শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

খালেদা জিয়ার প্রতি এই আচরণ ঘৃণা ও প্রতিহিংসা বাড়াতে পারে

| প্রকাশের সময় : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৯ এএম

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষনার আর মাত্র দু’মাসও বাকি নেই। অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা বা জাতীয় ঐক্য যখন গণদাবীতে পরিনত হয়েছে, তখন প্রধান বিরোধিদল বিএনপি’র চেয়ারপারসন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ ক্রমে আরো জটিল ও প্রতিবন্ধকতাময় করে তোলা হচ্ছে। বিএনপি’র পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে এমন অভিযোগ করা হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার সাজার রায় ঘোষিত হওয়ার পর ইতিমধ্যে প্রায় ৮ মাস পেরিয়ে গেছে। এই মামলার লিভ টু আপীলসহ অন্যান্য মামলায় জামিন হওয়ার পরও তার কারামুক্তির পথে নানা ধরনের আইনগত প্রতিবন্ধকতা তৈরী করা হয়েছে। বয়োবৃদ্ধ খালেদা জিয়া নানা রোগে আক্রান্ত এবং নিয়মিত চিকিৎসাধীণ ছিলেন। কিন্তু কারাবন্দি হওয়ার পর গত আটমাসে তাঁর স্বাস্থ্যের বড় রকমের অবনতি ঘটলেও তার সুচিকিৎসা হয়নি। খালেদা জিয়ার নিজস্ব চিকিৎসকদের মাধ্যমে এবং পছন্দনীয় হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে অসুস্থতার কারণে মাসের পর মাস ধরে তাকে আদালতেও হাজির করা হয়নি। এহেন বাস্তবতায় নাজিমুদ্দিন রোডের কারাগারে অস্থায়ী আদালত বসিয়ে জিয়া চেরিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচারকাজ চালানোর গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। খালেদা জিয়ার আইনজীবী এবং বিএনপির তরফ থেকে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে প্রতিহিংসা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অসাংবিধানিক ও ক্যামেরা ট্রায়াল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থতার কারণে প্রায় ৭ মাস বিশেষ আদালতে হাজির হতে পারেননি। সর্বশেষ গত ৫ সেপ্টেম্বর আকষ্মিকভাবে কারাগারে স্থাপিত আদালতে খালেদা জিয়াকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে জোর করে হাজির করা হয় বলে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন। কারাগারে আদালত বসানোর প্রতিবাদে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা সেখানে বিচারকাজে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকেছেন। এই আদালতের আইনগত বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ইতোমধ্যে আইনমন্ত্রনালয়ের সংশ্লিষ্টদের কাছে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। সামরিক সরকারের আমলের কোর্ট মার্শাল ও বিশেষ ক্যামেরা ট্রায়ালের প্রসঙ্গ বাদ দিলে দেশে গণতান্ত্রিক শাসনের ইতিহাসে কারাগারে আদালত বসিয়ে বিচারকাজ চালানোর কোন নজির নেই। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আনীত মামলার অনুরূপ মামলা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও ছিল। খালেদা জিয়া এখনো দেশের প্রধান বিরোধী দলের শীর্ষ নেতা। দেশে এমন কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি যে, কারাগারে আদালত বসিয়ে তার বিচার করতে হবে। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে, যে কোন নাগরিকের বিচার হতে হবে প্রকাশ্য আদালতে। খালেদা জিয়ার বিচারে তার ব্যত্যয় ঘটতে পারেনা। কিছু বিপত্তি ও অভিযোগ সত্তে¡ও গত ১০ বছর ধরে খালেদা জিয়া আদালতের সাথে সহযোগিতামূলক আচরণ করেছেন। কারাগারে যাওয়ার আগে পুরোপুরি সুস্থ, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগহ্রণ করেছিলেন তিনি। এখন তিনি কার্যত পঙ্গু হওয়ার পথে। খালেদা জিয়ার আইনজীবী, ডাক্তার, স্বজন ও দলীয় নেতারা তার অসুস্থ্যতা সম্পর্কে আশংকা প্রকাশ করেছেন। এহেন বাস্তবতায় তার জামিন ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা জরুরী।
আগের রাতে কারাগারে আদালত স্থাপনের গেজেট প্রকাশের পর ৬ মাস ২৪দিন পর গত বুধবার হুইল চেয়ারে বসিয়ে আদালতে হাজির করা হয় খালেদা জিয়াকে। আদালতে হাজির হয়ে খালেদা জিয়া বিচারকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘যা ইচ্ছা সাজা দিতে পারেন, যা মন চায় করেন, আমি বার বার আসতে পারব না, কারণ আমি অসুস্থ’। খালেদা জিয়ার সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান যেমন অস্বীকার করা যায়না, পাশাপাশি তিনি ৭৪ বছর বয়স্কা একজন অসুস্থ নারী। সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে তিনি বিশেষ নিরাপত্তামূলক সুবিধাদি পেতে পারেন। তা না করে কারাগারে আদালত বসিয়ে তড়িঘড়ি তার বিরুদ্ধে রায় ঘোষনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকের ভাষ্য অনুসারে, দুর্নীতি দমন কমিশনের বহু মামলা পড়ে আছে। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলাও ঝুলছে বছরের পর বছর ধরে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে হঠাৎ কারাগারে আদালত বসিয়ে তড়িঘড়ি রায় ঘোষনার উদ্যোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। গেজেট প্রকাশের ৭দিন পর কারাগারে আদালত বসানো হলে উচ্চ আদালতের স্মরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ থাকত বলে মনে করেন ড.শাহদীন মালিক। সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বিচার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা সংবিধানেই রক্ষিত থাকে। খালেদা জিয়ার মামলাগুলোর ক্ষেত্রে শুরু থেকেই এর ব্যত্যয় ও সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতার অভিযোগ রয়েছে। খালেদা জিয়ার জামিন ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা না করে তড়িঘড়ি কারাগারে আদালত বসিয়ে রায় ঘোষণার প্রয়াস সরকারের প্রতিহিংসাপরায়ণতার প্রমান। একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যখন দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন তখন খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে নতুন মামলায় সাজা দেয়া হলে তা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলবে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। এ ধরনের কার্যক্রম দেশের রাজনীতিতে ঘৃনা, প্রতিহিংসা ও দ্বন্দ-সংঘাত উস্কে দিতে পারে। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে অসুস্থ খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা ও মুক্তি এবং রাজনৈতিক সমঝোতাই এই মুহূর্তে প্রত্যাশিত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন