বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ক্ষতি ১৫শ’কোটি টাকা

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৪ দিনের যানজট : হাইওয়ে পুলিশের অবহেলাই মূল কারণ

মুন্সী কামাল আতাতুর্ক মিসেল, চান্দিনা (কুমিল্লা) থেকে | প্রকাশের সময় : ৬ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

অর্থনীতির লাইফলাইনখ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রতিদিন যানজট হচ্ছে। ৩ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত হলেও যাত্রী ও ব্যবসায়ীরা মুক্তি পাচ্ছেন না যানজটের দুর্বিসহ যন্ত্রণা থেকে। এতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথেই আটকে থাকছে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন। নষ্ট হচ্ছে শত শত কর্মঘণ্টা। গত কয়েক দিন ধরে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ মহাসড়কে যানজটের জন্য হাইওয়ে পুলিশের অবহেলাকেই দায়ী করেছে ভুক্তভোগিরা।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটে প্রতিদিন গড়ে ক্ষতির পরিমান কমপক্ষে ২৭৪ কোটি টাকা। অবশ্য এটি পুরনো হিসাব। বর্তমান হিসাবে এর পরিমান ৩শ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ২০১৫ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের সময় সড়ক ও জনপথ বিভাগের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটের কারণে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। আর যাতায়াতে সময় অপচয়ের কারণে যাত্রীদের ক্ষতি ১ হাজার কোটি টাকা। দুর্ঘটনা ও ভাঙাচোরা সড়কের কারণে যানবাহনের ক্ষতি ৫৭০ কোটি টাকা। এ ছাড়া যানজটে জ্বালানী অপচয় হয় ২ হাজার কোটি টাকা, পরিবেশগত ক্ষতি ১ হাজার কোটি, স্বাস্থ্যগত ক্ষতি ৩০০ কোটি ও অন্যান্য ক্ষতি ১০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে মোট ক্ষতি ৯ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। এ হিসাবে দিনে ক্ষতি ২৭৪ কোটি টাকা। এ হিসাবেও গত কয়েক দিনে ভয়াবহ যানজটে কমপক্ষে ১৫শ’ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়কটি অর্থনীতির সমৃদ্ধির জন্য কোনো কাজেই আসছে না। বরং এই চার লেন দিয়ে মালামাল আনানেয়া করতে গিয়ে যানজটের কারনে অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব পড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারন যাত্রী, পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। সাথে সীমাহীন ভোগান্তি তো আছেই। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ-এর এক শীর্ষ নেতা বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ভয়াবহ যানজটের কারনে ব্যবসায়ীরা অনেক সময় শিপমেন্টের মালামাল ফেরত এতে বিমানে পাঠাতে বাধ্য হয়। কোনো কোনো সময় শিপমেন্ট ধরানোই যায় না। তখন বিশাল লোকসান হয়। তিনি বলেন, চার লেনের এই মহাসড়ক যানজটের কারনে ব্যবসার ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসছে না।

যানজটের কারণ অনুসন্ধানের জন্য কয়েকদিন সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কুমিল্লা থেকে সকালে ঢাকায় রওনা দিলে কখনও পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা নেমেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের যানজট কখনো ৬ ঘন্টা, কখনো ৮ ঘন্টা আবার ১০ ঘন্টা ছাড়িয়ে যায়। যানজট লাগছে ৪০ কিংবা ৭০ কিলোমিটার জুড়ে।
অনুসন্ধানে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে নিয়মতি চলাচলকারী গাড়ীর মালিক, চালক, শ্রমিক, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, ছাত্র, শিক্ষক, হাইওয়ে পুলিশসহ একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়, মহাসড়কের যানজট সৃষ্টির জন্য যে কারণগুলো রয়েছে তার মধ্যে প্রধান কারন হলো মহাসড়কে কর্তব্যরত হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা। কামরুল ইসলাম নামের একজন স্কুল শিক্ষক বলেন, ঢাকা-দাউদকান্দির রোডের কিছু বাস দাউদকান্দি হাইওয়ে পুলিশকে প্রতি গাড়ী ১৫০ টাকা উৎকোচ দিয়ে গৌরীপুর চৌরাস্তার মোড়ে এসে যাত্রীর অপেক্ষায় মহাসড়কের উপরে দীর্ঘক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখে। এতে করে ওই স্থানে যানজটের সৃষ্টি হয়। ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে মত গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে অতিরিক্ত মালবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, যাত্রীবিহীন বাস মহাসড়কের উভয়পাশে দাঁড় করিয়ে রাখার কারনেও নির্ধারিত গতিতে যানবাহন চলতে পারে না। হাইওয়ে পুলিশ ইচ্ছা করলেই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। বরং মহাসড়কে বিভিন্ন যানবাহন থামিয়ে কাগজপত্র ও অবৈধ মালামাল চেকিংয়ের নামে হাইওয়ে পুলিশ যানজটের ভয়াবহতা বাড়িয়ে দেয় বলে একাধিক বাস চালক অভিযোগ করেন। গৌরীপুর মুন্সী ফজলুল রহমান কলেছের একাদশ শ্রেনীর ছাত্রীর আসমা বলেন দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক বাস ( লোকাল বাস ) পাপিয়া, হোমনা, সাচার, পায়রা, মেঘনা পরিবহনসহ ফিটনেসবিহীন মিনি ও বড়বাসগুলো মহাসড়কের উপরে মাঝখানে পুলিশের সামনেই দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠা-নামা করানো হয়। এতে করে যানজটের সৃষ্টি হয়। নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের সদস্য মতিন বলেন, গাড়ির গতিবেগ মেপে অতিরিক্ত গতির জন্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হাইওয়ে পুলিশকে স্পিডগান সরবরাহ করেছে সরকার। কিন্তু অভিযোগ হচ্ছে, পুলিশ সেটা নিয়িমিত ব্যবহার করে না। এছাড়াও অতিরিক্ত গতি ও বেপরোয়া যানবাহন চালানোর পেছনে চারটি বড় কারণ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে চালকের প্রশিক্ষণের অভাব, চালকের স্থায়ী নিয়োগের বদলে যাত্রার ওপর বেতন নির্ধারণ, শাস্তির অপ্রতুলতা এবং হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা। এতে করে যানজটের পাশাপাশি দুর্ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। তবে হাইওয়ে পুলিশের দাবি ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে যে কয়জন ট্রাফিক পুলিশ ডিউটি করছে তা যানবাহন ও যানজটের তুলনায় সংখ্যায় খুবই কম। এছাড়া অধিকাংশ যানজট লাগে দুর্ঘটনা ও বেহাল রাস্তার কারণে। দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ি সরাতে সময় লেগে যায়। তখন পেছনের দিকে বিমাল যানজটের সৃষ্টি হয়।
গত ৩ নভেম্বর রয়েল কোচে করে কুমিল্লা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে মহাসড়কের রায়পুরে এসে যানজটে আটকা পড়েন ব্যবসায়ী কামরুজ্জামান। বাস থেমে থেমে চলার কারণে দীর্ঘ ৮ ঘন্টায় ঢাকায় পৌঁছান তিনি। ওই যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, হাইওয়ে পুলিশের গাফিলতির আর দায়িত্ব অবহেলার কারনে গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। একটা গাড়ির কারনে যানজট লাগলে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ক্রমে তা ভয়াবহ আকার ধারন করে। চট্রগ্রাম থেকে ঢাকাগামী শ্যামলী পরিবহনের যাত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, হাইওয়ে পুলিশ ইচ্ছা করলেই মহাসড়ক সবসময় যানজটমুক্ত রাখতে পারে। অথচ তারা দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, হাইওয়ে পুলিশ যানজট নিরসনের চেষ্টা না করে মহাসড়কের পাশে চা দোকানে বসে খোশগল্প করছে।
এদিকে, যানবাহন নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে চলাচলের লক্ষ্যে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের পাশে বিভিন্ন স্থানে ২১ টি হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি ও হাইওয়ে থানা স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু হাইওয়ে পুলিশ রাস্তার পাশে এবং ওপরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা দোকান, হাটবাজার অবৈধ স্ট্যান্ড, এলোপাথারিভাবে গাড়ি রেখে যাত্রী উঠানো-নামানো বন্ধ করতে পারেনি। প্রায় প্রতিদিনই দাউদকান্দির শহীদনগর, গৌরীপুর, রায়পুর, চান্দিনা উপজেলার কুটুম্বপুর, মাধাইয়া, বাগুর, কাঠেরপুল, হাড়িখোলা, বুড়িচংয়ের নিমসার, কালাকচুয়া মহাসড়কের পাশে হাটবাজার ও রিকশা-গাড়ির স্ট্যান্ডের কারনে যানজট লেগেই থাকছে। সেদিকে পুলিশের কোনো নজর নেই।
প্রতিনিয়ত যানজট প্রসঙ্গে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলী মোফাজ্জল হায়দার বলেন, সরু রাস্তা বা গাড়ির সংখ্যার কারণে কখনও যানজট হয় না। যানজটের প্রধান কারণ ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট। মহাসড়কে অযান্ত্রিক যানবাহন চলতে দেয়া উচিত নয়। রাস্তা দিয়ে হঠাৎ করে মানুষ পার হতে গেলে কিংবা গাড়ি ইউটার্ন নিতে গেলে দ্রুতগামী গাড়ির গতি কমে, দুর্ঘটনা ঘটে।
তিনি বলেন, যানজট নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশের শিথিলতা অনেকাংশে দায়ী। বাজার পয়েন্টগুলোতে মূল সড়কের উপর গাড়ি লোড-আনলোড করা হচ্ছে। বাসষ্ট্যান্ড থাকার পরও সেখানে গাড়ি থামানো হচ্ছে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা বন্ধ করতে হবে। ওই কর্মকর্তা বলেন, যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য হাইওয়ে পুলিশকে সওজের অধীনে দেয়া উচিত। এতে সঠিক তত্ত্বাবধান থাকবে এবং যানজট নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
যানজটের নিরসনে হাইওয়ে পুলিশ সার্বক্ষণিক তৎপর রয়েছে বলে দাবী করে হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা রিজিওনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ ইনকিলাবকে বলেন, দুর্ঘটনার কারণে মাঝে মধ্যে যানজট হলেও পুলিশ তা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, মহাসড়কে গাড়ি থামিয়ে চাঁদাবাজি হয় এমন কোনো অভিযোগ পাইনি। পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন