২০০৯ সালের পর থেকেই পাসের হার ছিল উর্ধ্বমুখী। তবে গত দুই বছর ধরেই আবার তা নি¤œমুখী হতে শুরু করেছে। এক সময় এইচএসসি, আলিম ও সমমানের পরীক্ষার পাসের হার ৮০ ছাড়িয়ে ৯০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই ছিল। এখন তা ৬০ এর ঘরে। গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ ফলাফলের রেকর্ড হয়েছে এবার। একই সাথে পাল্লা দিয়ে কমেছে জিপিএ-৫ এর সংখ্যাও। পাসের হারের মতো এবার জিপিএ-৫ এর সংখ্যাও সর্বনি¤œ। পাসের হার কম ও জিপিএ-৫ এর সংখ্যা কম হলেও এটিকে ইতিবাচক হিসেবেই মনে করছেন শিক্ষামন্ত্রী, বোর্ড চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এক সময় শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজমুখী করাই আমাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানামুখী উদ্যোগের ফলে এখন ঝরে পড়া কমে গেছে। শিক্ষার্থীরা পড়াশুনায় আগ্রহী হয়ে ওঠেছে। তাই আমাদের সামনে এখন শিক্ষার গুণগত মানের চ্যালেঞ্জ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। মন্ত্রণালয় সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে। এজন্য খাতা মূল্যায়নে পরিবর্তন আনা হয়েছে। একাধিক পরীক্ষক দিয়ে খাতা মূল্যায়ন করা হচ্ছে। ফলে যে শিক্ষার্থী যেমন নম্বর পাওয়া দরকার তাই পাচ্ছে। তাই ফল কিছুটা খারাপ হয়েছে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন আর মান নিশ্চিত করতে গিয়েই পাসের হার কমে গেছে।
তারপরও খারাপ ফলের কারণ খুঁজছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। এজন্য বেশ কিছু কারণও চিহ্নিত করেছেন বোর্ড সংশ্লিষ্টরা। প্রথমত বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় ফল খারাপ করেছে। বিজ্ঞান বিভাগের মধ্যে পর্দাথ বিজ্ঞানের প্রথম পত্রের ফলাফল ছিল খারাপ। শুধু বিজ্ঞানে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডে এ বছর জিপিএ-৫ কমেছে ৭ হাজার ৭৩৬ জন। এটা সব বোর্ড ও সার্বিক ফল ও জিপিএ-৫ প্রভাব ফেলেছে। তবে সাধারণ ৮টি বোর্ডে ইংরেজি, বিজ্ঞান ও আইসিটি বিষয়ে পরীক্ষা কঠিন হওয়ার এ বিষয়গুলোতে খারাপ ফল হয়েছে। যারা প্রভাব পড়েছে সার্বিক ফলে।
ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কুমিল্লা ও মাদরাসা বোর্ড ছাড়া বাকী সব বোর্ডের বিজ্ঞানের ফল খারাপ হয়েছে। এজন্য প্রশ্ন কঠিন হওয়ারকে দায়ী করছে শিক্ষার্থী ও বোর্ডের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে আন্তঃশিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মু. জিয়াউল হক বলেন, বিজ্ঞানের সব কয়টি বিষয়ে পরীক্ষা কঠিন হয়েছে। একই সঙ্গে আইসিটি পরীক্ষা তুলনাম‚লক কঠিন হয়েছে। তিনি বলেন, শুধু ঢাকা বোর্ডের বিজ্ঞানে জিপিএ-৫ কমেছে ৭ হাজার ৭৩৬ জন। এটা পুরো জিপিএ-৫ কমার অন্যতম কারণ। এর ছাড়া চলতি বছর পরীক্ষা ব্যবস্থাাপনায় কঠিন, প্রশ্নফাঁসম‚ক্ত পরীক্ষা ও খাতা ম‚ল্যায়নে কঠোরতা এবার ফলাফল খারাপ হওয়ার অন্যতম কারণ। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর এ.কে.এম ছায়েফ উল্যা বলেন, এবার পরীক্ষায় পদ্ধতিতে কোন ক্রটি ছিল না। শতভাগ প্রশ্নফাঁসমুক্ত পরীক্ষায় হয়েছে। পরীক্ষকদের খাতা দেখায় কোন ধরনের গাফিলতি সহ্য করা হবে বলে সর্তক করে দেয়া হয়েছিল। সব মিলিয়ে কঠোর একটা ব্যবস্থাপনার মধ্যে পরীক্ষা হওয়ার এর কিছু প্রভাব ফলাফলে এসে পড়েছে। যদিও কঠোর পরীক্ষণ পদ্ধতির পরও মাদরাসা বোর্ডের পাসের হার বেড়েছে এবং ১০ বোর্ডের মধ্যে শীর্ষ স্থানে ওঠে এসছে।
বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকরা জানান, এবার পাসের হার কমার আরেকটি অন্যতম কারণ সিলেট ও যশোর উভয় শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার কমে গেছে প্রায় ১০ ভাগ। একই সঙ্গে উভয় বোর্ডেই জিপিএ ৫ এর সংখ্যা কমেছে। রাজশাহী ও দিনাজপুর বোর্ডে গত বছরের তুলনায় এবার পাসের হার কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ। এ চারটি বোর্ডে পাসের হার কমার কারণে সার্বিক ফলাফল কম হয়েছে। তবে মান রক্ষা করে বরিশাল ও কুমিল্লা বোর্ড। সাধারণ ৮টি বোর্ডের অন্যগুলোতে পাসের হার কমলেও বরিশাল বোর্ডে গত বছরের পাসের হার ৭০এর কোটা ধরে রেখেছে। কুমিল্লা বোর্ডে গত বছরের তুলনায় এবার পাসের হার বেড়েছে ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। এ বোর্ডের বাম্পার ফলাফল সব বোর্ডের ফলাফলের মান রক্ষা করেছে। গত বছর এ বোর্ডে পাসের হার ছিল ৪৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। এবার সেটি প্রায় ১৬ শতাংশ বেড়ে দাড়িঁয়ে ৬৫ দশমিক ৪২ শতাংশ।
বোর্ডগুলোর বিষয়ভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ইংরেজি বিষয়ে ১০টি বোর্ডের মধ্যে মাদরাসা ও সিলেট বোর্ড ছাড়া কোন বোর্ড পাসের হারে ৮০ কোটা পার হতে পারেনি। এরমধ্যে যশোর ও দিনাজপুর বোর্ডে পাস করেছে যথাক্রমে ৬৫ ও ৬৫ দশমিক ৫১ শতাংশ। এছাড়াও আইসিটি, পর্দাথ, রসায়ন ফলাফল অন্যান্য বছরের তুলনায় খারাপ হয়েছে।
বিজ্ঞানের ফল বিগত বছরের তুলনায় কিছুটা খারাপ হলেও এবার সার্বিক ফলাফলে মান রেখেছে এই বিভাগটিই। মানবিক বিভাগের বিপর্যয়ের মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগ পাসের হার দৃষ্টিকটু হতে দেয়নি। বিজ্ঞানে জোর দিতে গিয়ে মানবিকের ফল অপেক্ষাকৃত খারাপ হয়েছে বলে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, আমরা বিজ্ঞানে বেশি জোর দিতে গিয়ে মানবিকে ফল খারাপ হয়েছে। আর খাতা ভালো করে দেখার কারণেই এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ফল নিম্নমুখী। সব মিলিয়ে গুণগতমান ঠিক রাখতেই এ অবস্থা হয়েছে।
পাসের হার নিম্নমুখী স্বীকার করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘অন্যান্য দেশের তুলনায় সংখ্যায় আমরা বেশি এগিয়ে আছি। এখন আমরা গুণগত মানের দিকটায় গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা ক্লাস নেওয়া ও ভালোভাবে পরীক্ষা নেওয়ার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। ঠিকভাবে যেন খাতা দেখা হয়, সেদিকে নজর দিচ্ছি। যা বাস্তব, যা সত্য সেই ফল বেরিয়ে এসেছে। আমরা কাউকে নম্বর বাড়িয়ে দিতে বলি না, কমাতেও বলি না। আমরা শিক্ষকদের বাধ্য করছি সঠিক ম‚ল্যায়নের।
তারপরও সংশ্লিষ্ট বোর্ডগুলোও দেখবে, ম‚ল্যায়ন করবে। কেন খারাপ হলো, আমাদের বোর্ডগুলো দেখবে। প্রয়োজন হলে মন্ত্রণালয়গুলো দেখবে। আমরা সসমস্যা চিহ্নিত করবো বলেও জানান নাহিদ।
অন্য বছরের তুলনায় বিজ্ঞানে ফল বিপর্যয় নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমরা ভালো করে দেখে কারণ খুঁজে বের করবো। আগে গণিতে, ইংরেজিতে একজনও পাস করতো না। আমরা ‘সেকাপে’ প্রকল্পের মাধ্যমে আলাদা শিক্ষক দিয়ে আলাদা ক্লাস করিয়েছি। আস্তে আস্তে সবাই তারা পাস করছে। একটা দিকে বাড়াতে গেলে আরেকটা দিকে চাপ পড়ে। মানবিকের ফল বিপর্যয় নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এটা বলা কঠিন। পরে ম‚ল্যায়ন করে দেখবো। তুলনাম‚লকভাবে মেধাবীরা বিজ্ঞানে পড়াশোনা করছে। বিজ্ঞানে জোর দেওয়া যুক্তিযুক্ত। পাশাপাশি অন্যদিকে জোর দিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন