নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে শনিবার সন্ধ্যায় ২৪ ঘণ্টার জন্য মোবাইল ইন্টারনেটের থ্রিজি ও ফোরজি সেবা বন্ধ করে দেয় সরকার। এই সময়ে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন সারাদেশের মানুষ। বিশেষ করে জরুরি প্রয়োজনে ইন্টারনেট ব্যবহার, ব্যবসা-বাণিজ্য, ই-কমার্স, অনলাইন ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং, অনলাইন টিকেটিংসহ সকল ধরণের সেবা থেকে বঞ্চিত হন তারা। ২৪ ঘণ্টা পর রোববার সন্ধ্যায় আবারও তা চালু হলেও এখনো নিরবিচ্ছিন্ন ও দ্রুতগতির ইন্টারনেট না পাওয়ার অভিযোগ করছেন গ্রাহকরা। থ্রিজি ও ফোরজি সেবা পুনরায় চালু করার পরও বেশ কিছু গ্রাহক সেবা বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ করেছেন। ইন্টারনেটের প্রত্যাশিত (পূর্বের মতো) গতি না পাওয়া, বিশেষ বিশেষ স্থানে ইন্টারনেট না থাকা, কল ড্রপ, ভয়েস কলে সমস্যাসহ নানামুখী সমস্যার কথা জানান তারা। এদিকে গ্রাহকদের সমস্যা, ব্যবসায় ক্ষতি হলেও বৃহৎ স্বার্থে সরকার প্রয়োজনে আবারও ইন্টারনেট বন্ধ করে দিতে পারে বলে জানিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় বা জনগণের নিরাপত্তা বিঘিত হলে ইন্টারনেট বন্ধের মত পদেক্ষেপও সরকার নিতে পারে।
দেশে ইন্টারনেট ও ফেইসবুককে ঘিরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে অনলাইন মার্কেট। ভার্চুয়াল এই জগতে কেনাকাটাসহ সবকিছুই করছেন রাজধানীসহ বড় শহরের বাসিন্দারা। কেনাকাটার পাশাপাশি, শেয়ার মার্কেট, ব্যাংকিং, বাস-ট্রেন টিকেট, হালের অনলাইন রাইড শেয়ারিংও হচ্ছে মোবাইল ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে। ফলে ইন্টারনেট সেবায় বিঘ্ন ঘটলে কিংবা গতি না পেলে ভোগান্তি পোহাতে হয় এর সাথে যুক্ত গ্রাহক ও সেবাদাতাদের।
ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, ই-কমার্স সেবাটি পুরোপুরি ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। ফলে ইন্টারনেট সেবা বিঘ্ন হলে তার প্রভাব পড়ে খাতটির ওপর।
এদিকে গতকাল (সোমবার) সকাল থেকেই রাজধানীর, ধানমন্ডি, উত্তরা, রামপুরা, বসুন্ধরা, শাহবাগ, ফার্মগেট, মিরপুরসহ বেশ কিছু স্থান থেকে মোবাইল ইন্টারনেটের ভোগান্তির বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া যায়। মিরপুরের কাজীপাড়ার গ্রামীণফোন গ্রাহক মাহবুবুর রহমান জানান, সরকার থ্রিজি, ফোরজি ইন্টারনেট পুনরায় চালু করার পর থেকে ইন্টারনেটের গতি কমে গেছে। তিনি আগে যেভাবে গতি পাচ্ছিলেন, কিংবা গতির যে অভিজ্ঞতা ছিল সেটি তিনি এখন আর পাচ্ছে না। যে কোন ভিডিও দেখতে গেলেই তা বাফার করছে।
দুপুরে রামপুরা এলাকায় ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগত অস্ত্রধারীদের হামলার সময় বাংলালিংকের গ্রাহক তানভীর আলম জানান, দিনভর তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারনেটের সমস্যা পেয়েছেন। কল করতেও তাদের বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছে। বেশিরভাগ সময়েই কলড্রপ ও মিউট কল হয়েছে। কলের সমস্যা না পেলেও ইন্টারনেট গতি কম থাকার কথা জানিয়েছেন উত্তরায় বসবাসকারী রবি ও গ্রামীণফোনের গ্রাহক মমতাজ উদ্দিন সুমন। তিনি বলেন, সোমবার সকাল থেকেই তিনি ইন্টারনেটের সমস্যা পেয়েছেন। যে কোন ভিডিও দেখতে গেলেই তা দেখা যাচ্ছে না। একই রকম অভিজ্ঞতার কথাও জানিয়েছেন ধানমন্ডি, শাহবাগসহ রাজধানী, সিলেট, চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানের মোবাইল ফোন গ্রাহকরা। তারা অভিযোগ করেন গতকাল একইস্থানে কখনো দ্রুতগতির ইন্টারনেট আবার কখনো গতিহীন ইন্টারনেটের অভিজ্ঞতা তারা পেয়েছেন।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি, মোবাইল ফোন অপারেটর, ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান (আইএসপি), ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেইটওয়ে, ইন্টারকানেশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স) সূত্রে জানা যায়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইন্টারনেটের সমস্যার অভিযোগ তারাও পেয়েছেন। তবে শনিবার ২৪ ঘণ্টার জন্য থ্রিজি ও ফোরজি ইন্টারনেট সেবা বন্ধের নির্দেশের বিষয়ে বিটিআরসি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো স্বীকার করলেও এখন বিষয়ে তারা কিছু বলছেন না। বিটিআরসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, কারিগরি কোন ত্রুটির কারণে সমস্যা হতে পারে। তবে বিটিআরসি থেকে এখন কোন ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে বলা হয়নি।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার এসোসিয়েশন বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) এর সভাপতি আব্দুল হাকিম বলেন, ইন্টারনেটের গতি কমানোর কোন নির্দেশনা আমাদের কাছে আসেনি। এজন্য আমরা আগের মতোই সেবা দিচ্ছি। তবে কোথাও যদি সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে সেটি অন্য কোন কারণে হতে পারে।
রবির কমিউনিকেশনস অ্যান্ড করপোরেট রেসপনসিবিলিটি ভাইস প্রেসিডেন্ট ইকরাম কবীর বলেন, আমাদের সেবা সব সময় একই রকম রয়েছে। যেটি বলা হচ্ছে যে, মোবাইল ফোন অপারেটররা সেবা বিঘিত করছে সেটি ঠিক না। মোবাইল ফোন অপারেটরদের দিক থেকে সেবায় কোন সমস্যা করা হচ্ছে না বলেও তিনি জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রোববারের পর থেকে মোবাইল ফোন অপারেটর, আইএসপিসহ দৃশ্যমান কোন অপারেটরকে ইন্টারনেট বন্ধ কিংবা গতি কমানোর নির্দেশ দেয়া হয়নি। তবে ইন্টারনেট সেবার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গেটওয়ে যুক্ত রয়েছে এদেরকে গতি কমানোর জন্য মৌখিকভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে গত ৯দিন ধরে রাজধানীর যেসব এলাকায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং সংঘর্ষ হচ্ছে এসব এলাকায় ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও বিশেষ বিশেষ মূহুর্তে বিশেষ বিশেষ স্থানে জ্যামারও (নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখা বা নিয়ন্ত্রণ করার যন্ত্র) বসানো হচ্ছে বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, কোনো পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় বা জনগণের নিরাপত্তা বিঘিত হলে ইন্টারনেট বন্ধের মত পদেক্ষেপও সরকার নিতে পারে। আমাকে বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতম সেক্রিফাইস করতেই হবে। এটি খুব সংগত কারণেই করতে হবে। রাষ্ট্র বাঁচাব না ফেইসবুক বাঁচাব? আমাকে অবশ্যই রাষ্ট্র বাঁচাতে হবে। আগামী নির্বাচনের সময় বা কোনো ঘটনা ঘটলে আবারও ইন্টারনেট বন্ধ করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলে মন্ত্রী বলেন, সবার আগে রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা এবং অন্য বিষয়গুলো অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যে পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘিত হবে কিংবা জনগণের নিরাপত্তা বিঘিত হবে- তখন প্রযুক্তির দিকে তাকিয়ে থাকা- এটা কোনো অবস্থাতেই নয়।
এর আগে পুলিশের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সামাল দিতে ফোরজি ও থ্রিজি ইন্টারনেট সেবা বন্ধের সুপারিশ করা হয়। পুলিশের মতে, শিক্ষার্থীরা ফেসবুক ব্যবহার করে আন্দোলনের প্রচার চালাচ্ছে। ফোরজি হচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল ফোন প্রযুক্তি। এর আগের প্রজন্মের প্রযুক্তি থ্রিজি ও টুজি। টুজিতে ইন্টারনেটে ডেটা প্রবাহের গতি কম থাকে।
মোবাইল অপারেটরগুলোর একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ইন্টারনেটের গতি ১.২৮ কেবিপিএসে নামানোর ‘নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে’ তাদের। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ১.২৮ কেবিপিএসে ফেইসবুকে ছবি আপলোড করা সম্ভব হবে না। অন্যান্য ওয়েবসাইট দেখতেও গ্রাহকদের বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন