আমাশয়ের সমস্যার মধ্যে একটি হলো আইবি এস বা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম। এটি অন্ত্র ও পরিপাক তন্ত্রের একটি জটিল সমস্যা। এটি একটি যন্ত্রণাদায়ক রোগ। হঠাৎ পেটে কামড় তারপর সাথে সাথে মলত্যাগ করা জরুরী। এ রোগে পেট অধিকতর স্পর্শকাতর হয় বলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল থাকে। পাশ্চাত্য দেশে প্রতি ১০ জনে একজন অন্তত তার জীবদ্দশায় এরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। সমীক্ষায় দেখা যায়, একটি দেশের লোক সংখ্যার ২০ শতাংশ আই বি এসের লক্ষণ বহন করে এবং ১০ শতাংশ ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। পুরুষদের চেয়ে নারীরা দুই থেকে তিন গুণ বেশি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। অন্ত্রের ক্যান্সারের সাথে এ রোগের মিল পাওয়া যায়। তবে আই বি এস হতে ক্যান্সারের সৃষ্টি হয় না।
আই বি এস কি? : সিনড্রোম শব্দের অভিধানিক অর্থ হল একটি রোগের বিভিন্ন উপসর্গ। তাই আই বি এসকে পেটের বিভিন্ন উপসর্গের সংঙ্গা হিসেবে ধরা হয়। মানবদেহে অন্ত্র ও খাদ্য নালী মাংসপেশী দ্বারা তৈরী টিউব বা নল। এই মাংসপেশীর যখন অতিরিক্ত সংকোচন ও প্রসারণ হয় তখন অন্ত্রের মধ্যে থাকা ও মলের গতি ব্যাহত হয়। এরপর পালাক্রমে শুরু হয় কোষ্টকাটিন্য বা ডায়রিয়া।
আই বি এসের কারণ কি? : আই বি এস প্রকৃত কারণ এ পর্যন্ত জানা যায় নি। অনেক কারণে এ রোগ হয় বলে চিকিৎসার আন্তর্নিহিত কারণ উদঘাটন সম্ভব হয় নি। তবে বিজ্ঞানীরা কারণও প্রভাবক হিসেবে অনেক বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন। সেগুলোকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ -
শারীরবৃত্তীয় কারণঃ এর মধ্যে অন্ত্রনালীর বেশি স্পর্শকাতরতা, অন্ত্রনালীর অস্বাভাবিক নাড়াচাড়া, এলার্জি ও ইনফেকশন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ গম ও দুধ জাতীয় খাবার সহ্যক্ষমতা কম অর্থাৎ এ জাতীয় খাবার খাওয়ার পরই আমাশয়ের সমস্যা তথা আই বি এস শুরু হয়।
মনোসামাজিক কারণঃ এ সমস্যায় প্রথমেই আছে হতাশ ও দুশ্চিন্তা ইত্যাদি। এছাড়া অধিক মানসিক চাপ ও আই বি এস কে প্রভাবিত করে থাকে। আই বি এসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অল্প সমস্যা হলেই মানসিকভাবে দুশ্চিন্তা গ্রস্থ হয়ে পড়ে ফলে তারা পরিস্থিতি সহজে মানিয়ে নিতে পারে না।
এছাড়া খাদ্যাভ্যাস, অন্ত্রের প্রদাহ, অন্ত্রের সংক্রমণ, মাদক গ্রহণ, পেটের অপারেশন, বংশগত কারণ, হরমোন জনিত কারণ বিশেষ করে মহিলাদের মাসিক চক্রের সমস্যা এবং অনেক সময় এন্টিবায়েটিক সহ অনেক ঔষুধ সেবন ও আই বি এসের সমস্যাকে ত্বরান্বিত করে।
আই বি এস কোন বয়সে হয়ঃ এরোগে পুরুষ ও মহিলা উভয়ই ভূগে থাকেন। পুরুষের তুলনায় মহিলারা আনুপাতিক হারে বেশী ভুগে থাকেন। এটি সাধারণত ১৮-৪০ বছরের মহিলা ও পুরুষের মধ্যে রোগের উপসর্গ দেখা দেয়।
উপসর্গ বা লক্ষণবলীঃ পাতলা পায়খানা ও কোষ্টকাঠিন্য উভয়ই দেখা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছু দিন কোষ্টকাঠিন্য আবার কিছু দিন পাতলা পায়খানা হচ্ছে। তবে কোনটি বেশী হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে আই বি এসকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়। কোষ্টকাঠিন্য প্রধান এবং আমাশয় প্রধান। এসব ক্ষেত্রে নিন্মোক্ত উপসর্গাদি দেখা যায়।
পেটে ভূটভাট শব্দ হয়।
যাদের কোষ্টকাঠিন্য তাদের পেট ব্যথার সাথে ছোট ছোট কষ্টকর মলত্যাগ।
আমাশয় প্রধান আই বি এসে ঘন ঘন কিন্তু অল্প পরিমাণ পায়খানা হয়। এক্ষেত্রে ওজন ঠিক থাকে। আর মলের সাথে আম যায়। রক্ত যায় না।
খাদ্য গ্রহণের পরে পেটে অশান্তি বোধ এবং পেট ফুলে যায়।।
ডায়রিয়া সাধারণতঃ সকালে মলত্যাগের সময় হয়ে থাকে।
পিচ্ছিল পদার্থ যা চর্বিযুক্ত মলত্যাগ।
মলত্যাগের পরও মলত্যাগের ইচ্ছা অনুভব।
এ সমস্যাগুলো ৬ মাসের বেশী সময় থাকলে চিকিৎসকরা আই বি এস হয়েছে বলে সন্দেহ করে। এছাড়াও যাদের এ সমস্যা আছে, তারা পোলাও, কোর্মা, বিরিয়ানি, তেহারী ইত্যাদি তেলযুক্ত খাবার এবং দুধ, দই, দুধ-চা, পায়েস, সেমাই ইত্যাদি খাবার খেলেই পেট খারাপ হয়ে পড়ে। আমাদের দেশে লিভার সেন্টারের গবেষণা হতে দেখা গেছে যেসব রোগীর দীর্ঘমেয়াদি লিভার প্রদাহ থাকে এবং ফ্যাটি লিভার থাকে তাদের অধিকাংশই কোন না কোন সময় আই বি এসে আক্রান্ত হয়। আবার যেসব রোগীর পায়খানার অভ্যাসের পরিবর্তন, পেট ফোলা, পেটে ব্যাথা, পেটে শব্দ, খাদ্য হজমে সমস্যা নিয়ে আসে তাদের অধিকাংশই পরবর্তীতে লিভার সিরোসিস ধরা পড়ে।
বলা বাহুল্য যে, বমিভাব, বমি, ঢেকুর ওঠা, ক্ষুধামন্দা, ঘাম হওয়া, মাথাব্যাথা, অনিদ্রা, জ্ঞান হারানো, রক্ত মিশ্রিত পায়খানা এগুলো আই বি এসের উপসর্গ হিসেবে সুনির্দিষ্ট নয়। উপসর্গগুলো কয়েক দিন, কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাসও থাকতে পারে। যদিও উপসর্গগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে ঘটে থাকে।
রোগ নির্ণয়ঃ আই বি এস সাধারণত উপসর্গের উপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা হয়। তবে আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য নিন্মোক্ত পরীক্ষাগুলো করা প্রয়োজন। মল পরীক্ষা, পেটের এক্স-রে, রক্ত পরীক্ষা, বেরিয়াম এনেমা, কলোনোস্কোপি ইত্যাদি।
চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনাঃ আই বি এস সাধারণত উপসর্গভিত্তিক রোগ আর এর চিকিৎসাও উপসর্গানুসারে প্রদান করা হয়। আই বি এস এর উপসর্গগুলো কমানোর জন্য বাজারে নানা রকম ঔষধ আছে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কোন ঔষধ খাওয়া উচিৎ নয়।।
ঔষধ খাওয়ার আগে আপনার রোগ সম্পর্কে চিকিৎসকের নিকট বিস্তারিত বলুন। আই বি এস একটি নিয়ন্ত্রণ যোগ্য রোগ।
খাদ্যভ্যাসঃ আঁশযুক্ত খাবার আই বি এসকে প্রতিহত করে। ধীরে ধীরে আঁশযুক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
শাকজাতীয় যে সব খাবার গ্যাস উদ্রেক করে তা বর্জন করতে হবে।
দুধ ও দুধ জাতীয় খাবার রোগীর উপসর্গ বাড়িয়ে দেয়। তাই এগুলো পরিহার করতে হবে।
চর্বিযুক্ত খাবার, তৈলাক্ত খাবার ও ভাজাপোড়া খাবার বর্জন করতে হবে।
অতিরিক্ত মশলাযুক্ত ও গুরুপাক খাবার বর্জন করতে হবে।
ইসবগুলের ভূষি ও অন্য আঁশযুক্ত খাবার গ্রহন করতে হবে।
মানসিক চাপের সাথে সম্পর্কযুক্তঃ
মানসিক চাপ কমাতে হবে। সহনীয় পর্যায়ের মানসিক চাপ মানুষকে উদ্বিগ্ন করে কিন্তু অসহনীয় মানসিক চাপ মানুষকে বিষাদগ্রস্থ করে, ফলে আই বি এসের উপসর্গাদি দেখা দেয়।
আই বি এস হতে মুক্তি পেতে হলে মানসিক চাপ কমাতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে মানসিক চাপ কমানো যায় না তবে আয়ত্বের মধ্যে রাখা সম্ভব। মানসিক চাপ কমানোর জন্য ব্যায়াম একটি উপকারী প্রভাবক। তাই ব্যায়াম করতে এবং মনকে আনন্দ ও প্রশান্তি দিতে পারে এমন কিছু করতে হবে। রিলাক্সেশন থেরাপি, হিপনোথেরাপি, বায়োফিতব্যাক মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানো সম্ভব।
আই বি এস একটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। তাই এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য রোগীর মানসিক শক্তি ও নিয়ন্ত্রণ জীবনযাত্রায় যথেষ্ট। এক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক একটি উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি। তাই হোমিওপ্যাথিক বিধান মতে ঔষুধ সেবনে আই বি এস হতে সুস্থ হওয়া সম্ভব। আই বি এস রোগীদের সুস্থ থাকতে হলে একজন অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের শরনাপন্ন হয়ে চিকিৎসা গ্রহন করতে হবে।
ডাঃ মোঃ হুমায়ন কবীর
রেনেসা হোমিও মেডিকেয়ার
৮৯, নিমতলী সিটি কর্পোরেশন মার্কেট
চাঁনখারপুল, ঢাকা।
০১৭১৭৪৬১৪৫০, ০১৯১২৭৯২৮৯৪
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন