বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

খেলা ফিচার

গবেষণার নাম ‘মিস্টার কাটার’

প্রকাশের সময় : ১৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শামীম চৌধুরী

শন অ্যাবটের বাউন্সারে ফিল হিউজ মাঠে লুটিয়ে পড়ে ঢলে পড়েছেন মৃত্যুর কোলেÑতার পরও অপরাধী নন ওই বোলার ! একবার শাহাদত রাজীবের বাউন্সারে রাহুল দ্রাবিড় মাঠ থেকে হাসপাতালেÑওই বাউন্সারেই বাহাবা পেয়েছেন শাহাদত। ক্রিকেট এমনই। যেখানে পেস বোলারদের ভয়ংকর রূপে দেখতে চান সবাই। সুইং,ইয়র্কার,শ্লোয়ার ডেলিভারীগুলোতে ব্যাটসম্যানদের আত্মসমর্পনই যে আদর্শ পেস বোলারের বিজ্ঞাপন। রাহুল দ্রাবিড়ের মিডল স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিয়ে এক সময়ের স্পিড স্টার শোয়েব আক্তারের উৎসবটা পেয়েছিল নুতন মাত্রা, নুতন বিজ্ঞাপন। হাল আমলে বাংলাদেশের রুবেলের কিছু কিছু ইয়র্কার নিয়েও হতভম্ব হতে হয়েছে। তবে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের রাজত্বের বিপরীতে একটা ছেলে যে প্রতিনিয়ত বিস্ময়ের ঝাঁপি খুলে বসেছেন, সেটাই যে এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড় বিজ্ঞাপন।
সীমান্ত উত্তেজনা এক সময়ে পাক-ভারত ক্রিকেট লড়াইয়ে পেতো রনাঙ্গনের উত্তাপ, বেজে উঠতো দল দু’টির রন সঙ্গীত। সেখানে এখন বাংলাদেশ-ভারত লড়াই পাচ্ছে রনাঙ্গনের উত্তাপ। ভারত মিডিয়া পর্যন্ত টেনে আনছেন এমন প্রসঙ্গ, দু’দেশের দর্শকও পাচ্ছে এমন উত্তাপ ! বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে মেলবোর্নে পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট প্রেমীদের ভারত বিদ্বেষী মনোভাবটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন আইসিসি’র সে সময়ের সভাপতি আ.হ.ম মোস্তফা কামাল ( লোটাস কামাল)। ক্ষোভটা ওই ম্যাচের পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের চেয়েও বেশি ছিল তার আইসিসি’র সে সময়ের চেয়ারম্যান শ্রীনিবাসনের উপর। সেই ক্ষোভের আগুনে জ্বলেছে বাংলাদেশ। সেই ক্ষোভের জ্বালা জুড়িয়ে মেলবোর্ন অবিচারের বদলা বাংলাদেশ নিতে পেরেছে মুস্তাফিজুর নামের এক বিস্ময় বোলারের আবির্ভাবে। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের পক্ষ হয়ে বাজে আম্পায়ারিং আর আইসিসি’র পক্ষপাত মূলক আচরনের জবাব দিতে মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে যখন চোখ ১৬ কোটি বাংলাদেশীর, তখন তাদের মানসিকতাকে ধারন করে তেতে ওঠাই স্বাভাবিক মাশরাফিদের। তবে ভেতরে চেপে যাওয়া জিদ,আর বদলার নেশা আগে-ভাগে আনতে চাননি মাশরাফি প্রকাশ্যে। মাঠের লড়াইয়ে মেলবোর্ন অবিচারের জবাব দিয়েছে মাশরাফি এন্ড কোং। প্রচলিত আইডিয়ায় একাদশ সাজানোর ফর্মূলা বাদ দিয়ে চতুর্থ পেস বোলার নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে শুধু হতভম্বই করেনি টীম ম্যানেজমেন্টÑভারতের বিপক্ষে সর্বোচ্চ স্কোরের ( ৩০৭/১০) ম্যাচে মুস্তাফিজ নামক চতুর্থ পেস বোলারেই ছিন্ন ভিন্ন হয়েছে ভারত। নিজের হাতে ওয়ানডে ক্যাপ মাথায় পরিয়ে দিয়ে ২০ বছর বয়সী ছেলেটার কাছে কিছু একটা চেয়েছিলেন মাশরাফি। অধিনায়ক মাশরাফি যার আইডল, তার হাত থেকে মাথায় ওঠা এই ক্যাপের মূল্য যে কতোটা,সে আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন মুস্তাফিজ ওয়ানডে অভিষেকে। অভিষেকে এই বাঁ হাতি আগুন বোলিংয়ে ( ৯.২-১-৫০-৫) ভারতের বিপক্ষে ৭৯ রানের বিশাল জয়ে ওয়ানডে সিরিজ শুরু, এই জয়েই ২০১৭তে অনুষ্ঠেয় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার টিকিট অনেকটাই নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়ের দশম পূর্তির দিনটি দারুন এক জয়ে উদযাপনও যে করতে পেরেছে বাংলাদেশ। ম্যাচটি বাংলাদেশ বনাম ভারত, না ভারত বনাম মুস্তাফিজুর হয়ে পড়েছেÑফলো থ্রুতে দাঁড়িয়ে থাকা মুস্তাফিজুরকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে সে প্রশ্নেরই যে জন্ম দিয়েছেন ভারত অধিনায়ক ধোনী। প্রশ্নটা রেখেছেন মুস্তাফিজুর পরবর্তী ম্যাচেও বড় ব্যবধান তৈরি করে। দ্বিতীয় ম্যাচে আরো ভয়ংকর ( ১০-০-৪৩-৬) ! এবং তার উপর্যুপরি এমন পারফরমেন্সে ভারতের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব বাংলাদেশের ! ওয়ানডে অভিষেকে ৫ উইকেটে প্রথম বাংলাদেশী, ক্যারিয়ারের প্রথম ২ ম্যাচে ৫টি করে উইকেটে জিম্বাবুয়ের ব্রায়ান ভিটরীর রেকর্ডকে ছ্ুঁয়ে ফেলা মুস্তাফিজুরের অভিষেক ওয়ানডে সিরিজটি আবার বিশ্বরেকর্ড। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ১৩ উইকেট যে নেই অন্য কারো।
হাতে যাদু আছে, বিসিএল থেকে উড়িয়ে এনে নেট বোলার মুস্তাফিজুরের একটার পর একটা কাটারে মুগ্ধতা এতোটাই ছড়িয়েছিল যে, পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-২০তে নামিয়ে দিয়ে জুয়া খেলতে চেয়েছিলেন বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিক। সেই পুঁচকেই কি না মোহাম্মদ হাফিজ,আফ্রিদিদের মতো টি-২০ স্পেশালিস্টদের হতভম্ব করেছে ! ২০১৫ সালে বিশ্বকাপ উত্তর বাংলাদেশ ওয়াানডে হোমে ভয়ংকর রূপ ছড়িয়ে র‌্যাংকিংয়ে ৯ নম্বর থেকে ৭ নম্বরে লাফিয়ে উঠেছে, এমন গৌরবান্বিত অধ্যায়ের নেপথ্যে মুস্তাফিজুর কৃতি।
ক্যারিয়ারে ১১ মাসে ( ২৪ এপ্রিল-২৬ মার্চ) তিন ভার্সনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৫২টি উইকেট ( টেস্টে ৪টি, ওয়ানডেতে ২৬টি, টি-২০তে ২২টি)Ñএমন পারফরমেন্স বিস্ময়কেও মানাবে হার। কাটার অস্ত্রের সঙ্গে শ্লোয়ার বিষ, ভয়ংকর সব ডেলিভারীতে এতোটাই বিস্ময় ছড়াচ্ছেন যে, বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে ভারতের অভিজ্ঞ বাঁ হাতি পেস বোলার আশিষ নেহরা পর্যন্ত গড গিফটেড বোলার বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন মুস্তাফিজুরকে। প্রিয় ভেন্যু চিন্নাস্বামীতে ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিতে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিলেন রোহিত শর্মা। সেই লাকি ভেন্যুতে রোহিত মুস্তাফিজুরের কাঁটারে করেছেন আত্মসমর্পন। জানেন, ওয়ানডে এবং টি-২০ মিলে সর্বশেষ ৬ ইনিংসে ৪ বারই তিনি পর্যুদস্ত এই বাঁ হাতি পেসারের কাছে ! তাসকিন, আরাফাত সানিকে অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের অভিযোগে আইসিসি নিষিদ্ধ করায় উপায়ন্তর না দেখে আনফিট মুস্তাফিজুরকে একাদশে নামিয়ে দিতে হয়েছে বাংলাদেশ টীম ম্যানেজমেন্টকে। সেই ছেলেটিই কি না টি-২০ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিজের অভিষেকে ছড়িয়েছেন দ্যুতি ! অফ স্ট্যাম্পের উপরের বলকেও অনায়াসে ফ্লিক শট নিতে দক্ষ অজি অধিনায়ক স্টিফেন স্মিথ, মুস্তাফিজুরের লেগ স্ট্যাম্পের উপরের পিচিং ডেলিভারীতে ফ্লিক শট নিয়ে সেই বাহাদুরিই জাহির করতে চেয়েছিলেন। অথচ দেখতে হলো তাকে লেগ স্ট্যাম্প উড়ে যাওয়ার দৃশ্য ! এমন ডেলিভারী যে কল্পনায়ও ভাবেননি তিনি। কোলকাতার ইডেন গার্ডেনসে নিউজিল্যান্ড ব্যাটসম্যানদের যে আরো বেশি বোকা বানিয়েছেন মুস্তাফিজুর। শ্লোয়ার কাটার না বুঝতে পেরে নিকলসের অফ স্ট্যাস্প গেছে উড়ে, কেন উইলিয়ামসের মতো প্রতিষ্ঠিত কিউই ব্যাটসম্যানও দেখলেন অফ স্ট্যাম্প উড়ে যাওয়ার দৃশ্য ! টি-২০ বিশ্বকাপে এক ম্যাচে ৫ উইকেটে আসর সেরা বোলিং (৫/২২), এমন রেকর্ডেও যে বাংলাদেশকে আলোচনায় আনলো ২০ বছরের ছেলেটি ! এক বছরে ৯ ওয়ানডে ম্যাচে ২৬ উইকেটে আইসিসি’র বর্ষসেরা ওয়ানডে দলে পেলেন জায়গা, টি-২০ বিশ্বকাপের নির্বাচিত সেরা স্কোয়াডেও রাখতে হলো মুস্তাফিজুরকে !
মাত্র ক’মাসে জাত চেনানোয় আইপিএলএ’র দল সানরাইজার্স হায়দারাবাদে ১ কোটি ৪০ লাখ রূপীতে হয়েছেন বিক্রি। নিলামে বেজ প্রাইসের ১২ গুন দরে বিক্রি হয়ে ( ৬ লাখ ডলার) আইপিএলে এক ম্যাচের বেশি খেলার সুযোগ পাননি মাশরাফি, রাজ্জাক,আশরাফুলদের ও একই পরিনতি বরন করতে হয়েছে। তামীমের মতো টপ অর্ডার আইপিএলে খেলার সুযোগই পাননি। কোলকাতা নাইট রাইডার্সের ঘরের ছেলে এখন সাকিব, আইপিএলএ শাহরুখ খানের দলের ট্রফি জয়ের এই নায়ককে পর্যন্ত অভিষেকের প্রতীক্ষা বেড়েছে। সেখানে ব্যতিক্রম মুস্তাফিজুর। ঢাকা থেকে হায়দারাবাদে দলের বেজ ক্যাম্পে যোগ দিয়েই পেয়েছেন ম্যাচে খেলার গ্রীন সিগন্যাল। নেটে একটার পর একটা কাটারে সানরাইজার্স ব্যাটসম্যানরা যখন পর্যুদস্ত, তখন মুস্তাফিজুরই যে টম মুডির তুরুপের তাস। সানরাইজার্স হায়দারাবাদের প্রথম ম্যাচেই তিনি অটোমেটিক চয়েস। অকশন টেবিলে টম মুডি, ভি ভি এস লক্ষন মুস্তাফিজুরকে ডেকে যে ভুল করেননি, প্রথম ম্যাচেই যে জানিয়ে দিয়েছেন তা মুস্তাফিজুর (২/২৬)। তিন ভার্সনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সব ক’টির অভিষেকেই ছড়িয়েছেন দ্যুতি। আইপিএলও তা বিদ্যমান। টি-২০ বিশ্বকাপে মাত্র ৩ ম্যাচে ৯ উইকেট, সংক্ষিপ্ত ভার্সনের ক্রিকেটে ডট বলে বাহাদুরি প্রকাশ পায় বোলারদের। সেখানে বিশ্বমঞ্চে সেরার লড়াইয়ে ৭২ ডেলিভারীর ৩২টিই ডট ! উইকেট পিছু খরচা মাত্র ৯.৫৫ ! বাঁ হাতি পেস বোলিং এমনিতেই ব্যাটসম্যানদের ভোগায় অস্বস্তি। সেখানে নুতন মাত্রা যোগ করেছেন মুস্তাফিজুর। ক্রিকেট বিশ্বে এখন একটাই গবেষনা, ‘ মুস্তাফিজুরের কাটার’।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Suma Islam Maria ১৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১০:২৮ এএম says : 1
ছেলেটা বাংলাদেশের গর্ব ।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন