বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

লুটেরা-দালালদের দৌরাত্ম্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০১৮, ১২:০২ এএম

ব্রিটিশ ভারত থেকে পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ। অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু শোষণ ও নির্যাতনের পরিবর্তন হয় নাই, পরিবর্তনের মধ্যে হয়েছে পদ্ধতির। লুটেরারা জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তাদের নিজস্ব পন্থায় যার গতি পূর্বের চেয়ে কম অনেক বেশি। ব্রিটিশরা এ দেশে এসেছিল লুট করার জন্য। তারা সফল হয়েছে। লুটকে গতিশীল করতে দেশীয় যে দালালদের সহযোগিতা নিয়েছিল তারা তাদেরও ভাগ্যের উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু ছিন্নমূল হয়ে থেকে গেছে এ দেশের সাধারণ জনগণ, যারা দিন দিন গরিব হয়েছে। বাংলার সম্পদ লুণ্ঠনে ইংরেজরা একা ছিল না। তাদের পাশে ছিল এ দেশীয় দালাল, গোমস্তা ও বেনিয়া গোষ্ঠি। ঊংংধুং ড়হ খড়ৎফ পষরাব বইতে লর্ড মেকেল লিখেছেন যে, ‘কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের প্রভূ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য নয়, নিজেদের জন্য, প্রায় সমগ্র অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ওপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। দেশি লোকদেরকে তারা অত্যন্ত কম দামে উৎপন্ন দ্রব্য বেচতে এবং অন্যদিকে খুবই চড়া দামে বিলাতী পণ্য কিনতে বাধ্য করতো। কোম্পানি তাদের অধীনে একদল দেশি কর্মচারী নিয়োগ করতো। এই দেশীয় কর্মচারীরা যে এলাকায় যেতো, সে এলাকা ছারখার করে দিতো। সেখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতো। ব্রিটিশ কোম্পানির প্রতিটি কর্মচারী ছিল তার উচ্চপদস্থ (ইংরেজ) মনিবের শক্তিতে বলিয়ান। আর এই মনিবদের প্রত্যেকের শক্তির উৎস ছিল খোদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। (তাদের ব্যাপক লুণ্ঠন ও শোষণের ফলে) শীঘ্রই কলকাতায় বিপুল ধন-সম্পদ স্ত‚পীকৃত হলো। সেই সাথে তিন কোটি মানুষ দুর্দশার শেষ ধাপে এসে দাঁড়ালো। বাংলার মানুষ শোষণ ও উৎপীড়ন সহ্য করতে অভ্যস্থ একথা ঠিক, কিন্তু এ ধরনের (ভয়ংকর) শোষণ ও উৎপীড়ন তারাও কোনদিন দেখেনি’ (সূত্র: সুপ্রকাশ রায় প্রণীত ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রার্ম, পৃ. ১০)।
ঘুষের প্রচলন যে ব্রিটিশ আমল থেকেই শুরু হয়েছিল তা ১৭৭৩ সনে ঋড়ঁৎঃয চধৎষরধসবহঃধৎু জবঢ়ড়ৎঃ (পৃষ্ঠা ৫৩৫) এ উল্লেখিত মন্তব্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ‘উৎকোচ নামক দুর্নীতি এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যাপকভাবে আমদানী করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত মাত্র দশ বছরে ষাট লাখ পাউন্ড আত্মসাত করেছিল।’
‘ব্যবসায়ের নামে ইংরেজ বণিক কোম্পানির এই দস্যুতার মুখে বহু শিল্প কারিগর উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য নিজেদের বুড়ো আঙ্গুল কেটে ফেলে অসহনীয় উৎপীড়ন থেকে বাঁচার চেষ্টা করে। অনেকে বাড়ী-ঘর ছেড়ে বন-জঙ্গলে পালিয়ে যায়। ১৭৫৮ থেকে ১৭৬৩ এই ছয় বছরে কৃষকদের সাথে কারিগরদের একটি অংশ স্থায়ী বেকারে পরিণত হয়। ইংরেজ লেখক রেজিনাল্ড রেনল্ডস উল্লেখ করেছেন, ঐ সময়ের মধ্যে ঢাকার বিশ্বখ্যাত মসলিনের এক তৃতীয়াংশ কারিগর ইংরেজ বণিকদের শোষণ-পীড়নে অস্থির হয়ে বনে-জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল’ (সূত্র: রেজিনাল্ড রেনল্ডাস প্রনীত সাহিবস ইন ইন্ডিয়া, পৃ. ৫৪)।
দেশীয় দালাল সৃষ্টির মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশসহ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলি শাসন-শোষণের মাধ্যমে লুণ্ঠন করে ব্রিটিশরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে। পদলেহীদের ব্যবহারের জন্য তারা বিভিন্ন উপাদি যেমন- স্যার, খানবাহাদুর, রায় বাহাদুর প্রভৃতি দিয়ে স্থানীয় একটি অভিজাত শ্রেণি সৃষ্টি করে, যাতে তাদের শাসন-শোষণ সহজ ও স্থায়ী হয়। যাদের আমরা একনামে সম্মান করি তাদের অনেকের ইতিহাস খুবই বিতর্কিত যা জানতে পারলে তাদের প্রতি সম্মান বোধটুকু থাকে না।
এ বিষয়ে গোলাম আহমাদ মোর্তজা প্রণীত ‘বজ্রকলম’ বইতে (পৃষ্ঠা ১৩৫) স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে লেখা হয়েছে, ‘ভারতের হিন্দু-মুসলমান যখন বৃটিশের মার খাচ্ছে, গুলি খাচ্ছে ও ফাঁসিতে যাচ্ছে তখন বৃটিশ-বিরোধী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন ভ‚মিকাই ছিল না তাঁর। যখন বিচারপতিদের কাঁধে বন্দুক রেখে বিচারের প্রহসনে বৃটিশ সর্বনাশ করত ভারতীয়দের, সেই সময় আশুতোষকেও করা হয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। সুতরাং তাঁর যোগ্যতা ও বিশ্বাসভাজনতার প্রতি বৃটিশের ছিল অগাধ বিশ্বাস। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরও হয়েছিলেন চারবার। ‘রাঁয়চাদ প্রেমচাঁদ’ পুরষ্কারও পেয়েছিলেন তিনি। লর্ড লিটন তাঁকে দিয়েছিলেন ‘টাইগার অব বেঙ্গল’ উপাধি। তাঁর ধারাবাহিক কর্ম, যোগ্যতা ও বিচারকার্যে খুশী হয়ে সরকার তাঁকে দিয়েছিল স্যার উপাধি।’
উক্ত বইতে ভারতে ধনীক শ্রেণি কর্তৃক ব্রিটিশদের মনরঞ্জনের একটি চিত্র ফুটে উঠে। লেখক লিখেছেন, ‘ঐ সমস্ত রাজা মহারাজা বাবু ও জমিদার ধনীরা প্রকাশ্যে বেশ্যাখানায় যেতে দ্বিধাবোধ তো করতেনই না, বরং প্রতিযোগিতা করে বাহাদুরি দেখাতেন তাঁরা। সেই সময় নাচে গানে পটু বেশ্যাদের একটা সম্মানীয় নাম ছিল ‘বাঈজী’। ঐ সুন্দরী বেশ্যা-বাঈজীর মধ্যে যারা ছিল খুব খ্যাতনামা তাদের নাম নিকি, সুপন, বকনাপিয়ারী, হিঙ্গুল প্রভৃতি। ঐ বাবু ও জমিদারেরা এদের ভাড়া করে আনতেন। নাচ, গান, বাজনা আর খাওয়া দাওয়ার সঙ্গে বাজী পোড়ানো এবং আরও কুৎসিত আমোদ প্রমোদের উৎসব চলতো ঢালাওভাবে। বাড়ির এই উৎসবে ইংরেজ (বৃটিশ) মনিবদের নেমতন্ন করা হতো।’
ব্রিটিশদের ‘সাহেব’ বানিয়েছে এদেশের দালালরা যারা ছিল ধনী শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তী পর্যায়ে ব্রিটিশরা ভারত ছাড়তে বাধ্য হলে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। কিন্তু এখানে দালাল শ্রেণিরাই সরকারি, আধা সরকারি সব সেক্টরকে লুটে খাচ্ছে। ভবিষ্যতে ইতিহাসের পাতায় এরা কোন শ্রেণিভুক্ত হবে তা জানি না, তবে এখন দালাল না বলে সরকারি দলীয় লোক হিসেবে পরিচয় দিতে তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বলা হচ্ছে যে, দেশে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেয়েছে, দেশ মধ্য আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, কিন্তু এখনো দেখা যাচ্ছে যে, জাকাতের টাকা আনতে যেয়ে পদদলিত হয়ে মানুষের মৃত্যু, বেকারত্বের কারণে নৌকায় বিদেশে পাড়ি দেয়ার সময় সাগরে বাংলাদেশির মৃত্যু, কাঙ্গালী ভোজে অংশ গ্রহণ করতে যেয়েও গরিব মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
সরকার একদিকে বলছে যে, ফসলী জমি নষ্ট করা যাবে না, পরিবেশ ধ্বংস করা যাবে না। অথচ ভ‚মি দস্যুদের কারণে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে, জমি হারাচ্ছে কৃষক সমাজ। ব্রিটিশের মতই এলাকায় এলাকায় দালাল শ্রেণি করে নদীতে ড্রেজার লাগিয়ে জোরপূর্বক বালি দ্বারা কৃষি ফসলী জমি ভরাট করছে আবাসন প্রকল্পের নামে। অথচ আবাসন প্রকল্প করার জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে কোন ছাড়পত্র গ্রহণ করে না। ভূমিদস্যুরা কৃষকদের নিকট থেকে জমি ক্রয় করে না, এক অথবা দেড় বছরের জন্য ভাড়া নিয়ে আবাসন প্রকল্পের নামে সাইনবোর্ড স্থাপন করে বালু ভরাট শুরু করে। এ দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করার দায়িত্ব যাদের (অর্থাৎ স্থানীয় জন প্রতিনিধি, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন প্রভৃতি) তারা ভ‚মিদস্যুদের অর্থিক প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে নিরব দর্শকের ভ‚মিকা পালন করছে, অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পরিবেশ, ফসলী জমি ও কৃষক, জমির মালিক প্রমুখ।
সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ‘নারায়নগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে রূপগঞ্জে কৃষিজমি কমেছে ২ হাজার ১৬০ হেক্টর (আড়াই একরে এক হেক্টর)। ২০০৮ সালেও এলাকায় কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৬১০ হেক্টর। এখন আছে ১১ হাজার ৪৫০ হেক্টর। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কৃষিজমি ও জলাশয় কমে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বর্গাচাষি ও জেলেরা। তাঁরা বেকার হয়ে পড়ছেন। অন্যের সহায়তা এবং দিনমজুরের কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছেন অনেকে। রূপগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. তাজুল ইসলামের বক্তব্য মতে, ১০ বছর আগে রূপগঞ্জে কৃষক পরিবার ছিল ৪৪ হাজার ৬৪২টি। এখন ২২ হাজার ১১৬টি। সমীক্ষায় দেখা যায় যে, নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে রাজউকের পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের জন্য রূপগঞ্জে দেড় হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে। এরপর এখানে জমি বেচাকেনা বেড়ে যায়। ফলে প্রতিবছরই কৃষিজমি কমছে। কৃষিজমির মতো রূপগঞ্জে মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণও অস্বাভাবিক পরিমাণে কমছে। ভরাট হচ্ছে খালবিল, গড়ে ইঠছে আবাসন প্রকল্প। ২০০৮ সালে পুকুর ও দীঘি ছিল ১ হাজার ৪২৪টি। এখন রয়েছে ৯০০টি। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সমীর চন্দ্র বসাকের বক্তব্য মতে, মুক্ত জলাশয় কমে যাওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া মাছের উৎপাদন কমে গেছে। গত ১০ বছরে বেকার হয়েছে ৫৫৪ জেলে।’ এ মর্মে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে রূপগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান বলেছেন যে, ‘কৃষি ও জলাভ‚মি হারিয়ে যাচ্ছে আবাসন কোম্পানিগুলোর কারণে। তারা ম্যাসেলম্যান পোষে। একটি জমির পাঁচজন অংশীদারের একজনকে কিছু টাকা দিয়ে পুরো জমি দখল করে নিচ্ছে অনেক কোম্পানি। তাদের শক্তি ও টাকার কাছে জনপ্রতিনিধিরাও অসহায়।’ এই ম্যাসেলম্যানরাই এখন দালালের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়ে লুটেরা ভ‚মিদস্যুদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। আর সরকারি দলের লোক ছাড়া এ দেশে ম্যাসেলম্যান হওয়া যায় না। পুলিশ যাকে সালাম দেয় সেই ম্যাসেনম্যান এবং এ জন্যই সরকারি দলের লোক হওয়া চাই।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন