সউদী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তেল সম্পদ সমৃদ্ধ দেশটির পরবর্তী কয়েক দশকের শাসক হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন। তবে এখন তার নেতৃত্বের পথটি কম্পমান।
ইস্তান্বুলে সউদী কনস্যুলেটের অভ্যন্তরে ওয়াশিংটন ভিত্তিক সউদী সাংবাদিক জামাল খাশোগির মৃত্যু পরবর্তী পরিস্থিতি প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে যে যুবরাজ সউদী আরবের সকল পর্যায়ে তার ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারবেন নাকি বাদশাহ সালমান ও অন্যান্য প্রতিদ্ব›দ্বীদের বাধার সম্মুখীন হবেন?
স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা সউদী শাসকদের সোচ্চার সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাশোগির মৃত্যুর কথা স্বীকার করতে সউদী আরব ১৭ দিন সময় নিয়েছে। খাশোগি যেদিন নিখোঁজ হন তার পরের দিন সউদী যুবরাজ ব্লমবার্গ নিউজকে বলেছিলেন যে খাশোগি নিজে থেকেই কনস্যুলেট ছেড়ে গেছেন। এখন সউদী সরকার বলছে যে তিনি কনস্যুলেটে যাদের সাথে কথা বলছিলেন সেটা মারামারিতে পরিণত হয়। সউদীরা বলছে, এ ব্যাপারে তদন্তের জন্য ১৮ জনকে আটক করা হয়েছে।
খাশোগির মৃত্যু, তার উপর নির্যাতন ও তাকে টুকরো টুকরো করে হত্যা বিষয়ক তুর্কি কর্তৃপক্ষের গোয়েন্দা তথ্য ফাঁসের মধ্যে সউদী আরবের কাছ থেকে বিলম্বে আসা জবাব সউদী আরবের আধুনিকায়ন সংস্কারক হিসেবে দেশে-বিদেশে মোহাম্মদ বিন সালমানের সুনাম মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
জর্জটাউন বিশ^বিদ্যালয়ের নিরাপত্তা গবেষণা কেন্দ্রের মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ পল সুলিভান বলেন, তিনি এমন চিন্তা করছেন যে নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে অবস্থান করে তিনি সম্ভাব্য পার পেয়ে যেতে পারেন। ধারণা করা হচ্ছে যে তার কর্তৃত্বের লাগাম টেনে ধরতে সউদী আরবের ক্ষমতা বলয়ের মধ্যে চাপ ও চেষ্টা ক্রমেই বাড়ছে।
৮২ বছর বয়স্ক বাদশাহ সালমান যদি তার পুত্রের ক্ষমতা খর্ব করেন তাহলে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা প্রশ্নের মুখে পড়বে। তার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে সউদী অর্থনীতির সংস্কার , পাশাপাশি তার আগ্রাসী পররাষ্ট্র নীতি যা সউদী আরবকে ইয়েমেনের সাথে যুদ্ধে জড়িয়েছে এবং কাতারের সাথে ক‚টনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিরোধ দীর্ঘায়িত করেছে।
বাদশাহ সালমানের সর্বশেষ পদক্ষপগুলো পাশ্চাত্যে এমবিএস নামে পরিচিত মোহাম্মদ বিন সালমানকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করেছে। তা হচ্ছে সউদী আরবের গোয়েন্দা সংস্থার পুনর্গঠনে গঠিত কমিটির দেখভালের দায়িত্ব যেটি খাশোগি হত্যার সাথে সম্পৃক্ত। ইউরেশিয়া গ্রুপ শুক্রবার রাতে এক রিপোর্টে বলে , বাদশাহ সালমান এখনো বিশ্বাস করেন যে তার বর্তমান উত্তরাধিকার রেখা যথাযথ।
ইউরেশিয়া বিশ্লেষক আয়হাম কামেল -এর রিপোর্ট মতে, এসব পদক্ষেপ সউদী নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক ইঙ্গিত হিসেবে দেখা যেতে পারে যে তারা সংশোধনের পথে যাচ্ছেন।
এ সংশোধন প্রচেষ্টা এটাই প্রদর্শন করছে যে মোহাম্মদ বিন সালমানকে যখন দেশের কার্যত শাসক হিসেবে মনে করা হচ্ছিল এ সময়েই বাদশাহ সালমান কঠোর হাতে সংকট সমাধান করতে হচ্ছে।
সিঙ্গাপুরে নানইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পন্ডিত জেমস এম ডোরসি বলেন, এমবিএসের ডানা আনুষ্ঠানিক ভাবে আটকে দিলে কি ঘটবে তা নিয়ে আমি সন্দিহান। রাজপরিবার ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাট টানাপড়েন রয়েছে যার অর্থ এ ভাবে চলতে পারে না। বাদশাহকে আরো অনেক দায়িত্ব নিতে হবে।
রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ কর্মকান্ড অনেকটা ব্ল্যাকবক্সের মত যে ব্যাপারে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব। সাধারণত কোনো সংকটের সময় রাজপরিবার ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করে। কিন্তু এবারই অন্যরকম দেখা যাচ্ছে। গত বছর ক্ষমার উপর নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে কথিত দুর্নীতি দমন অভিযানে শাহজাদাদের আটক ও রাজপরিবারের অন্যান্য জ্যেষ্ঠ সদস্যদের একপাশে সরিয়ে রাখার মাধ্যমে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান পরিারের অন্যান্য সদস্যদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মত অল্প কয়েকজন আছেন। তারা হচ্ছেনঃ এমবিএন নামে পরিচিত সাবেক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ এবং যুবরাজের ভাই শাহজাদা খালিদ। কিন্তু তারা তার বিকল্প নন বলে ধারণা। শাহজাদা খালিদ ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে সউদী রাষ্ট্রদূত। কিন্তু খাশোগি নিখোঁজের পরপরই তাকে দেশে ফেরত আনা হয়।
সউদী বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন গবেষক নেইল প্যাট্রিক বলেন, আমি উপযুক্ত বিকল্প দেখছি না। এমবিএনকে ফিরিয়ে আনা বাদশাহ সালমানের জন্য তিনি বাদশাহ হওয়ার পর যা নিষিদ্ধ করেছেন তাতে তার চরম ব্যর্থতাকে প্রকাশ করবে। অন্যদিকে যুবরাজের ছোট ও সহোদর ভাই শাহজাদা খালিদের নিয়োগ হবে এক বড় নিয়ম ভঙ্গের ইঙ্গিত এবং তাতে প্রশ্ন সৃষ্টি হতে পারে যে এমবিএন আসলে সরে গেছেন কিনা।
খাশোগির মৃত্যুর ব্যাপারে সউদী অনুসন্ধান ট্রাম্প প্রশাসনের উপর চাপ হ্রাস করবে না যদিও প্রেসিডেন্ট সে রিপোর্টকে বিশ্বাসযোগ্য বলেছেন। উভয় দলের আইন প্রণেতারাই সপ্তাহের গোড়ার দিকে রিয়াদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার হুমকি সউদী অনুসন্ধানের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন।
বৈদেশিক সম্পর্ক প্যানেলের সভাপতি রিপাবলিকান সিনেটর বব ক্রোকার টুইটারে বলেন, জামাল খাশোগির নিখোঁজের ব্যাপারে সউদীদের বক্তব্য রোজই পরিবর্তিত হচ্ছে , তাই আমরা তাদের সর্বশেষ গল্পও বিশ্বসযোগ্য বলে মনে হয় না।
সউদী রিপোর্ট বিশ্ব ও ব্যবসায়ী নেতাদের কাছেও বিশ্বাস হয়েছে বলে মনে হয় না। ব্যবসায়ীরা আগামী সপ্তাহ থেকে সে দেশের ভবিষ্যত বিনিয়োগ উদ্যোগ ফোরাম থেকে সরে আসছেন। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে যিনি সরে এসেছেন তিনি হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রী স্টিভেন মনুচিন।
খাশোগি হত্যার ঘটনার দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে যে এ সংকট মোহাম্মদ বিন সালমানের দ্রুত ক্ষমতায় আরোহণের পথকে মন্থর করে দিল। ২০১৭ সালে মোহাম্মদ বিন সালমান যুবরাজ হওয়ার পর তিনি দ্রুততার সাথে ক্ষমতা সংহত করতে শুরু করেন। তিনি গত বছর দুর্নীতি অভিযানে কয়েকজন শাহজাদাসহ স্থানীয় কয়েক ডজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীকে আটক করেন। পররাষ্ট্র বিষয়ে সউদী আরব কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ এবং জার্মানি ও কানাডার সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে যা বাণিজিক সম্পর্কে হুমকি সৃষ্টি করেছে।
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এখন মনে করতে পারেন যে ক্ষমতার উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর দিকে না গিয়ে পিতা বাদশাহর বৈধতার ব্যাপারে আরো ঝুঁকে পড়তে হবে।
প্যাট্রিক বলেন, এমবিএনের মৌন সম্মতিতে সউদী প্রচারণা বাদশাহ সালমানের সতর্কতাকে বৃদ্ধি করবে। এটা এবং সংশ্লিষ্ট সউদী নেতৃত্বের উপযুক্ত স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মত ব্যক্তির অভাব সম্ভবত যুবরাজ মোহাম্মদ সালমানের পতন রোধ করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন