আধুনিক সমাজে মাদকাসক্তি বড় সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। বিশেষ করে সমাজের তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ আজ মাদক নেশায় বেশী আক্রান্ত। অতীতে যে তরুণের ঐতিহ্য রয়েছে প্রতিবাদের, সংগ্রামের, যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে আনার দৃষ্টান্ত। কিন্তু সেই গৌরব উজ্জ্বল অধ্যায়ের কথা ভুলে গিয়ে, আজ মাদকাসক্তির মতো সর্বনাশা নেশার কবলে পড়ে তরুণ প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য অংশ জীবনশক্তি হারিয়ে ফেলতে বসেছে। মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে শত সহস্র প্রাণ। ঘরে ঘরে সৃষ্টি হচ্ছে অশান্তি, পুরো জাতি রয়েছে উদ্বেগ উৎকন্ঠায়। তাই মানব জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষায় ইসলামে মদ্যপান হারাম করা হয়েছে । পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ ! মদ, জুয়া, ম‚র্তিপ‚জার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। তাই তোমরা তা বর্জন কর। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে’( স‚রা মায়িদা: ৯০)। উপরিউক্ত আয়াতে মদপান করাকে ঘৃণ্য কাজ বলা হয়েছে। আর একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, ঘৃণ্য কাজ সর্বদাই পরিত্যাজ্য। এমনিভাবে এই আয়াতে মদ্যপান করাকে শয়তানের কাজ বলা হয়েছে । এর দ্বারা মদপান হারাম হওয়ার বিষয়টা স্পষ্ট ভাবেই প্রমাণিত। মদ্যপানের মাধ্যমে একদিকে যেমন আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘন হয়, অন্যদিকে এটি মানবদেহে দ‚রারোগ্য মারাত্মক ব্যাধির উত্থান ঘটায়। হাদিসে এসেছে, ‘তারিক ইবনে সুওয়ায়দ জু’ফী (রা.) রাস‚লুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি তাকে নিষেধ করলেন, অথবা মদ প্রস্তুত করাকে খুব খারাপ মনে করলেন। তিনি (তারিক (রা.)) বললেন, আমি তো ওষুধ প্রস্তুত করার জন্য মদ বানাই। রাস‚ল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন এটি তো রোগ নিরাময়ের প্রতিষেধক নয়, বরং মদ নিজই রোগ’ (মুসলিম: ৪৯৭৭)। এই হাদীসে রাস‚লুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদকে রোগ বলেছেন বহু আগেই অথচ আজকের চিকিৎসাশাস্ত্রও তা স্বীকার করে নিয়েছে । আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে মাদকদ্রব্যাদি সেবনের ফলে মানবদেহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। মদপানের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সর্ব প্রথম মুখ থেকেই প্রকাশ পায়। সাধারণত মানুষের মুখে লালা সাদৃশ এক ধরণের ধাতু থাকে । মদপান করার কারণে মুখের লালা উৎপাদনের শক্তি ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। যদ্দরুন মাড়ীতে ক্ষত এবং ফোলা বা স্ফীতি দেখা দেয়। যার ফলে শরাবে অভ্যস্থ ব্যক্তিদের দাতগুলি খুবই দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ইসলামে মানুষের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার প্রতি লক্ষ রেখে খাওয়া-দাওয়ার জিনিসকে হালাল-হারাম অথবা জায়েয-নাজায়েযে বিভক্ত করা হয়েছে। মদ এবং অন্যান্য নেশাযুক্ত দ্রব্যাদি ইসলাম স্পষ্ট ভাবেই হারাম ঘোষণা করেছে। এগুলো মানবদেহের উপর যে কি পরিমাণ কু-প্রভাব ফেলে তা আজকাল দিনের মত পরিষ্কার। একথা সর্বজন বিদিত যে,মদ বা এ্যালকোহল কন্ঠনালী এবং খাদ্যনালিতে ক্যান্সার সৃষ্টির ম‚ল উৎস হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি পাকস্থলীতে ক্যান্সার সৃষ্টির ব্যাপারেও উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা পালন করে। বিভিন্ন সংস্থা ক্যান্সারের মতো মারাত্মক ব্যাধিকে প্রতিরোধ করতে ১৯৮০ সালের পর থেকে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সতর্কতা ও দ‚রদর্শীতামুলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। ইসলাম আজ থেকে প্রায় চৌদ্দশত বৎসর প‚র্বে মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী মাদকদ্রব্য কঠোর হস্তে বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। হাদীস শরীফে এসেছে রাস‚লুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন ‘আল্লাহর লানত শরাবের উপর, তা পানকারীর উপর, যে পান করায় তার উপর, যে বিক্রি করে তার উপর, যে তা খরিদ করে তার উপর, যে তা নিংড়ায় এবং যার নির্দেশে নিংড়ায় তার উপর, আর যে ব্যাক্তি তা বহন করে এবং যার জন্য বহন করে সকলের উপর’ (আব‚ দাউদ: ৩৬৩৩)। মানুষের কাছে সবচেয়ে ম‚ল্যবান সম্পদ হচ্ছে তার বিবেক। যখন মানুষের বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে, তখন সে পশুর মত হয়ে যায়। একজন মাদকাসক্ত লোক নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে ব্যর্থ হয়। সে তার শারীরিক এবং মানসিক ভারসাম্যতা হারিয়ে উওম চরিত্রের সকল গুণাগুণ নষ্ট করার পাশাপাশি সর্বপ্রকার গুনাহে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বিধায় হাদীস শরীফে ‘মদের নাম রাখা হয়েছে (উম্মুল খাবায়েস) তথা সকল নিকৃষ্টতার ম‚ল’ (কানযুল উম্মাল, ৫ম খন্ড)। ঈমাম নাসাঈ হযরত ওসমান (রা.) হতে বর্ণনা করেন, হযরত ওসমান বলেন, ‘তোমরা মদ্যপান থেকে বিরত থাকো। কেননা এটি সকল অপরাধের ম‚ল। (তিনি এ সম্পর্কে একটি আশ্চর্য কাহিনী বর্ণনা করেন) তোমাদের পূর্বেকার যুগে একজন আবিদ লোক ছিল। এক ভ্রান্ত মহিলা তার পিছু লাগলো। লোকটির কাছে একজন দাসী প্রেরণ করল। দাসী আবিদ লোকটিকে বলল, আমরা আপনাকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে আহবান করছি। লোক দাসীর সাথে রওয়ানা হলো। এক ঘরে প্রবেশ করা মাত্র দাসী প্রতিটি দরজা বন্ধ করে দেয় । শেষ পর্যন্ত লোকটি উজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট মহিলার কাছে প্রবেশ করল, যার কাছে একজন যুবক ও একটি বড় মদের পাত্র ছিল। মহিলা বললো, আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি! আমি তোমাকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ডাকিনি, বরং ডেকেছি তুমি যেন আমার সাথে সহবাস কর। অথবা এখান থেকে এক পেয়ালা শরাব পান করবে, কিংবা এ যুবককে হত্যা করবে । লোকটি বলল, আমাকে এখান থেকে এক পেয়ালা শরাব পান করাও। আমি তাকে এক পেয়ালা মদ পান করালাম। সে বলল, আমাকে আরো বাড়িয়ে দাও তারা আরও বেশী দিল। শেষ পর্যন্ত সে মদ্যপান অবস্থায় মহিলার উপর পতিত হল এবং যুবককেও হত্যা করলো। হযরত ওসমান ( রা.) বলেন, মদ্যপান থেকে বিরত থাকো। কেননা আল্লাহর কসম, এটি খুবই নিকৃষ্ট । আল্লাহর শপৎ ঈমান ও সর্বদা মদ্যপান করা একত্রিত হতে পারে না। তাদের একজন অন্যজনকে বের করে দেয়’ (আন নাসায়ী, কুরতুবী, ৩য় খন্ড, পৃ.৫৫)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘রাস‚লুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন মদপানকারী ব্যক্তি কিয়ামতের দিন পিপাসার্ত অবস্থায় হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবে’ (কানযুল উম্মাল, ৫ম খন্ড)। পরিশেষে বলা যায় যে মাদকদ্রব্যাদি মানব সভ্যতার জন্য এক বিরাট অভিশাপ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন