বাণিজ্য ও বেসরকারি বিমান চলাচলখাতে ঢাকা-নয়া দিল্লির বিদ্যমান সম্পর্ককে আরো শক্তিশালি করতেই শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলসহ পাঁচদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতের শিল্প, বাণিজ্য এবং বেসরকারি বিমান চলাচল মন্ত্রী সুরেশ প্রভু পাঁচ দিনের সফরে এখন ঢাকায়। বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এই সফরে সুরেশ প্রভু ভারতের বিনিয়োগকারীদের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি বরাদ্দ, আরো ছয় থেকে ১০টি সীমান্ত হাট চালু, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর উন্নয়নে বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহার, বেনাপোল স্থলবন্দর উন্নয়ন, বিনিয়োগ বাড়ানোসহ নৌপথে পণ্য আনা-নেওয়ার বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হবে বলে জানা গেছে। এই সফরে ভারতের বাজারে পাটপণ্য রফতানিতে অ্যান্টি-ডাম্পিং বিষয়ে সিন্ধান্ত আসতে পারে। এছাড়াও বাংলাদেশে পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ভারত মোট ২৭৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। জানা গেছে, এই সফরে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অমিমাংসিত একাধিক বিষয় নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করবেন ভারতের মন্ত্রী।
আজ মঙ্গলবার বাণিজ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা ভোলাতেও ভ্রমণে যাবেন তিনি। সেখানে ভোলার স্বাধীনতা জাদুঘর পরিদর্শন করবেন ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী। আগামীকাল বুধবার দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী বৈঠকে বসবেন। এদিনই বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামালের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন এবং একইদিনে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর পরিদর্শন করবেন। ২৮ সেপ্টেম্বর সকালে ঢাকা ত্যাগ করার কথা রয়েছে ভারতের এই মন্ত্রীর।
ঢাকায় সফরকালে সুরেশ প্রভু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের সাথে সাক্ষাৎ করবেন। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করার কথা রয়েছে তার।
জানা গেছে, ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে দু’দেশের সম্পর্ক অন্য এক উচ্চতায় নেয়ার কৌশল গ্রহণ করা হবে তার এই সফরের সময়। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে রফতানি বাড়ানো ও দেশটির বিনিয়োগ আনার চেষ্টা বহুদিনের। ভারত ইতোমধ্যে পোশাক রফতানিতে শুল্ক সুবিধা দিয়েছে। এ কারণে দেশটিতে পোশাক রফতানি সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। ভারতের বাজারে পাটপণ্য রফতানিতে অ্যান্টি-ডাম্পিং একটি বড় সমস্যা। এ সমস্যা দূরীকরণে এবার আলোচনা করা হবে। ভারত থেকে তুলা আমদানি সহজীকরণ ও শুল্ক-অশুল্কজনিত যেসব সমস্যা রয়েছে তা দূরীকরণে উদ্যোগ নেয়া হবে। ভারতের বিনিয়োগ আনতে ইতোমধ্যে পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চল দেয়া হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে ভারতীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের জন্য আহ্বান করা হবে।
এছাড়া লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় দেশের অবকাঠামোখাত উন্নয়নে আরও ভূমিকা রাখতে চায় বন্ধু প্রতীম প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। গত আট বছরে প্রথম ও দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিট বা এলওসি চুক্তির আওতায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি করা হয়। তৃতীয় এলওসির আওতায় গত বছর আরও সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি করা হয়েছে। সবমিলিয়ে ভারত থেকে আট বিলিয়ন ডলার ঋণ হিসেবে পাওয়া যাবে। যা দিয়ে দেশের বড় ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বেসরকারীখাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি বাড়বে। একই সঙ্গে রফতানি বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে ভারতীয় বাণিজ্যমন্ত্রীর এই সফরকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ভারতীয় উদ্যোক্তারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ করতে চায়। মুলত বিনিয়োগ সম্ভাব্যতা যাচাই করতে প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ সফরে আসছে। এছাড়া বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত যেসব বাধা ও সমস্যা রয়েছে তা নিয়ে এবার আলোচনা করা হবে। আশা করা হচ্ছে, প্রতিবেশী এই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করার উদ্যোগ থাকবে এবারের সফরে।
অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সূত্রে জানা গেছে, সুরেশ প্রভুর এই সফরে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে জমি বরাদ্দের বিষয়ে আলোচনা হবে। চলতি বছরের মে মাসে ভারত সফরের সময়ে এসব অঞ্চলে বিনিয়োগের জন্য ভারতীয় ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় দুই দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনাকালে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ভারতীয় বিনিয়োগের জন্য জমি বরাদ্দের বিষয়টিও উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিনিয়োগ বাড়াতে ভারত এদেশে প্রথম পর্যায়ে পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে যাচ্ছে। বিনিয়োগ সম্ভাব্যতা যাচাই করে প্রয়োজনে আরও কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করবে ভারত। বাংলাদেশের মংলায় ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করবে দেশটির হিরানান্দানি গ্রুপ। ইতোমধ্যে ওই গ্রুপের উর্ধতন কর্মকর্তারা মংলায় প্রস্তাবিত ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
এদিকে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (বেজা) প্রক্রিয়াকরণ কমিটির সভায় হিরানান্দানি গ্রুপকে বাছাই করা হয়েছে। এছাড়াও সভায় ভারতের মোট তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় জানানো হয়, হিরানান্দানি গ্রুপ প্রতিনিধিরা মংলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল এলাকায় কয়েকটি অবকাঠামো নির্মাণের অনুরোধ করেছে। বাকি দুটি ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে কুষ্টিয়ায় ভেড়ামারা ও চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে।
এছাড়াও মুন্সীগঞ্জে ভারতের জন্য দু’টি আইসিটিভিত্তিক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সূত্র মতে, বাংলাদেশে পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ভারত মোট ২৭৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। যার মধ্যে আইসিটিভিত্তিক অর্থনৈতিক অঞ্চলে সব বিনিয়োগকারীদের জন্য খোলা থাকবে। ওই সভায় আরও বলা হয়, মংলায় ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে হিরানান্দানি গ্রুপের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করা হবে। এ জন্য একটি খসড়া সমঝোতা স্মারক ওই গ্রুপ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। তাদের মতামত পাওয়া গেলে প্রসেসিং কমিটি এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। পরে এ বিষয়ে ভারতীয় ওই গ্রুপটির সঙ্গে একটি চুক্তি সই করবে বাংলাদেশ।
জানা গেছে, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের পক্ষে গত ১৮ এপ্রিল ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ভারতের শিল্প, বাণিজ্য এবং বেসরকারি বিমান চলাচল মন্ত্রী সুরেশ প্রভুকে তার দপ্তরে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলাদেশ সফরের আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র তুলে দেন। সঙ্গে সঙ্গেই তা গ্রহণ করে গত জুনে বাংলাদেশ সফরের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন সুরেশ প্রভু। কিন্ত ব্যস্ততার কারণে শেষ পর্যন্ত গত জুন মাসে সময় বের করতে না পারায় চলমান গতকাল রাতে তিনি ঢাকা সফরে আসলেন।
ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রীর সফর বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এক অনুষ্ঠানে বলেন, ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা ধরনের জটিলতার কারণে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সমস্যায় পড়ছেন। ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসছেন। এসব বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা হবে। বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের সঙ্গে যে ব্যবসা করে, তার ১০ শতাংশের বেশি হয় ভারতের সঙ্গে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজের পরিমাণ ৯০০ কোটি ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে ৯০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন