শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ক্রুসেডের সূচনা এবং বর্তমান মুসলিম পুনর্জাগরণ

কে. এস. সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ৯ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০২ এএম


মুসলমানদের মধ্যে পরস্পর ঐক্য-সংহতির উপর ইসলাম বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং একই সাথে পরস্পর বিরোধ-আত্মকলহেরও কঠোরভাবে নিন্দা করেছে। পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে যে, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ আরও বলা হয়েছে , ‘তোমরা পরস্পর বিরুদ্ধাচরণ করো না, তাতে তোমাদের মানসম্মান বিনষ্ট হবে।’
মুসলমানদের অনৈক্য বিরোধের সুযোগে দুশমনরা তাদের ক্ষতি সাধন করতে পারে এই সত্য অস্বীকার করা যায় না। এ কারণে মুসলিম ঐক্যের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। বর্তমান মুসলিম বিশ্বের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই যে, মুসলিম ঐক্যের অভাবেই শত্রুদের হাতে তাদের পদে পদে মার খেতে হচ্ছে। ওআইসি অর্থাৎ ইসলামী সম্মেলন সংস্থা নামে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর এক বৃহত্তর সংস্থা ১৯৬৯ সাল থেকে বিদ্যমান থাকলেও এই সময়ের মধ্যে বহুক্ষেত্রে মুসলমানদের উপর মারাত্মক বিপর্যয় নেমে এসেছে এবং এই সংস্থার ভূমিকা সেসব ক্ষেত্রে প্রশ্নোবোধক হয়ে রয়েছে। আরব লীগ তথা আরব বিশ্ব বর্তমানে বহু বিভক্ত হয়ে যে করুণ পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে তা কারও অজানা নয় এবং তাতেও এসব দেশের পরস্পর বিরোধ, কলহ এবং ঐক্যের অনুপস্থিতি প্রধান কারণ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। পক্ষান্তরে মুসলিম বিরোধিতা-বিদ্বেষে অমুসলিম শক্তিবর্গের জোরদার ঐক্য হিসেবে লক্ষ্য করার মতো। এসব শক্তি মুসলিম বিরোধিতায় একান্তভাবে সক্রিয় এবং মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে সংঘর্ষ বাধাতে অত্যন্ত সূ²ভাবে কাজ করে চলেছে। যাকে বলা হয়, ‘আল কোফরো মিল্লাতুন ওয়াহেদা।’ অর্থাৎ কোফরের সকল শক্তি ও শাখা-প্রশাখা মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে এক কাতারে সমবেত হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে যার অসংখ্য দৃষ্টান্ত বিশ^বাসীর সামনে রয়েছে। ক্রুসেড যুদ্ধ সমূহের ইতিহাস পাঠ করলেও দেখা যাবে যে, পরস্পর অনৈক্য ও বিরোধ-কলহের সুযোগ গ্রহণ করেছে শত্রুপক্ষ। ক্রুসেড যুদ্ধের প্রাথমিক দিকের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এখানে তুলে ধরা হল যাতে প্রমাণিত হবে যে, মুসলিম অনৈক্য, বিরোধ তাদের কি করুণ পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছিল।

আবুল আব্বাস আহমদ মোস্তাজহের বিল্লাহ (৪৮৭-৫১২ হি.) ছিলেন ২৮ তম আব্বাসীয় খলিফা। তার আমলে তৎকালীন মুসলিম দুনিয়া বহু বড় বড় ঘটনা দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। তার পূর্বে বাতেনী সম্প্রদয়ের আত্মপ্রকাশ ঘটে, যারা রক্তপাত ও খুন-খারাবীর এক ঘৃণ্যতম অধ্যায়ের সূত্রপাত করে এবং এসময় পশ্চিমাঞ্চলে ক্রুসেড যুদ্ধের সূচনা হয়। মুসলমানদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী বাতেনী সম্প্রদায় ও যুদ্ধাংদেহী খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের ধ্বংসাত্মক তৎপরতা একই সময় ভয়ানক রূপ ধারণ করে এবং উভয় সন্ত্রাসীর সম্পর্ক ছিল মিসরের ফাতেমীয় খেলাফতের সাথে। বাতেনীয়রা ছিল ফাতেমীয়দের সমর্থক, পক্ষান্তরে ফিরিঙ্গী-খ্রিস্টানরা ছিল তাদের দুশমন। উল্লেখ্য, বাগদাদের খলিফা মোস্তাজহের বিল্লাহর আমলে মিসরে ফাতেমীয় খলিফা ছিলেন হিজরী ৪৮৭/১০৯৪-৪৯৫/১১০১ পর্যন্ত মোস্তালী বিল্লাহ। অর্থাৎ বাগদাদের খলিফা মোস্তাজহের বিল্লাহ ও মিসরের খলিফা মোস্তালী বিল্লাহর আমলে ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা ক্রুসেড যুদ্ধ শুরু করে। হিজরী ৪৯১ সালে খ্রিস্টানদের সম্মিলিত বাহিনী মুসলিম জাহানে অব্যাহত যুদ্ধের পর বহু ইসলামী দেশ অধিকার করে এবং শেষ পর্যন্ত বাইতুল মোকাদ্দাসও তাদের অধিকারে চলে যায়।

সেলজুকী শাসকরা এশিয়া মাইনর হতে রোমানদের বিতাড়িত করলে খ্রিস্টানরা ধর্মীয় সম্পর্কের কারণে বাইতুল মোকাদ্দাস সমস্যা উত্থাপন করে। দেশে রাজনৈতিক হাঙ্গামার কারণে খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। তাছাড়া মুসলমানদের সা¤্রাজ্য বিস্তারও তাদের কাছে কাঁটার মত মনে হতে থাকে। এর মূল কারণ ছিল এই যে, হজরত উমর (রা.) এর খেলাফত আমলে জেরুজালেমের পবিত্র স্থানসমূহ বিজিত হওয়ার পরও ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের তীর্থযাত্রার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয় এবং তাদের যাতায়াতের জন্য খ্রিস্টান খানকাহ কর্তৃক পবিত্র স্থানগুলোর জিয়ারত খ্রিস্টানদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয় এবং তাদের আসা যাওয়ার সুবিধাও বৃদ্ধি করা হয়। বস্তুত এটি ছিল মুসলমানদের গৃহযুদ্ধের যুগ। ফলে খ্রিষ্ঠান তীর্থ যাত্রীদের ভ্রমণকালে কিছু কিছু অসুবিধা দেখা দেয় যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এসব অসুবিধার কথা খ্রিস্টানরা ইউরোপে অত্যন্ত অতিরঞ্জিত করে প্রচার করতে থাকে এবং ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের দারুণভাবে উত্তেজিত করা হতে থাকে।

সেলজুকীদের কুনিয়ায় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও এশিয়া মাইনর হতে রোমানদের কর্তৃত্বের অবসান ঘটানোর পর বট্টুস বা পিটার নামক জনৈক ধর্মযাজক বিশপ বা পিটার (রোমান পোপ) এবং ইয়ানেসের নিকট ফরিয়াদ নিয়ে যায়। এই ব্যক্তি ইউরোপবাসীদের ধর্মের নামে পবিত্র স্থান ও হজরত ঈসা (আ.) এর নিদর্শনাবলী সংরক্ষণের জন্য উত্তেজিত করে। সে জার্মানি ও ফ্রান্সের লোকদেরকে এই পবিত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে। এই সুপরিকল্পিত অপপ্রচারের ফলে ইউরোপের লাখ লাখ লোক ‘কুসতুনতুনিয়ায়’ উপনীত হয়ে রোমান সম্রাট কাইসারের সৈন্যদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ইসলামী এলাকাসমূহে আক্রমণ চালাতে থাকে। ঐতিহাসিকদের বর্ণনানুযায়ী হিজরী ৪৮৯/১০৯৬ সালের আগস্ট মাসে ক্রুসেড যোদ্ধারা বিপুল সংখ্যায় যাত্রা করে এবং তাদের অগ্রভাগে ছিল বট্টুস ধর্মযাজক। তাদের এই দলের মধ্যে কোন নিয়ম-শৃঙ্খলা না থাকায় পথে তারা লুটপাট আরম্ভ করে। ফলে তাদের বুলগেরীয় ও হাঙ্গেরীয় লোকদের সাথে বিভিন্ন যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। যুদ্ধে তাদের অধিকাংশ সৈন্য নিহত হয় এবং অবিশষ্ট সৈন্য এশিয়া মাইনরে প্রবেশ করলে সুলতান কেলিজ আরসালানের সৈন্যরা তাদেরকে খতম করে দেয়। তাদের একজনও প্রাণে বেঁচে যেতে পারেনি। এই শোচনীয় বিপর্যয়ের পর তারা দ্বিতীয় আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে, এতে তিনটি বাহিনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়, এরা হলো: (১) প্রথম বাহিনী ছিল ফরাসিদের। এই বাহিনীর নেতা ছিলেন গডফ্রে ডিউক চিলবিন। তার সঙ্গে ফ্রান্স এবং অষ্ট্রিয়ার বিভিন্ন সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। (২) দ্বিতীয় বাহিনী ফ্রান্স বাজফিলিপের ভাই হিউ অপ দরমান্দুর নেতৃত্বে ছিল। (৩) তৃতীয় বাহিনী স্বয়ং রোমে প্রস্তুত হয়েছিল এবং তাদের নেতা ছিরেন বুহিমন্দ। তিনি ইতালির ‘তারানাত’ নামক স্থানের সর্দার ছিলেন। এই তিন বাহিনীর সমগ্র সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় সাত লাখ। এই বিশাল বাহিনী ‘কুসতুনতুনিয়া’ প্রণালী অতিক্রম করে এশিয়া মাইনরে প্রবেশ করে, সুলতান মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হন। শত্রুবাহিনী এসে কুনিয়া অবরোধ করে। প্রায় ৫০ দিন পর তারা কুনিয়া অধিকার করে। অত:পর তাদের মধ্যে অনৈক্য দেখা দিলে পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তাদের বহু সৈন্য নিহত হয়। তাদের মধ্যে একজন আমীর বিলডুডীন আলাদা হয়ে ‘ফুরাতিয়া’ দ্বীপে আসে এবং রাহা নামক স্থান দখল করে। অবশিষ্টরা ‘আনতাকিয়া’র দিকে অগ্রসর হয়। সেখানকার শাসক ছিলেন আমীর বাগিয়ান, তিনি বীরত্বের সাথে মোকাবিলা করেন, পূর্ণ ৯ মাস ক্রুসেডারেরা অবরোধ অব্যাহত রাখে কিন্তু কোন ফল হয়নি। অবশেষে একজন দুর্গরক্ষীকে ঘুষ দিয়ে তাদের সঙ্গে নেয় এবং তারই মাধ্যমে ক্রুসেডারেরা অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। অবরোধকালে তারা দামেস্কের ওহিলবের শাসকদের নিকট এই মর্মে পত্র প্রেরণ করে যে, আমরা কেবল সে সব শহর চাই যেগুলো রোমানদের ছিল, আপনাদের সাথে আমাদের কোন বিষয় জড়িত নয় অর্থাৎ তাদের উদ্দেশ্য ছিল এই যে, দামেস্ক ওহনব বাসীরা যেন আনতাকিয়াবাসীদের সাহায্যে এগিয়ে না আসে। আর এই সরল মনা লোকেরা তাই করেন ও আন্তাকিয়া বিজয়ের পর তারা মোরাববাতুন নোমান অধিকার করে। অতঃপর তারা বাইতুল মোকাদ্দাসের দিকে অগ্রসর হয়। এটি তখন সেলজুকীদের অধিকারে ছিল। কিন্তু ফাতেমীয় বা তাদেরকে ক্রুসেডারদের সাথে মোকাবিলায় লিপ্ত দেখে তাদের আমীর আফজাল ইবনে বদর জামালীকে প্রেরণ করে তা দখল করে নেয়। প্রায় দেড় মাস ক্রুসেডারদের অবরোধে থাকার পর তাদের অধিকারে চলে যায় এবং ৪৯২ হিজরির ২২ শাবান মাসে তারা সেখানে প্রবেশ করে। অধিবাসীদেরকে বেপরোয়াভাবে হত্যা করে। ঐতিহাসিকরা বলেন যে, কিছু লোক কাজী আবু সাঈদ হারাবীসহ বাগদাদে গিয়ে এই রক্তাক্ত কাহিনী বর্ণনা করে এবং সাহায্য তলব করে। এ সময় বারকেয়ারুক ও সুলতান মোহাম্মদ গৈারের মধ্যে পরস্পর যুদ্ধের কারণে তারা কোন সাহায্য করতে পারেনি।

ঐতিহাসিকরা আরও বলেছেন যে, মুসলমান শাসকবর্গ যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় তারা খ্রিস্টান অভিযান প্রতিহত করার কোন উদ্যোগই গ্রহণ করতে অগ্রসর হননি। ফলে খ্রিস্টানরা সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের অধিকাংশ এলাকা অধিকার করে বসে এবং হাজার হাজার মুসলমানকে নৃশংসভাবে শহীদ করে ও দেশকে ধ্বংস্তুপে পরিণত করে। তারা কেবল মুসলমান নয়, হাজার হাজার ইহুদীকেও হত্যা করে। এসব ঘটনা বাইতুল মোকাদ্দাস বা জেরুজালেম প্রবেশের পূর্বে ঘটানো হয়। এসব করুণ কাহিনী ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

কোন কোন ঐতিহাসিকের বর্ণনা অনুযায়ী ১০৯৮ সালে ‘আনতাকিয়া’ জয় করার সময় খ্রিস্টানরা এক লাখ মুসলমানকে শহীদ করে। তারা হেমস শহরে হাজার হাজার মুসলমানকে জীবন্ত দগ্ধ করে শহীদ করে। ৪৯২/১০৯৯ সালের মার্চ মাসে সংঘটিত এই মর্মান্তিক পরিণতির পর জেরুজালেমে খ্রিস্টানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর সেখানে তারা কি ভয়াবহ নৃশংসতা চালিয়েছিল তা এক ভিন্ন ইতিহাস এবং সুদীর্ঘকাল পর গাজী সুলতান সালাহউদ্দীন আইউবী জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করে খ্রিস্টানদের সাথে প্রতিশোধমূলক আচরণ করার পরিবর্তে যে উদার আচরণ করেছিলেন, খ্রিস্টানরা তা ভুলে গিয়েছে। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুসলিম অনৈক্য ও আত্মকলহের সুযোগে যুগে যুগে খ্রিস্টানদের হাতে মুসলমানগণ বহু ক্ষেত্রে চরমভাবে মার খেয়েছে। আর এই একই কারণে আজও তারা ওদের হাতেই শোচনীয়ভাবে মার খাচ্ছে। এক কথায় প্রাচীন ক্রুসেডারদের ন্যায় বর্তমান যুগেও বহু নব্য ক্রুসেডারের আবির্ভাব ঘটেছে, যাদের নিকট মুসলিম জাতি নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে এবং লাখ লাখ মুসলমানকে হত্য করা হচ্ছে। এই মর্মান্তিক শোচনীয় পরিস্থিতি হতে পরিত্রাণ পেতে হলে মুসলমানদের ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নব্য ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। বর্তমানে যে মুসলিম পুনর্জাগরণের সূচনা হয়েছে তার শুভ পরিণতি সকলে কাম্য।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন