কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস বিভাগের স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুকে গত ২০ মার্চ রাতে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। তনু কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের ইয়ার হোসেনের মেয়ে। তনুর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। তনু হত্যার বিচারে দাবিতে উত্তাল দেশ। খুনির বিচারের দাবিতে দেশের প্রায় সকল সরকারি বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন, বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ চলছে তনু হত্যার পরদিন থেকেই।
গত ১ এপ্রিল টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে এক পোশাককর্মীকে গণধর্ষণ করে পরিবহন শ্রমিকরা। গত ৩১ মার্চ গাজীপুর থেকে খালার বাড়ি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী বেড়াতে যান ওই পোশাককর্মী। পরদিন ১ এপ্রিল সকালে গাজীপুরের উদ্দেশে যাওয়ার জন্য ধনবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে টিকেট কেটে বিনিময় পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন। এ সময় বাসটির চালক ও চার কর্মী ওই নারীকে একাই নিয়ে রওনা হন। পরে বাসের সব জানালা-গেট বন্ধ করে দিয়ে তার হাত-পা ও মুখ বেঁধে একে একে বাসের চালক ও অন্য তিনজন তাকে ধর্ষণ করে বাস থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে যান।
উল্লিখিত ২টি ঘটনার মতই প্রায় প্রতিদিনই নারীদের ওপর জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন, ধর্ষণ, হত্যা চলছে। দেশব্যাপী আলোচিত এইসব হত্যাকা- থেকে সহজেই অনুমেয় যে আমাদের মেয়েরা কতটা নিরাপত্তাহীন।
রাজধানীসহ সারাদেশেই গণধর্ষণের ঘটনা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করছে। একের পর এক ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ভাবিয়ে তুলছে দেশের সচেতন নাগরিকদের। গণধর্ষণের যত ঘটনা ঘটছে, তার সামান্য অংশই আমরা জানতে পারি গণমাধ্যমের কল্যাণে। লজ্জা ও ভয়ে অনেক সময় এ ধরনের ঘটনা এড়িয়ে যান ভুক্তভোগীরা। তবে যেসব ঘটনা প্রকাশ পায় বা মামলা হয় সেগুলো উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ কিংবা পুুলিশের আন্তরিকতার অভাবে আলোর মুখ দেখে না। এসব মামলায় কখনো কখনো ধরা পড়ে অপরাধীরা। কিন্তু তারা কোন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আবার কখনো প্রভাবশালীর প্রভাবে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায়। দিন দিন বেড়েই চলছে এসব নারী নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা। অবুঝ নারী শিশুও এ থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
বিশিষ্ট লেখক ও সংগঠক, জনতার ধ্বনীর প্রতিষ্ঠাতা-চেয়ারপারসন মর্জিনা আফসার রোজী বলেন, কিছু মানুষের চরিত্র এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তাদের যৌনাকাক্সক্ষার বিষয়টি প্রকাশ্যে আনতেও নিজের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে না। ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধে লজ্জাবোধ করছে না। যৌন চিন্তাধারা ও এক ধরনের বিকৃত মানসিকতার কারণেই তারা এটা করছে। আগে পারিবারিক শাসন ছিল। এখন বড় পরিবার বিলুপ্ত হওয়ায় সন্তানদের দেখার কেউ নেই। এছাড়া ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার অনুপস্থিতিও একটি বড় কারণ। তিনি বলেন, গণধর্ষণের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ নেই। চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে সকল বয়সী সব ধরনের পেশার নারীরা। এ ধরনের অপরাধীদের প্রতিহত করতেও আজকাল কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, মানুষের নৈতিকতার যখন মৃত্যু ঘটে তখনই তারা গণধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ করেও উল্লাস করতে পারে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এডভোকেট সৈয়দা জাহিদা সুলতানা রতœা বলেন, সামাজিক অবক্ষয়, বিকৃত আকাশ সংস্কৃতি, নৈতিক শিক্ষা না থাকা, সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে দিন দিন মানুষ অমানুষ হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক বৈষম্য ও পারিবারিক অসচেতনতা এর জন্য অনেকখানি দায়ী। নারীরা এখন ঘরে বাহিরে সবখানেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বৈষম্য আর নির্যাতন তাদের নিত্য সঙ্গী। তিনি আরো বলেন, ধর্ষণ ও হত্যার মতো অমানবিক, অনৈতিক, বর্বর নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে সামাজিকভাবে নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। ধর্ষণের শিকার ভিকটিম ও তার পরিবার লোকলজ্জা ও সামাজিক ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আবার কেউ কেউ অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন। একটি ঘটনার কূলকিনারা হতে না হতেই ঘটছে আরেক ঘটনা। এসব ঘটনায় ভিকটিমদের জীবনে নেমে আসে কান্না। এ কান্নার যেন শেষ নেই। স্টেফ ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক হাসিনা মোর্শেদ কাকলী বলেন, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার অভাবে সমাজে অনৈতিক কার্যকলাপ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করছে। যার প্রভাবে ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্ষণকারীদের নির্মম নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে কিশোরী তরুণীর জীবন হচ্ছে অন্ধকারময়। তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্ন অকালেই পথের ধুলোতে লুটিয়ে পড়ছে। শুধু তাই নয়, ভয়ভীতি ও অজানা আতঙ্ক তাড়া করছে প্রতি মুহূর্তে। সেই বীভৎস নিষ্ঠুর ঘটনার দুর্বিষহ স্মৃতি প্রতিনিয়ত তাড়া করে তাদের। ভিকটিমরা যখন ওইসব বর্বর স্মৃতি স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তখন পরিবারের সদস্যরাও তাদের সান্ত¡না দেয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেন। এ থেকে মুক্তি পেতে যথাযথ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যাতে একজনকে দেখে দশজন শিক্ষা পায়। চলমান সমাজে মূল্যবোধের অভাব এত প্রকট হচ্ছে যে, মানুষ তার মানবিকতাবোধ হারিয়ে ফেলছে। এ কারণে তরুণী ও মহিলার পাশাপাশি শিশুরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। অপরদিকে দেশে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। অপরাধ করে পার পেয়ে গেলে অপরাধ করার প্রবণতা বেড়ে যায়। ধর্ষণের অনেক ঘটনায় সামাজিক সম্মানের কারণে ভুক্তভোগীরা দীর্ঘমেয়াদি বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। এই সুযোগে ধর্ষকরা শাস্তি থেকে বেঁচে যায়। এসব দেখে অন্যরা অপরাধ কর্মকা-ে উৎসাহিত হয়। ধর্মীয় অনুশাসন, পারিবারিক তদারকি, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, দ্রুত বিচার সম্পন্ন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমেই কেবল ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মতো অপরাধ রোধ করা সম্ভব।
য় আলম শামস
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন