সাতক্ষীরা তথা দেশের ঐতিহ্যবাহী হাড় ও শিং শিল্প বিলুপ্তির পথে। অথচ এই শিল্পই একদিন সাতক্ষীরা জেলাকে প্রসিদ্ধ করে তুলেছিল। হরিণ ও মহিষের হাড়, শিং দিয়ে তৈরি অপরূপ শিল্প হরিণের মাথা ও লাঠি রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হতো। এমনকি দেশের বাইরেও এর চাহিদা ছিল বেশ।
সাতক্ষীরা শহর থেকে ৫২ কিলোমিটার দক্ষিণে সুন্দরবন সংলগ্ন আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামের কর্মকার পাড়া। শিল্পপাড়া হিসেবে পরিচিত গ্রামের অমৃত সোম ও চিত্তরঞ্জন সোম জানান, বাবা, কাকা ও তাদের পূর্বপুরুষরা শত বছর ধরে এই পেশায় নিয়োজিত। এটিই ছিল তাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র পথ। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় থেকে হাতে তৈরি হরিণের শিং দিয়ে মাথা এবং মহিষের শিং ও হরিণের হাড় দিয়ে তৈরি লাঠি কিনতে ঢাকাসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রত্যন্ত এলাকা প্রতাপনগের বাবুরা আসতেন। সে সময় রাস্তাঘাট না থাকায় তারা স্পিড বোটে নদী পথে আসতেন হাতে তৈরি এসব মাথা ও লাঠি কিনতে। দাম নিয়ে বাবুরা কোনো দর কষাকষি করতেন না। তাদের একটাই চাওয়া ছিল জিনিস যেনো ভালো ও সুন্দর হয়।
তারা আরো জানান, প্রশাসনের অনেক নামী-দামি লোকজন এখানে আসতেন। এমনকি জিয়াউর রহমান সরকারের সময়কার বাণিজ্যমন্ত্রী, সচিবসহ অনেকেই এসেছেন এবং এই শিল্পকে কুটিরশিল্প হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। শিল্পকে আরো উন্নত করতে এবং বিদেশে সরবরাহ করার লক্ষ্যে আর্থিকসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর অনেকটা বছর পেরিয়ে গেলেও এই শিল্পের প্রতি আর কেউ ফিরে তাকায়নি।
বর্তমানে এই শিল্প বিলুপ্তি হতে চলেছে। আগে জিনিসের চাহিদা যেমন ছিল তেমনি হরিণ ও মহিষের মাথা, শিং ও হাড় সহজেই পাওয়া যেত। এখন চাহিদাও কমেছে। সে সঙ্গে হরিণ, মহিষের মাথা, শিং ও হাড়ের অভাব দেখা দিয়েছে। আগে সুন্দরবন থেকে মৌয়ালরা হরিণ ও মহিষের মাথা, হাড়, শিং নিয়ে এসে বিক্রি করতেন। কিন্তু নানান জটিলতায় এখন তাদের আর আগের মতো দেখা মেলে না। চাইলেই সবসময় এগুলো জোগাড় করা যায় না।
বর্তমানে তিন ফুট লম্বা একটি লাঠি এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা, দুই ফুট লম্বা একটি লাঠি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া, ছোট আকারের একটি হরিণের মাথার দাম দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। চিত্তরঞ্জন সোম জানান, হরিণের একটি মাথা তৈরি করতে টানা আড়াই দিন শ্রম দিতে হয়। আর লাঠি তৈরিতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই দিন।
তিনি আরো জানান, আগে এই শিল্পের সাথে কমপক্ষে ২৫টি পরিবার যুক্ত ছিল। বর্তমানে মাত্র দুটি পরিবার এই শিল্পের সাথে যুক্ত আছে। জীবন-জীবিকার তাগিদে লাঠি, মাথা তৈরির পাশাপাশি কামারের কাজসহ বিভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন তারা। শিল্পপাড়ার নাম হয়েছে এখন কর্মকার পাড়া।
কোনো কোনো পরিবারের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে সরকারি-বেসরকারি চাকরিও করছেন। বাপ-দাদার এ পেশায় আর তারা থাকার পক্ষে নন। সরকারিভাবে এই শিল্পকে বাঁচানোর কোনো উদ্যোগ এবং আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়, তাহলে হয়তো অনেকেই আবার ফিরে আসবেন। সাতক্ষীরা তথা দেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্প বিলুপ্তি থেকে রক্ষা পাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন