অবশেষে সিলেটে পিছু হটলো সরকার। আমার যতদূর মনে পড়ে, বিগত ১০ বছরের শাসনামলে এবারই সর্ব প্রথম অনঢ় অবস্থান থেকে পিছু হটলো সরকার। সিলেটে জনসভা করার জন্য ৫/৬ দিন আগেই নিয়ম কানুন মেনে পুলিশের কাছে ২৩ অক্টোবর মঙ্গলবার রেজিস্টারি মাঠে জনসভা করার জন্য ঐক্যফ্রন্টের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। দু’দিন পরে পুলিশ টেলিফোন করে ঐক্যফ্রন্টের স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে জানায় যে, জনসভা অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া যাবে না। তখন পরদিন অর্থাৎ ২৪ অক্টোবর বুধবার জনসভা অনুষ্ঠানের জন্য আবেদন করা হয়। এবারেও সেই আবেদন নাকচ করা হয়। পরপর দুই বার আবেদন প্রত্যাখ্যান করার সপক্ষে পুলিশ তথা সরকার কোনো যুক্তি দেয়নি। অতীতে দেখা গেছে যে, বিএনপি যখন জনসমাবেশ করার জন্য পুলিশের কাছে আবেদন জানায় তখন পুলিশ সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে।
বিগত ১০ বছর ধরে বিশেষ করে বিগত ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে এপর্যন্ত পুলিশ তথা সরকার বিএনপির জনসভা করার আবেদন ধারাবাহিকভাবে প্রত্য্যাখান করে আসছে এবং বিএনপিও সেই প্রত্যাখ্যান মেনে নিয়েছে। পুলিশের এই প্রত্যাখ্যানের বিরুদ্ধে বিএনপি কোনোদিন রুখে দাঁড়ায়নি। এমনকি বলিষ্ঠ কোনো প্রতিবাদও করেনি। সরকারের এই কর্তৃত্ববাদী আচরণ বিএনপি বিগত ৫ বছর ধরেই হজম করে গেছে। দুই-চার বার পুলিশ অনুমতি দিলেও বিএনপি যে জায়গায় সভা করার অনুমতি চেয়েছে সেই জায়গায় অনুমতি না দিয়ে অন্য জায়গায় দিয়েছে। সেই অনুমোদনের সাথেও আবার লম্বা একটি শর্তের ফর্দ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই করা যাবে না, সেই করা যাবে না, ইত্যাদি। এমনও হয়েছে যে, সমাবেশ করার মাত্র ৫ ঘণ্টা আগে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই ৫ ঘণ্টার মধ্যে সভা অ্যারেঞ্জ করা, জনসমাগমের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি ছিল একটা অসম্ভব ব্যাপার। তারপরেও বিএনপি ঐসব অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক এবং কর্তৃত্ববাদী শর্ত মেনে নিয়ে সভা করেছে এবং সেই সভা লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে।
এত স্বল্প নোটিশে এত শর্তের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে বিএনপি যেসব সভা করেছে তা দেখে সরকার বিচলিত হয়ে গেছে। তাই পরবর্তীতে বিএনপি আর কোনো সভারই অনুমতি পায়নি। সরকারের আদেশ-নির্দেশ অমান্য করে বিএনপি কোনোদিন সভা-সমাবেশ বা মিছিল করেনি। কিন্তু সেই কাজটি এবার করেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। দ্বিতীয় বার যখন অনুমতির আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয় তখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা সিদ্ধান্ত নেন যে সরকার অনুমতি দিক আর নাই দিক, ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা ২৪ অক্টোবর বুধবার ঢাকা থেকে সিলেট যাবেন, হযরত শাহজালাল (রহ.) ও শাহ পরানের মাজার জিয়ারত করবেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এর পর তারা সভাস্থলের দিকে অগ্রসর হবেন। পথে যদি পুলিশ বাধা দেয় তাহলে রাস্তার ওপরে তারা দাঁড়িয়ে যাবেন এবং সেখানেই সভা করবেন। এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঐক্যফ্রন্টের নেতা কামাল হোসেন থেকে শুরু করে মির্জা ফখরুল, ব্যারিস্টার মওদুদ, আ স ম রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মনসুর, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সুব্রত চৌধুরী এবং মোস্তফা মহসিন সিলেট যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ঐক্যফ্রন্টের এই কঠোর সিদ্ধান্তের পর সমগ্র দেশবাসী বিশেষ করে শিক্ষিত সচেতন মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় ২৪ তারিখে ঐক্যফ্রন্ট নেতৃবৃন্দের সিলেট সফরের ওপর।
ঐক্যফ্রন্ট নেতৃবৃন্দের এই অনঢ় অবস্থানের পাশাপাশি সমাবেশ করতে কেন অনুমতি দেওয়া হবে না সেই মর্মে গত ২১ অক্টোবর রবিবার অপরাহ্নে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন করা হয়। এই রিট পিটিশন করার খবর রাষ্ট্র হওয়ার দুই ঘণ্টার মধ্যে সিলেট পুলিশ তথা সরকার ২৪ অক্টোবর জনসভা করার অনুমতি দেয়। অন্য কথায় সরকার অনুমতি দিতে বাধ্য হয়। এ ব্যাপারে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না ২১ অক্টোবর যমুনা টেলিভিশনের ‘রাজনীতি শীর্ষক টকশোতে বলেন, আমরা ২৪ তারিখ সিলেট যাবো এবং সমাবেশ করবো। দেখি সরকার কী করে।’ জেএসডির আসম রব বলেন, ‘আমরা বলেছি আমরা যেকোনো উপায়ে সিলেটে যাবোই। আমাদের যাওয়ার ঘোষণাটায় সরকার বুঝেছে, বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই, এই লড়াইয়ে জিততে হবে। কোনো চাপের কাছে, কোনো স্বৈরাচারী আচরণের কাছে মাথানত করবে না জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এটা বুঝতে পেরে সরকার সিলেটের জনসভার এই অনুমতি দিয়েছে। এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই তাদের এই শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ার জন্য। আমি আশা করি, আগামী ২৭ তারিখে চট্টগ্রামের জনসভারও তারা অনুমতি দেবে। রাজশাহীর জনসভার তারিখ ৩০ অক্টোবর থেকে পিছিয়ে ২ নভেম্বর করা হয়েছে।’
দুই
রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ বলছেন যে, ঐক্যফ্রন্টের অনঢ় অবস্থানের পটভূমিতে তাদেরকে জনসভা করার অনুমতি দানে সরকারের বাধ্য হওয়া দেশের রাজনীতিতে একটি টার্নিং পয়েন্ট। তারা এও মনে করেন যে, ক্রমাগত দুই দিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করে সরকার ঐক্যফ্রন্টকে একটি এসিড টেস্টে ফেলেছিল। সরকার ঐক্যফ্রন্টের নার্ভ টেস্ট করছিল। টেস্ট করতে গিয়ে দেখলো যে, ঐক্যফ্রন্টের নার্ভ স্টিল নার্ভ। আর ঐক্যফ্রন্টের নেতারাও সরকারের প্রত্যাখ্যানের মুখে লেজ গুটিয়ে পালাননি এই কারণে যে, তারা জনগণের পাল্স স্টাডি করতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ এখন জনসমর্থন কোন দিকে সেটি তারা সঠিকভাবেই স্টাডি করতে পেরেছিলেন। তাই তারা যখন কনভিনসড হলেন যে, দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জনসমর্থন এখন বিএনপির পেছনে এবং বিএনপি সলিডলি ঐক্যফ্রন্টের পেছনে তখন ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের আত্ম বিশ্বাস দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আমি বিগত দিনগুলিতে সিলেটে জনসভার প্রস্তুতি সম্পর্কে প্রতিদিন খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি। দেখেছি যে, এটি বিএনপির নিজস্ব জনসভা না হলেও স্থানীয় বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোটের নেতৃবৃন্দ এই জনসভাকে সফল করার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে।
তারপরেও ঐক্যফ্রন্টের নেতৃবৃন্দকে এবং সেই সুবাদে বিএনপি নেতৃবৃন্দের নার্ভাস ব্রেক ডাউনের মিটিংয়ের আগে কয়েকটি ঘটনা ঘটানো হয়। একটি ঘটনা হলো ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে নিয়ে একটি হই চই সৃষ্টি করা। এ ব্যাপারে সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করেছে একটি টেলিভিশন। এই টেলিভিশনটি অতীতেও সরকারের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, এরাব ঃযব ফড়ম ধ নধফ হধসব ধহফ যধহম রঃ. অর্থাৎ কুকুরটির নামে বদনাম ছড়াও এবং তাকে হত্যা করো। এই কাজটি অতীতে টেলিভিশনটি খুব দক্ষতার সাথে করেছে। ২০১৫ সালে তারা নাগরিক ঐক্য নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার কথিত ফোনালাপের অডিও বারবার প্রচার করে। দুই দিন ধরে অবিরাম প্রচার করার পর অভিজ্ঞ মহল যা বোঝার তা ঠিকই বুঝেছিলেন। দু’ দিন পর রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মাহমুদুর রহমান মান্না গ্রেফতার হন এবং ২৩ মাস কারাবাস করেন।
এবার কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন বিএনপি স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য, সাবেক মন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর কথিত ফোনালাপের অডিও একই কায়দায় প্রচার করা হয়। ঠিক একই কায়দায় আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এই মুহূর্তে কারাগারে। এটুকু করেই সরকার ক্ষান্ত হয়নি। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে ওই টেলিভিশন তার টকশোতে সংযুক্ত করে। সেখানে মাসুদা ভাট্টি কাহিনীর অবতারণা করা হয়। মাসুদা ভাট্টি একজন মহিলা সম্পর্কে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন যে উক্তিটি করেছিলেন সেব্যাপারে সেদিনই রাতে টেলিফোন করে তিনি তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। এছাড়াও তিনি অনুষ্ঠানের সঞ্চালক মিথিলা ফারজানার কাছে একটি চিঠি লেখেন এবং সে চিঠিতেও দুঃখ প্রকাশ করেন। এর মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ব্যারিস্টার মইনুলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তবে মইনুলও একজন সেলিব্রিটি। হাইকোর্ট তাকে আগামী ৫ মাসের জন্য আগাম জামিন দিয়েছে। সুতরাং এক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়েছে।
তিন
সরকারবিরোধী আর এক নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকেও সরকার টাইট দিতে চেষ্টা করেছে। এপর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে মোকদ্দমা জারির হিড়িক পড়ে গেছে। এর মধ্যে তার বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহের এবং একটি চাঁদাবাজির মামলা হয়েছে। এসব মামলা সত্য কি মিথ্যা সেগুলো মামলার রায় বের হলেই বোঝা যাবে। কিন্তু আর যাই হোক, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা কি শোভা পায়? যিনি মুক্তিযুদ্ধকালে ইংল্যান্ডের ডাক্তারি পড়া শেষ করে ভারতে আসেন এবং সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি কি রাষ্ট্রদ্রোহিতা করতে পারেন? মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলতে বলতে আওয়ামী লীগ মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে। যারা মুক্তিযুদ্ধের কথা এত বলছেন, স্ক্রুটিনি করলে দেখা যাবে, তাদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধের ধারেকাছেও যাননি। সেই তারাই এখন জাফরুল্লাহকে রাষ্ট্রদ্রোহী বানাচ্ছেন। আফসোস হয় যে, মুক্তিযুদ্ধ এবং রাষ্ট্রদ্রোহ শব্দ দুটিকে এরা অত্যন্ত হালকা এবং খেলো করে ফেলেছেন। জাফরুল্লাহ সুবিধাবাদী লোক নন। তাই কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা তিনি বলেন না। যারা উঠতে বসতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন, তারা মেহেরবানী করে বলুন তো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটি কী? এর সংজ্ঞাটি কী?
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি হয় দেশে নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তাহলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইয়ে নেমেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি হয় স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তাহলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সেই সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি হয় সর্ব প্রকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা তাহলে ঐক্যফ্রন্ট সেই কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণকে সংগঠিত করছে। সরকার যদি এই তিনটি লক্ষ্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালায় তাহলে ঐক্যফ্রন্টের সাথে তার রাজনৈতিক সংঘাতের কোনো সম্ভাবনা থাকবে না।
journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন