সম্পদ উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হলো ব্যবসা-বাণিজ্য। মানবসম্প্রদায় প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে একে অপরের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণ করে আসছে। কিন্তু এ ব্যবসা-বাণিজ্যে নীতি-নৈতিকতার অভাবে সবসময় একটি শ্রেণী প্রতারিত হচ্ছে, অপরদিকে যারা অনৈতিক পন্থায় সম্পদের পাহাড় গড়ছে তারা সাময়িক সফলতা পেলেও হারাচ্ছে সম্মান ও মান-মর্যাদা। যার কারণে সমাজে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করছে ও সমাজে দেখা দিচ্ছে বিশৃঙখলা ও অরাজগতা । আর এ সকল অরাজগতা ও বিশৃঙখল অবস্থা দূর করার জন্য ইসলাম সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে: “আর হে আমার জাতি, ন্যায়নিষ্ঠার সাথে ঠিকভাবে পরিমাপ কর ও আর ওজন দাও এবং লোকদের জিনিসপত্রে কোন রূপ ক্ষতি করো না, আর পৃথিবীতে ফাসাদ করে সীমাঅতিক্রম করো না(সূরা হুদ:৮৫)”। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হওয়ায় প্রত্যেকের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাাতিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতিসহ সকল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছে। এ বিধান যারা পালন করবে তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মান ও কল্যাণের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। ইসলামী শরীয়তে ইবাদাত কবূলের পূর্ব শর্ত হিসেবে পবিত্র রিযিক গ্রহণ আবশ্যক করা হয়েছে। আর পবিত্র রিযিক অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হলো ব্যবসা-বাণিজ্য। ইসলামী বিধি-বিধান অনুযায়ী ব্যবসা পরিচালনার জন্য আল-কুরআন ও হাদিসে বিভিন্ন বিধি-বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্যা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের প্রতি দয়ালু (আল কুরআন, সূরা নিসা:২৯)।” ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য পৃথিবী পরিভ্রমণের উল্লেখ করে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে যে, “তিনিই তো তোমাদের জন্যে ভূমিকে সুগম করে দিয়েছেন, অতএব তোমরা দিক-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তাঁর প্রদত্ত জীবনোপকরণ হতে আহর্য গ্রহণ কর; পুনরুত্থান তো তাঁরই নিকট(সূরা মুলক-১৫)।” যারা সততার সাথে ইসলামী বিধি-বিধান অনুযায়ী ব্যবসা পরিচালনা করে তাদের বিশেষ মর্যাদা ও পুরষ্কারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল-কুরআনে সৎ ব্যবসায়ীর বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে ইরশাদ করা হয়েছে যে, “অতএব তোমরা মাপ ও ওজন পূর্ণ কর এবং মানুষকে তাদের দ্রব্যাদি কম দিয়ো না এবং ভূপৃষ্ঠে সংস্কার সাধন করার পর তাতে অনর্থ সৃষ্টি করো না। এই হল তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও (সূরা আরাফ-৮৫)।” অন্যস্থানে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,“নামায সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও (সূরা জুমআ:১০)।”। এ ভারসাম্য জীবন ব্যবস্থা হচ্ছে জীবনেরই প্রয়োজনে কাজ, পরিশ্রম, প্রচেষ্ঠা ও উপার্জন এবং মাঝে মাঝে মন ও আত্মাকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে আল্লাহর স্মরণ ও মহব্বতে নিমগ্ন করে দেয়া। অন্তর ও আত্মাকে জীবিত রাখার জন্য এই পদ্ধতি অত্যন্ত জরুরী। এ পদ্ধতি ব্যতীত আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও তাঁর দেয়া আমানতের বোঝা বহন করা সম্ভব নয়। রোজগারের জন্য আল্লাহ তাআলার স্মরণ অতীব জরুরী। এই স্মরণের কারণে যা কিছু কর্ম করা হয় এবং আয় রোজগারের যে চেষ্টা চালানো হয়, তা সব কিছুই ইবাদতে পরিণত হয়। যে সকল ব্যবসায়ী ইসলামী বিধি-বিধান পালন করে থাকে, আল্লাহ তাদের জীবিকা বৃদ্ধি করেন এবং প্রাপ্যের অধিক সফলতা প্রদান করে থাকেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, “সেই সব লোক, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হতে এবং নামায কায়েম ও যাকাত প্রদান হতে বিরত রাখে না, তারা ভয় করে সেই দিনকে যেই দিন তাদের অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। যাতে তারা যে কর্ম করে তজ্জন্যে আল্লাহ তাদেরকে উত্তম পুরস্কার দেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাদের প্রাপ্যের অধিক দেন; আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবিকা দান করেন(সূরা আন নূর:৩৭)।” আল্লাহ তা‘আলা নিজেকে তাদের অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করেছেন যারা ব্যবসা পরিচালনায় বিশ্বাসঘাতকতা না করে। এ বিষয়ে হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “রাসূল সাঃ বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেছেন- যতক্ষণ দু‘জন শরীকদার ব্যবসায়ে একে অপরের সাথে খিয়ানত (বিশ্বাসঘাতকতা) না করে ততক্ষণ আমি তাদের তৃতীয় শরীক হিসেবে (তাদের সহযোগিতা করতে) থাকি। অতঃপর যখন খিয়ানত করে, তখন আমি তাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে যাই (তারা আমার সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়)( আবূ দাউদ, কিতাবুল বায়ুয়, বাব মা জা আ ফি শিরকাতি )।” সৎ ব্যবসায়ীর বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তারা পণ্যের যদি কোন দোষ-ত্রুটি থাকে তবে তা উল্লেখ করবে এবং এ সততার কারণে তারা বরকত প্রাপ্ত হবে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত রয়েছে যে,“হযরত হাকীম ইবনে হিযাম রাঃ সূত্রে নবী করীম সাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ক্রেতা ও বিক্রেতার জন্যে পরস্পর পৃথক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত খিয়ার থাকবে। উভয়ে যদি সত্য কথা বলে এবং দোষত্রুটি বলে দেয় তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত হবে। আর যদি তারা ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে, তবে ততে বরকত থাকবে না (মুসলিম, কিতাবুল বুয়ূ, আত-তুজ্জার ওয়া তাসমিয়াতুন নাবিয়্যি স.(।” আরো একটি হাদিসে পণ্যের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে যে, আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাঃ একটা খাদ্য- স্তুপের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে তাঁর হাত তাতে প্রবেশ করালেন। ফলে তাঁর আঙ্গুলে কিছু ভিজা অনুভূত হল। তারপর তিনি বললেন, হে খাদ্য বিক্রেতা এ আবার কি? লোকটি বললেন হে আল্লাহর রাসূল, ওতে বৃষ্টি পেয়েছে। তিনি বললেন, কেন তুমি ঐ ভেজা অংশটাকে উপরে রাখলে না- তাহলে লোকে তা দেখতে পেত। যে ধোকাবাজী করে (কেনা-বেচা করে) সে আমাদের নীতিতে নয় (মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, মান গাশশা ফালাইসা মিননা)।” ইসলামে সৎ ব্যবসায়ীদের মুজাহিদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, “হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত, নবী সাঃ বলেছেন: বিধবা ও মিসকিনদের জন্য উপার্জনকারী ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদরত ব্যক্তির মতো। আর যারা রাত্রিতে নফল ইবাদত করে ও দিনে রোযা রাখে তাদের সমতুল্য (ইবনে মাজাহ, কিতাবুত তিজরা, আল হাসসি আলাল মাকাসিব)।” আর সৎ ব্যবসায়ী নিজের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সততা অলম্বন করে থাকে। আর যারা নিজের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করে হাদিসে তাদেরকে মুজাহিদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে “রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন, ঐ ব্যক্তি পরিপূর্ণ মুজাহিদ, যে আল্লাহর অনুগত হয়ে আপন প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করে থাকে (আল জামিউল কাবীর, হাদীস নং ১২৪৭)।” রাসূল সাঃ এর এ ওয়াদার মাধ্যমে সৎ ব্যবসায়ীরা আল্লাহর কাছে মুজাহিদের উচ্চ মর্যাদা লাভ করবে এবং পরকালে তাদের জন্যে হবে এই বিশেষ পুরষ্কার। কেননা, ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে প্রায়ই লোভ ও লালসার দাসত্বে পরিণত হতে দেখা যায়। আর এ ব্যবসা যে কোন উপায়ে মুনাফা লুণ্ঠনের প্রবণতা প্রকট করে থাকে । আর ধন সৃষ্টি করে, মুনাফা আরও মুনাফা লাভের জন্যে মানুষকে প্ররোচিত করে। কিন্তু যে ব্যবসায়ী সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও বিশ্বস্ততা রক্ষা করে তার ব্যবসা পরিচালনা করে, সে তো অবশ্যই জিহাদকারী ব্যক্তি। কেননা সে প্রতিনিয়ত লোভ-লালসার মুকাবিলা করে চলছে। অতএব মুজাহিদের মর্যাদা তার জন্যে খুবই শোভনীয় এবং বাঞ্ছনীয়। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় ব্যবসায়ে সততা প্রতিষ্ঠার জন্য সৎ ব্যবসায়ীর মর্যাদা আরো বৃদ্ধি করেছে। দুনিয়াতে সৎ ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন মর্যাদা ও সফলতা প্রাপ্তির পর কিয়ামতের ময়দানে তাদেরকে অসৎ ব্যবসায়ীদের থেকে পৃথক করে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হবে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, “হযরত রিফা’আ রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমরা আল্লাহর রাসূল সা: এর সঙ্গে বের হলাম। তিনি দেখতে পেলেন, লোকেরা সকাল বেলা বেচাকেনা করছে। তখন তিনি তাদের এই বলে ডাকলেন: হে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়! তারা যখন চোখ তুলে ও ঘাড় উঁচু করে দেখল, তখন তিনি বললেন: ব্যবসায়ীদের কিয়ামতের দিন পাপীদের সাথে উঠান হবে। তবে তারা ছাড়া, যারা আল্লাহকে ভয় করে, সততার সাথে ব্যবসা করে ও সত্য কথা বলে (ইবনে মাজাহ, আত্বাকওয়া ফিত তিজারাহ, কিতাবুত তিজারাহ)।” শেষ বিচারের দিন সৎ ব্যবসায়ীরা আরশের নিচে স্থান পাবে এবং নবী, সিদ্দীক ও শহীদদের কাতারে থাকবে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে যে,“আল্লাহর রাসূল সাঃ বলেছেন: বিশ্বস্ত সত্যবাবাদী মুসলিম ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন শহীদের সাথে থাকবে। (ইবনে মাজাহ, কিতাবুত তিজরা, আল হাসসি আলাল মাকাসিব) ” ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যে সরলতা প্রদর্শনে নিদের্শনা দিয়েছে এবং যারা সরলতা প্রদর্শন করে তাদেরকে জান্নাতবাসী হিসেবে উল্লেখ কারা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে যে, “আল্লাহর রাসূল সাঃ বলেন: বেচাকেনার সময় যে সরলতা প্রকাশ করে, আল্লাহ তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন(ইবনে মাজাহ, কিতাবুত তিজারাহ, আস সামাহাতু ফিল বায়)।” আর এ ভাবে ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা ও শৃঙখলা আনায়নে সততার সাথে ব্যবসা পরিচালনার জন্য বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছে এবং সৎ ব্যবসায়ীদের তাদের প্রতিদান স্বরূপ উভয় জগতে বিশেষ মর্যাদার ঘোষণা দিয়েছে। আর এ সকল বিধি-বিধান পালনের মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক সাম্যপ্রতিষ্ঠা হবে এবং ব্যবসায়ীরা উচ্চ মর্যাদার আসনে সমাসীন হবেন,ইনশাআল্লাহ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন