বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সোনালি আসর

আবু হাসান শাহীন

প্রকাশের সময় : ১৮ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মেলার খুশি হারিয়ে গেলো...
মোমিন মেহেদী

‘মায়াবী কিশোরের মতো সুদূর শৈশব তোমাকে ডাকলেও/ তুমি আর কোনোদিন তার কাছেও যেতে পারবে না, হায়...’ কবি বা ছড়াকার ছিলেন না আবু হাসান শাহীন। ছিলেন নিবেদিত সাংবাদিক, সম্পাদক, প্রকাশক ও সংগঠক। অনেক কথা না বলে অনেক কাজ করেছেন নিজের মতো করে। কাজ করতে করতে কখনো-সখনো ক্লান্তি এসে ভিড় জমালে তিনি নিজেই গেয়ে উঠতেন ঘুম ভাঙানি গান, সতেজ করে প্রাণ। পাশাপাশি সাহসের সাথে বলতেন সত্য, লিখতেন সত্য। যেমন তিনি লিখেছিলেন, এরশাদ সরকারের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সমস্যা নিয়ে ঠিক এভাবে ‘কী নিষ্ঠুর পরিণতি একদার ডাকসাঁইটে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের! নানা বদনাম ছিলো তার শেষ সঙ্গী। কিন্তু আমার কাছে তাকে একজন অভাবী মানুষ মনে হয়েছে। অভাবী না হলে কী বাংলাদেশের একজন রাজনীতিক অসুখে পড়লে ফ্রি চিকিৎসার আশায় অস্ট্রেলিয়া আসেন!’ এই অভাবে অভাবী ছিলেন না আবু হাসান শাহীন। তবে বলে রাখা ভালো যে, সাংবাদিক আবু হাসান শাহীন কখনোই কাউকে অর্থের মানদ-ে মাপেননি। বরং নিজের হাজারো সমস্যা থাকা সত্ত্বেও চেষ্টা করতেন সাধ্যমত বন্ধু, লেখকবন্ধু আর প্রিয় স্বজনদের পাশে দাঁড়াতে। অবশ্য সাংবাদিক আবু হাসান শাহীনের এই সততাকে কাজে লাগিয়ে আগাগোড়া সমানভাবে সুযোগ নিয়েছে বিভিন্ন মহল। বিশেষ করে দেশবিরোধী যুদ্ধাপরাধীচক্র তাদের ফুলকুঁড়ি, বিপরীত উচ্চারণসহ বিভিন্ন নামি বেনামি সংগঠন থেকে কর্মী তৈরি করে তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করিয়ে প্রমাণ করেছে যে, জামাত-শিবির-জঙ্গি সদস্যরাও লেখক হতে পারে। এই চক্রান্তে সবার আগে রয়েছে জাকির আবু জাফর, মনসুর, আবিদ আজম প্রমুখ। যারা লেখকের আড়ালে পুষে আছে স্বাধীনতাবিরোধী চেতনা। তারাই আসন গেড়ে বসেছিলো লোভহীন-মোহহীন এই মানুষটার চারপাশে। যে কারণে নতুন প্রজন্মের অনেক প্রতিনিধিকে কাঁদিয়ে আজ তিনি চলে গেলেও রয়ে গেছে ছাত্রশিবির-জামাত-জঙ্গিদের আসন। সে যাই হোক কথা বলছিলাম, ‘সাংবাদিক আবু হাসান শাহীন আর নেই’ শিরোনাম নিয়ে। আর এখানে উঠে এসেছে, রাজধানীর ডেমরা থানার কোনাপাড়ার বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। গত এক বছর ধরে দুরারোগ্য লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন শাহীন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৯ বছর। তিনি স্ত্রী ও এক ছেলে রেখে গেছেন।
তিনি ছিলেন অনেক কাজের কাজী। যখন মফস্বলে থাকতাম, তখন থেকেই তার নামের সাথে ছিলো পরিচয়। মাঝে মাঝে লিখেছি ছোটদের কাগজে। স্বাধীনতার পক্ষের রাজনীতি সচেতন নিপুন কারিগর ছিলেন তিনি। তার হাত দিয়ে সম্পাদিত হয়েছে ছোটদের পত্রিকা; প্রকাশিত হয়েছে শত শত বই। আর তারই সূত্র ধরে আবু হাসান শাহীন বাংলা নিউজ টোয়েন্টিফোর.কম-এর নিউজরুম এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিন বছর। অবশ্য অসুস্থতার কারণে তিনি স্বেচ্ছায় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছিলেন। এরও আগে তিনি ছিলেন দৈনিক ভোরের কাগজ ও দৈনিক দিনের শেষে পত্রিকার সহ-সম্পাদক। একজন নিখুঁত সংগঠক ছিলেন তিনি। খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটি ও ঢাকা মহানগর কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যতদিন কাজ করেছেন ততদিন তিনি সুনাম তো কুড়িয়েছেন-ই; পাশাপাশি সকল স্তরে ছিলেন নন্দিত।
আর তার প্রমাণ তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি, অধ্যাপিকা পান্না কায়সার, সাধারণ সম্পাদক আবুল ফারাহ পলাশ, ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি দৈনিক ভোরের কাগজ-এর সম্পাদক শ্যামল দত্তসহ অন্যান্য গুণীজনদের সমবেদনা প্রকাশ থেকেই বোঝা গেছে। তারপরও কিছু কথা রয়ে গেছে, আর তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- গণমাধ্যম, প্রকাশনা অঙ্গন এবং সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও শিশু-কিশোর আন্দোলনে তার ভূমিকা নতুন প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয় হয়ে থাকবে। যেভাবে আছে, আমার অনুজ তানজিল রিমন-এর কাছে। এক জীবনে একজন আবু হাসান শাহীন শুধু দিয়েই গেছেন। আর যারা তার সেই দিয়ে যাওয়া সময়-মেধা-শ্রমকে গ্রহণ করেছেন, তাদের তালিকায় আছেন, ছড়াকার ফারুক নওয়াজ, রহীম শাহ, ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, আহমাদ মাযহার, আমীরুল ইসলাম, কামাল হোসাইন, আশিক মুস্তফাসহ শতাধিক মানুষ। যারা নিতেই অভ্যস্ত দিতে নয়। যে কারণে হারাতে হলো আজ আবু হাসান শাহীনের মতো অবিরত কাজ করে চলা কর্মবীরকে। যারা এতো এতো সুবিধা নিয়েছে, এতো এতো পুরস্কার-বই-সম্মাননা নিয়েছে; তাদের অনেকেই এখন নতুন নতুন কয়েকদিন আহারে-উহুরে করবে; যেমন করেছে ওবায়দুল গণি চন্দনসহ অনেক প্রতিভাবান লেখক-সংগঠকের চলে যাওয়ার পর। যাদের যোগ্যতা থাকে না; তারা যোগ্যদেরকে মূল্যায়ন করতে জানে না। যে কারণে আবু হাসান শাহীনের যোগ্যতার দাম তিনি পাননি, চালিয়ে রাখতে পারেননি ছোটদের পত্রিকার মতো চমৎকার একটি কাজকেও। অবশ্য শিশুসাহিত্যিক আশরাফুল আলম পিনটু প্রায়ই বলতেন, ‘কি হবে এসব করে? দেশের মানুষ মূল্যায়ন করবে না, সাহিত্যিক মহল মূল্যায়ন করবে না।’ আজ যখন আবু হাসান শাহীন চলে গেলেন, তখন খুব বলতে ইচ্ছে করছে ‘চামচামিতে যারা সেরা/তারাই ছিলো কাছে/এখন যেমন কষ্ট দিনে/সব পালিয়ে আছে/সময়-সুযোগ আছে যাদের/তাদেরকে খুব বলি/আসুন সবাই মানুষ চিনে/মানুষ নিয়ে চলি/এতে করে ‘অমানুষ’ সব/বাদ পরবে বাদ/আটকাবে না যতই ফেলুক/নতুন নতুন ফাঁদ...’
তার কাজের প্রতি সবসময়ই ছিলাম শ্রদ্ধাশীল।
আজ যখন এই লেখা লিখছি, তখন ছোটদের মেলা পুরস্কার পাওয়া মানুষগুলোর মুখগুলো ভেসে উঠছে আর কানে বাজছে- চাই দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর হও, এগিয়ে যাও; কেননা, লেখক কখনো দুর্নীতি করে না। তুমিও করবে না...

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন