ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ঘিরে বেশ কয়েকটি দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব দালালের হাতে জিম্মি রোগী ও তাদের স্বজনেরা। তবে গতকাল দালাল নির্মূলে অভিযান চালিয়ে ২৪ জনকে গ্রেফতার করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দিয়েছেন র্যাব-৩-এর ভ্রাম্যমাণ আদালত।
হাসপাতাল সূত্রে ও রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দালালদের উৎপাত নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। হাসপাতালে গেলেই চোখে পড়ে দালালদের রোগী নিয়ে টানাটানির দৃশ্য। তাদের বাধা টপকে হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে কোনো রোগীর পৌঁছানো কষ্টের ব্যাপার। জোর করেই তারা রোগীদের নিজেদের পছন্দের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে নিয়ে যেত চায়। আর রোগীরা কোনোমতে সরকারি এই হাসপাতালের চিকিৎসকের কক্ষে পৌঁছালেও নিস্তার নেই। চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হলে আরেক দফা টানাটানি শুরু হয়। এবার টানাটানি ব্যবস্থাপত্রে লেখা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। দালালদের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হয়।
সম্প্রতি হাসপাতাল ও আশপাশের এলাকা ঘুরে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। ঢামেকের জরুরি বিভাগে ঢোকার প্রধান ফট থেকে হাসপাতালে ভেতরে দালাল চক্রের সদস্যরা প্রকাশ্যেই ঘুরাফেরা করে। এছাড়া হাসপাতালের আশপাশের ওষুধের দোকান ও খাবারের দোকানগুলোতে ওই চক্রের সদস্যরা শকুনির দৃষ্টি নিয়ে বসে থাকে। রোগী আসামাত্র তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে।
তবে ওই চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে অভিযান চালিয়েছে র্যাব ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে ২৪ জন দালালকে হাতেনাতে গ্রেফতার হয়। তাদের প্রত্যেককে এক মাস করে কারাদন্ড দিয়েছেন অভিযান পরিচালনাকারী র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত প্রায় তিন ঘণ্টার এ অভিযানে ম্যাজিস্ট্রেট, র্যাব ও হাসপাতালের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ঢামেক হাসপাতালে দালালচক্রের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
অভিযান শেষে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ অভিযান পরিচালিত হয়। এই দালালরা ঢামেক হাসপাতালে আসা নিরীহ রোগীদের সরকারি হাসপাতালের চেয়েও কম খরচে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও খ্যাতনামা অধ্যাপকদের দিয়ে দ্রæত অস্ত্রোপচারের সুব্যবস্থা করে দেয়ার কথা বলে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যেত। হাতেনাতে গ্রেফতারের পর তারা সবাই অভিযোগ স্বীকার করেছেন বলে জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢামেক হাসপাতাল-১, ২ এবং বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটকে ঘিরে সংঘবদ্ধ দালালচক্র গড়ে উঠেছে। কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এ দালাল চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ছোট বড় ও নামসর্বস্ব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কার্ড, সিøপ প্যাড ইত্যাদি নিয়ে ঢামেকের জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ, ওটি, আইসিইউ, ওয়ার্ড এবং কেবিনের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা নিরীহ, দরিদ্র ও অসহায় যাদের বেশিরভাগ গ্রাম থেকে আসেন, চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানেন না তাদেরকে টার্গেট করে আপনজনের মতো ব্যবহার করে কম খরচে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অস্ত্রোপচার করিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখায়। অনেক সময় জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগ থেকে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যায় এসব দালালরা। আবার তারা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরেও রোগীদের টার্গেট করে। বিশেষ করে অস্ত্রোপচারের জন্য অপেক্ষমান রোগীদের কাছে গিয়ে অল্প টাকায় ভাল অধ্যাপক দিয়ে দ্রæত অস্ত্রোপচারের প্রলোভন দেখায়। অনেক সময় না বুঝে ফাঁদে পা দিয়ে তাদের সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে কম টাকা জমা দিয়ে ভর্তি হয়ে ফেঁসে যান। নানা উসিলায় রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ঢামেক হাসপাতালে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ থাকা সত্তে¡ও এসব দালালরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে দ্রæত রিপোর্ট করিয়ে দেয়ার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে থাকে। ঢামেক হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক ও নার্স জানান, এ সব দালালদের কারণে ঠিকমতো কাজও করা যায় না।
অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কর্তব্যরত আনসার সদস্যরা এ দালালচক্রের পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষক। দালালচক্রের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা নিয়ে হাসপাতালে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ করে দেন তারা। তবে অভিযানের পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দালালদের সঙ্গে হাসপাতালের কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অভিযানকে স্বাগত জানালেও কেউ কেউ বলছেন, দালালচক্রের চুনোপুঁটিরা ধরা পড়েছে। এদের মূল পৃষ্ঠপোষক কেউ ধরা পড়েনি।
অভিযানের বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আশরাফুল আলম বলেন, এতে করে হাসপাতালের কার্যক্রমের গতিশীলতা আরো বাড়বে। দালাল চক্রের সাথে হাসপাতালের কোন কর্মচারী কিংবা কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে ।
এদিকে, গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ২১২ নম্বর ওয়ার্ডে অবৈধভাবে প্রবেশ করায় পাঁচ নারীকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ২১২ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়ার্ড মাস্টার কাজী আবু সাইদ বলেন, আমার ওয়ার্ড থেকে পরিচালক স্যারের নির্দেশে তাদের আটক করেন আনসার সদস্যরা। পরে তাদের হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পে হস্তান্তর করা হয়। এ ঘটনায় পরিচালক স্যারের নির্দেশে বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করা হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন