পবিত্র কোরআনে তাই ঘোষণা এসেছে ‘আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি ও তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে নয়নাভিরাম সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উদগত করেছি। আর আমি আকাশ থেকে কল্যাণময় বৃষ্টিবর্ষণ করি এবং এর দ্বারা উদ্যান ও পরিপক্ব শস্যরাজি উদগত করি, যেগুলোর ফসল আহরণ করা হয়। ’ (৫০ : ৭-৯)
পরিবেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রেখে কীভাবে সুন্দরভাবে জীবনযাপন ও কল্যাণ অর্জন করা যায়, তার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি পরিবেশকে সুন্দর ও দূষণমুক্ত রাখার প্রতি ছিলেন খুবই যত্মবান। তিনি বলেন, ‘কোনো মুসলমান যদি একটি বৃক্ষের চারা রোপণ করে অথবা ক্ষেতখামার করে, অতঃপর তা মানুষ, পাখি বা কোনো জন্তু তা ভক্ষণ করে, তাহলে তার জন্য রয়েছে সদকার সওয়াব।’ (বুখারি) গাছ লাগানোর প্রতি মুসলমানদের উৎসাহ প্রদান করে তিনি বলেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে, কেয়ামত এসে পড়েছে আর তখন যদি হাতে একটি গাছের চারা থাকে যা রোপণ করা যাবে, তবে সেই চারাটি লাগাবে।’ (বুখারি)।
অপ্রয়োজনে গাছ না কাটতে রাসূলুল্লাহর স. নির্দেষ: আমরা জানি, গাছ মানুষ ও পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু। সবুজ গাছপালার ওপরই নির্ভর করে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর টিকে থাকা। এই গাছ ইচ্ছে হলেই কাটা যাবে না। কারণ ‘গাছের প্রাণ আছে’- এটা হাদিসের বাণী। হাদিসে রাসূল (সা.) থেকে জানা যায়, এক লোক অকারণে একটি গাছের ডাল ভাংলে নবী করিম (সা.) সে লোকটির চুল মৃদুভাবে টান দিয়ে বলেন, তুমি যেমন শরীরে আঘাত পেলে ব্যথা পাও, গাছের পাতা বা ডাল ছিঁড়লে গাছও তেমন ব্যথা পায়।
অপ্রয়োজনে বৃক্ষ নিধন করা থেকে কঠোরভাবে বারণ করে তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি (বিনা প্রয়োজনে) গাছ কাটবে আল্লাহ তার মাথাকে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন।’ (আবু দাউদ : ৫২৪১)। মুতার যুদ্ধে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর বাহিনীকে নির্দেশ দেন, ‘তোমরা কোনো নারীকে হত্যা করবে না, অসহায় কোনো শিশুকেও না; আর না অক্ষম বৃদ্ধকে। আর কোনো গাছ উপড়াবে না, কোনো খেজুর গাছ জ্বালিয়ে দেবে না। আর কোনো গৃহও ধ্বংস করবে না।’ (মুসলিম : ১৭৩১)। আবু বকর (রা.) সেনাপতি উসামা ইবনে জায়েদ (রা.) এর উদ্দেশে ১০টি উপদেশ দিয়েছিলেন। তন্মধ্যে তিনি বলেন, খেজুর গাছ কাটবে না কিংবা তা জ্বালিয়েও দেবে না। কোনো ফলবতী গাছ কাটবে না। আহারের প্রয়োজন ছাড়া কোনো ছাগল, গরু বা উট জবাই করবে না। এই অমূল্য উপদেশগুলো পরিবেশ রক্ষা ও সংরক্ষণের বিধানকে অন্তর্ভুক্ত করে।
গাছের উপকারিতা: গাছবিহীন এক মুহূর্তও আমরা কল্পনা করতে পারি না। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শাস্ত্র-পুরাণ, নীতিকথা, বাণিজ্য, দর্শন, শিল্প-সংস্কৃতি, আশ্রয়-প্রশান্তি এবং যাপিত জীবনের সব কিছুই গাছকে ঘিরে ও গাছকে নিয়ে। গাছ নিহত হলে গাছ শুধু একাই মরে না। মানুষসহ সব প্রাণসত্তার জন্যই তা ঝুঁকি ও উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটি পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষ বছরে যে পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করে তা কমপক্ষে ১০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা মেটায়। ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টি এম দাস ১৯৭৯ সালে পূর্ণবয়স্ক একটি বৃক্ষের অবদান আর্থিক মূল্যে বিবেচনা করে দেখান যে ৫০ বছর বয়সী একটি বৃক্ষের অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় এক লাখ ৮৮ হাজার মার্কিন ডলার (সূত্র : ইন্ডিয়ান বায়োলজিস্ট, ভলিয়ম-১১, সংখ্যা-১-২) টি এম দাসের হিসাবে, ৫০ বছর বয়সী একটি বৃক্ষ বছরে প্রায় ২১ লাখ টাকার অক্সিজেন সরবরাহ করে। বছরে প্রাণিসম্পদের জন্য প্রোটিন জোগায় এক লাখ ৪০ হাজার টাকার।
ইসলামে ফলদ বৃক্ষ রোপনের প্রতি উৎসাহ প্রদান: ইসলামে হালাল জীবিকা উপার্জন ও জনকল্যাণমূলক বিষয় হিসেবে কৃষিকাজ তথা ফলবান বৃক্ষরোপণ ও শস্যবীজ বপনের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে প্রকৃতির যতগুলো নিয়ামত দান করেছেন, তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে বৃক্ষরাজি। সৃষ্টিকুলের জীবন-জীবিকা ও বৃহৎ কল্যাণের জন্য গাছপালা, বৃক্ষলতা এবং মৌসুমি ফল-ফসলের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
মহান আল্লাহর সৃষ্টি বৃক্ষরাজি যে কত বড় নিয়ামত পবিত্র কোরআনে একাধিক আয়াত থেকে তার প্রমাণ প্রতীয়মান। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে ‘তারা কি লক্ষ করে না? আমি উর্বর ভূমির ওপর পানি প্রবাহিত করে তার সাহায্যে উদগত করি শস্য, যা থেকে তাদের গবাদি পশু এবং তারা নিজেরা আহার গ্রহণ করে। ’ (৩২ : ২৭)
মানুষের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণ, পুষ্টিকর ফলমূল, খাদ্যদ্রব্যের উপকারিতা ও স্বাস্থ্য সচেতনতার বিষয়ে ইসলামে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। মানবদেহের জন্য খাদ্য হিসেবে বৃক্ষের ফলমূল বিশেষ উপকারী, তাই আল্লাহ এটিকে সৃষ্টির প্রতি বিশেষ নিয়ামত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ ব্যাপারে ঘোষণা এসেছে ‘তিনি তোমাদের জন্য বৃষ্টির দ্বারা উৎপাদন করেন ফসল, জয়তুন, খেজুর, আঙুর এবং সর্বপ্রকার ফলমূল। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীলদের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’ (১৬ : ১১)
ইসলামে ফলদ বৃক্ষরোপণ ও ফসল ফলানোকে সবিশেষ সওয়ারের কাজ হিসেবে সদকায়ে জারিয়া বা প্রবাহমান দানরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কেননা ব্যক্তি যদি একটি বৃক্ষরোপণ ও তাতে পরিচর্যা করেন, তাহলে ওই গাছটি যত দিন বেঁচে থাকবে এবং মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তু যত দিন তার ফল বা উপকার ভোগ করতে থাকবে, তত দিন ওই ব্যক্তির আমলনামায় পুণ্যের সওয়াব লেখা হতে থাকবে। সদকায়ে জারিয়ার জন্য ছায়াদানকারী ফলবান বৃক্ষই তুলনামূলক বেশি উপকারী। (হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত) এমনিভাবে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বৃক্ষরোপণের প্রতি মানুষকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। একদা নবী করিম (সা.) হজরত সালমান ফারসি (রা.)-কে মুক্তির জন্য তাঁর মালিকের কাছে গেলেন। মালিক মুক্তিপণ হিসেবে ১০০ খেজুর গাছ রোপণের শর্তারোপ করলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাতে রাজি হলেন এবং নিজ হাতে ১০০ খেজুর গাছের চারা রোপণ করে তাঁকে মুক্ত করলেন।
ইসলামে কৃষি জমি চাষাবাদ: ইসলাম জমির উর্বরতা ও তার ফসল দান ক্ষমতা বিনাশকারী প্রতিটি পদক্ষেপ থেকে সতর্ক করেছে। জমির উর্বর শক্তি বৃদ্ধির জন্য ইসলাম যেসব কর্মকান্ডে উদ্বুদ্ধ করেছে তার অন্যতম হলো কৃষি কাজ, যা পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষার মৌলিক উৎস। ইসলাম একে স্বতন্ত্র গুরুত্ব দিয়েছে এবং একে ইবাদত হিসেবে গণ্য করেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সাগ্রহে কৃষি কাজ ও বৃক্ষ রোপণে উদ্বুদ্ধ করেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মৃত (অনাবাদী) ভূমিকে জীবিত (চাষযোগ্য) করবে, সেটা তারই জন্য।’ (আবু দাউদ : ৩০৭৫; মুসনাদ আহমাদ : ১৪৩১০)।
পরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ন: বিশ্বব্যাপী মানুষই শিল্পায়ন ও নগরায়ণের আড়ালে প্রাকৃতিক পরিবেশ তুলনামূলক নষ্ট করছে বেশি। শিল্পায়নের যুগে কল-কারখানার নির্গত কালো ধোঁয়া একদিকে যেমন বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বাড়িয়ে জীবনকে করে তুলছে দুর্বিষহ। অন্যদিকে কতেক কল-কারখানার নির্গত শিল্পবর্জ্য পানিতে মিশে পানিকে করছে দূষিত, যা মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও মৎস্য প্রজাতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী ‘আবু আলী ইবন সিনার’ উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘পৃথিবীর এত ধূলি, ধোঁয়া ও গ্যাস যদি মানুষের ফুসফুসে না ঢুকত, তাহলে মানুষ হাজার বছর ধরে সুস্থ অবস্থায় জীবিত থাকত। ’ এমনিভাবে নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রভাবে প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য পাহাড়-পর্বত বিরান ভূমিতে এবং বনভূমি প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে। মূলত মানুষ অবিবেচকের মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার পরিবেশগত বিপর্যয়কে আরো বেশি ত্বরান্বিত করেছে। তা ছাড়া পরিবেশবাদীরা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা চিহ্নিত করতে গিয়ে প্রথমেই প্রাকৃতিক পরিবেশের দূষণকেই দায়ী করছেন। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পিত নগরায়ণ এবং পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নই পারে আমাদের প্রাণসত্তার লীলাভূমি প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন