন ক্রেতারা। বাজারগুলোয় এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা ও ৬০০ গ্রামের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। এছাড়া প্রতি কেজি বড় চিংড়ি এক হাজার, ছোট চিংড়ি ৫০০, রুই ২৫০ থেকে ৪০০, বেলে ৬০০ থেকে ৭০০, পাবদা ৪৫০ থেকে ৫৫০, বাটা ১৬০, সরপুঁটি ১৬০, কই ১৮০ থেকে ২২০, কাতলা ২০০ থেকে ৪০০, তেলাপিয়া ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
সরবরাহ কম হওয়ার কারণে মরিচের দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আড়তে কাঁচা মরিচের সরবরাহ কম থাকার কারণে দাম বেড়েছে। বর্ষায় মরিচের ক্ষেত নষ্ট হয়ে যাওয়া ও অপর্যাপ্ত সরবরাহকেই দুষছেন তারা। কাঁচা মরিচের দাম বাড়ার বিষয়ে ব্যবসায়ী মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, কাঁচা মরিচের দাম সহসা কমার সম্ভাবনা কম। কারণ বৃষ্টিতে অনেকের ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। যার প্রভাবে বাজারে সরবরাহ কমেছে। টমেটোর দামের বিষয়ে শান্তিনগর বাজারের আবদুর রহমান বলেন, এখন যে টমেটো বিক্রি হচ্ছে তা কোল্ড স্টোরের। আগামী শীতে আবার বাজারে নতুন টমেটো আসবে। নতুন টমেটো আসার আগে বাজারে দাম কমার সম্ভাবনা কম। ডিম বিক্রেতারাও বলছেন, সরবরাহ কম। সে তুলনায় চাহিদা বেশি।
দীর্ঘদিন ঊর্ধ্বমুখী থাকার পর ঈদের আগে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসে চালের বাজারে। তবে হঠাৎ করে আবারও বেড়েছে চালের দাম। কেজি প্রতি দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে সব ধরনের চালের দাম। বিক্রেতারা বলছেন, চাতাল ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় এবং সরবরাহ কম থাকায় বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর ব্যবসায়ীদের অজুহাত- বাজেটে চাল আমদানির ওপর ২৮ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা, বিনা খরচে এলসি খোলার সুবিধা বাতিল হওয়া এবং সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃষক ও চাল উৎপাদকরা যেন ধানের ন্যায্য মূল্য পায় তা নিশ্চিতে চাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলায় শর্ত জুড়ে দেয়ার প্রভাব পড়েছে বাজারে। যদিও বাজেট ঘোষণার আগে থেকেই বড় ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকরা সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে চাল ধরে রেখেছেন। এ কৃত্রিম সংকটে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে- মোটা চাল মান ভেদে ৪০ থেকে ৪৮ টাকা ও চিকন চাল ৫৮ থেকে ৬২ টাকা দরে বেচাকেনা হচ্ছে। চাল বিক্রেতারা বলছেন, বন্যার পর গড় ছয় থেকে সাত মাসে চালের দাম যেটুকু কমেছিল গত এক মাসে চালের দাম আবার কিছুটা বেড়েছে। গত বছর হাওরাঞ্চলের ফসলহানি, বন্যা ও উদ্ভূত রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় এক মানবিক সংকটকাল অতিবাহিত করছে। ইতোমধ্যে যার প্রভাব পড়ছে আমাদের দেশের নিত্যপণ্যের বাজারে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোঃ শফিকুল ইসলাম লস্কর বলেন, ‘আমরা পাইকারি বাজারে বা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে অভিযান পরিচালনা করতে পারি। কিন্তু এত বেশি খুচরা দোকানে গিয়ে মনিটরিং করাটা বেশ কঠিন। যে কারণে পাইকারিতে অনেক সময় ঠিক থাকলেও সেটা খুচরাতে থাকছে না।’###

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন