ঢাকার ফরিদাবাদ আর্সিনগেইট বরাবর বুড়িগঙ্গা নদী থেকে গতকাল অজ্ঞাত (২০) এক যুবতীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহতের পরনে ছিল গোলাপি রঙের সালোয়ার ও খয়েরি রঙের ছাপার কামিজ। যুবতীটির জিভ কামড়ে ধরা ছিল। ধারণা করা হচ্ছে ৪-৫ দিন আগে যুবতীটিকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে। লাশের গায়ে পচন ধরে চামড়া উঠে যাওয়ায় গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন রয়েছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। বুড়িগঙ্গা নদী থেকে প্রায় সময়েই নানা বয়সের মানুষের লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে। কখনো দু’একটি লাশের পরিচয় পাওয়া গেলেও অধিকাংশ লাশ অজ্ঞাতই থেকে যায়। হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দিয়ে খুনীরা নিজেদের আড়াল করছে। পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করা হলেও সঠিক তদন্ত হয় না বলে অভিযোগ দীর্ঘ দিনের।
পুলিশ কর্মকর্তা ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীটাকে খুনীরা ডাম্পিং জোন হিসেবে ব্যবহার করছে। যে যেভাবে পারছে মানুষ হত্যা করে নদীতে ফেলে দিচ্ছে। লাশগুলো কয়েকদিন পর যখন ভাসে তখন কিছুই বুঝে উঠা যায় না। পচাগলা লাশ। এগুলোর কোনটা হত্যা আর কোনটা দুর্ঘটনা তা বুঝা কঠিন হয়ে পড়ে। দুঘটনার বাইরে হত্যাকান্ডের পর লাশ যাতে নদীতে ফেলে খুনীরা নিজেদের আড়াল করতে না পারে সে জন্য পুলিশি নজরদারী জোরদার করা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেন।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, হত্যাকান্ডের পর বুড়িগঙ্গা নদীতে লাশ ফেলে দেয়ার প্রতিটি ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। অনেক সময় বিভ্রান্ত করতে বা নিজেদের আড়াল করতে নদীতে লাশ ফেলে দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া নৌ দুর্ঘটনা বা পানিতে গোসল করতে গিয়ে নিখোঁজের ঘটনাও ঘটে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিটি ঘটনাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। নিহত ব্যক্তি অজ্ঞাত হওয়ায় তদন্ত করে বের করতে সময় লেগে যায়। তবে গাফিলতি করার কোন সুযোগ নেই।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার এসআই আশরাফুল আলম জানান, গতকাল সোমবার স্থানীয় লোকজন ঢাকার ফরিদাবাদ আর্সিনগেইট বরাবর মাঝ নদীতে এক যুবতীর লাশ ভাসতে দেখে। তাদের মাধ্যমে খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে অজ্ঞাতপরিচয় যুবতীর লাশ ভাসতে দেখি। পরে লাশটি উদ্ধার করে তা ময়নাতদন্তের জন্য পাঠাই। প্রাথমিক অবস্থায় মনে হয়েছে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে। ময়না তদন্ত রিপোর্ট ও তদন্তে সব বেরিয়ে আসবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এরকম লাশ প্রায়শই দেখা যায়। প্রশাসনকে জানাতেও ভয় লাগে। এভাবে কত লাশই তো চোখের সামনে দিয়ে ভেসে চলে যায়। তবে নদীতে ভাসমান এই লাশ নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক। প্রতিমাসে বুড়িগঙ্গার পানিতে লাশ ভেসে উঠছে। যেগুলোর বেশিরভাগরই বেওয়ারিশ থেকে যাচ্ছে। কূল-কিনারা হচ্ছে না তাদের পরিচয়ের। বুড়িগঙ্গার আশেপাশের চারটি থানা থাকায় আইনি জটিলতাও রয়েছে। গত ৬ মাসে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা, কেরানীগঞ্জ থানা,সাভার থানা ও হাজারীবাগ থানা এলাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসমান আবস্থায় পাওয়া গেছে ২৫ লাশ। এগুলোর অধিকাংশের পরিচয় পাওয়া যায়নি। লাশ পাওয়ার পর শুধুমাত্র একটি মামলায়-ই থমকে থাকে সবকিছু।
কয়েক পুলিশ কর্মকর্তা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, অন্য কোথাও হত্যার পর দুর্বৃত্তরা গুম করতে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। আবার দুর্ঘটনা অথবা হত্যাকান্ডের শিকার হয়েও জোয়ারের টানে লাশ ভেসে আসে বুড়িগঙ্গায়। অধিকাংশেরই পরিচয় না মেলায় তদন্তে বেগ পেতে হচ্ছে বলে স্বীকার করেন তারা।
পুলিশ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে ৪১ জন নারী, পুরুষ ও শিশুর বিকৃত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বুড়িগঙ্গা নদী থেকে। সে হিসাবে গড়ে প্রতি ৯ দিন অন্তর একটি করে লাশ পাওয়া গেছে নদীতে। এর অধিকাংশ হত্যাকান্ডের শিকার। তবে এসব লাশের বেশির ভাগেরই পরিচয় না পাওয়া এবং তাৎক্ষণিকভাবে হত্যা না দুর্ঘটনা তা নিশ্চিত হতে না পারায় বিপাকে পড়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তাদের। কয়েকটি লাশের ক্ষেত্রে শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে পুলিশই হত্যা মামলা করেছে। হত্যার আলামত পাওয়া যায় না যেসব লাশের সেগুলোর ক্ষেত্রে হয় অপমৃত্যু মামলা। ময়নাতদন্ত শেষে বেশিরভাগ পরিচয়হীন লাশেরই ঠিকানা হয় লাশ দাফনের প্রতিষ্ঠান আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে। এসব হত্যা/অপমৃত্যু মামলার মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি মামলার রহস্য পুলিশ উদ্ঘাটন করতে পারলেও অসংখ্য মামলা বছরের পর বছর আটকে আছে তদন্তের বেড়াজালে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন