আকাশী রঙের টি শার্টটা গায়ে চড়িয়ে প্রতিদিনের অভ্যাসগত স্টাইলে চুলের ভিতর আঙ্গুল চালাতে চালাতে অন্বেষা কে ডাকলো শ্রাবন-
: এক কাপ চা হবে অনু? শ্রাবন আদর করে অনু বলে ডাকে।
ভিতর থেকে মিষ্টি করে জবাব দেয় অনু - আসছি।
ভারি মিষ্টি। বিয়ে হয়েছে বছর তিনেক, তার আট সাট দেহের বাঁকে বাঁকে দুরন্ত যৌবন আছড়ে পড়েছে। ঢেউ খেলানো ঘনকালো কেশ নিতম্বের নিচ অবধি ঝরে পড়েছে অবলীলায়। পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম আভাটুকু যেন তাকে আরও মোহময় করে তোলে।
শ্রাবনের ভালবাসার গন্ডিটাকে ঠিকমত বুঝে উঠতে পারে না অন্বেষা।
: এই নাও তোমার চা। তা কোথায় চললে এখন?
: একটুখানি সামনে যাব। চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিতে দিতে বলল শ্রাবন।
বিরক্ত হয় অন্বেষা। মাঝে মাঝে ওর ভিতরে গড়ে ওঠা ভালবাসার নীড়টুকু যেন ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যায়। বুঝতে পারে শ্রাবন। চোখদুটো টলমল করছে ওর। বুকের কাছে টেনে নিয়ে একটু আদর করে, এভাবেই মাঝে মাঝে ওকে ম্যানেজ করতে হয় শ্রাবনের। ওকে সময় দেয়া দরকার। কারণ ওযে....... ।
ইদানিং ওর সন্দেহটা বেড়েছে।
শ্রাবন আর অন্বেষার বয়স ও শিক্ষার ঢের ব্যবধান। তবু ও একজন আরেকজন কে পাগলের মত ভালবাসে।
কিš‘ স্মার্ট ফোন আর ফেসবুকে আটকে থাকা শ্রাবন কে মোটেই নিজের মনে হয়না তার।
স্বল্পবুদ্ধির সুন্দরী অন্বেষা সন্ধ্যায় ফ্রেশ হয়, সাজু গুজু করে। লাল টকটকে বেগি হাতার ব্লাউজের কার্ণিশ গলে যেন যৌবনের উৎক্ষিপ্ত লাবণ্য ছিটকে পড়ে।
মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে ধাক্কা দিতে দিতে বেরিয়ে পড়ল শ্রাবন। মাঝারি গড়নের চাপা রঙের এই মানুষটির বয়স বোঝা মুশকিল।
অল্প বয়সী বউটা ও যেন তার বয়স টাকে কমিয়ে দিয়েছে পনের বছর।
মোটামুটি ঘনবসতি পূর্ণ শহরের গলি দিয়ে হাটতে হাটতে শুনতে পেল দুর থেকে একটি গানের সুর ভেসে আসছে-
‘কইও কইও কইও ভ্রমর কৃষ্ণরে বুঝাইয়া’
অসম্ভব মিষ্টি গানটি আর ও স্পষ্ট হতে লাগলো। মোহময়ী এক মুগ্ধতায় এই সুর তার শিরায় শিরায় ভাইরাল হয়ে যায়।
ঠিকানা ও বাড়ি নং অনুযায়ী একটি তিন তলা বাড়ির সিঁড়িতে পা রাখল শ্রাবন।
তিনতলা থেকে ভেসে আসা গানটি ও পরিণতির দিকে। কি‘ সেই কইও কইও ......... ‹ এটা তার মাথার ভিতর থেকে হৃদপিন্ড পর্যন্ত আপ ডাউন করতে লাগল।
রসায়নে মাস্টার্স ছেলেটির রস বোধের ঘাটতি কতটা আছে সেই ভাল জানে।
গান তখনো চলছে-
‘তোমার রাধা মইরা গেছে গো কৃষ্ণ হারা হইয়ারে
ভ্রমর কইও গিয়া।’
তিন তলার সিঁড়িতে পা দিয়েই খক খক করে কেসে উঠল শ্রাবন। ধুপ ধুনার পাত্রটি অজান্তেই কে যেন তার নাকের কাছে ধরেছে।
নিজেকে সামলে নিয়ে পরিচয় দিল শ্রাবন।
এস এস সি পড়ুয়া একটি মেয়েকে প্রাইভেট পড়াতে এসেছে সে,কথা হয়েছে তার বাবার সঙ্গে।
হারমোনিয়ামটা তুলতে তুলতে বর্ষা ভাবল কোথায় যেন তাকে দেখেছে সে। তাইতো - সেদিন ট্রেনের একই বগিতে দেখেছিল তাকে। সেই চেক নীল শার্ট, জোড়া ভ্রু ইত্যাদি, হ্যা তিনিই তো।
জড়তা ভেঙ্গে শ্রাবন জিজ্ঞেস করল-
: কি নাম তোমার?
: বর্ষা বর্ষা বসু।
: আমি শ্রাবন, বলে নিজের পরিচয় টা দিল মাত্র।
আজও রাত করে বাড়ি ফিরল শ্রাবন।বউ জানেনা যে কয়েকটা হোম টিউশন করে তাকে খরচের ঘাটতি কমাতে হয়।
হাতে মুখে জল দিয়ে সটান শুয়ে পড়ল সে।
: এই শুনছ? ওঠো খেয়ে নাও।
: ধ্যাততারি,ডিস্টার্ব করনাতো, আমি খাবনা, আমার ক্ষিধে নেই।
সন্দেহ আরও বাড়তে থাকে অন্বেষার।
ও আর জোর করে না। শ্রাবন ঘুমিয়ে পড়লে ও তার মোবাইলটা নিয়ে ঘাটতে থাকে। কল লিস্ট থেকে শুরু করে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, অটো রেকর্ডার ইত্যাদি।
হঠাৎ একটা নতুন নাম্বার চোখে পড়ে। আগে কখনও দেখেনি এটা। কিছুটা বুদ্ধিমতির পরিচয় দিয়ে observation এ থাকল আর নিরবে নিভৃতে চোখের জলে বুক ভাসালো সে।
শ্রাবন বুঝতেই পারলনা একটি মেয়ে তার জন্য অহর্ণিশ কেঁদে চলেছে।
প্রায় বছর খানেক পার হয়েছে, বর্ষার উন্নতিটাও হয়েছে যথেষ্ট।
ওদিকে ভেতরে ভেতরে কল্পনার স্রোতে ভেসে চলেছে বর্ষা। শ্রাবন কোনদিকে খেয়াল করেনা, কিš‘ বর্ষা খেয়াল করে - স্যার আজ কি শার্ট পরে এসেছে, কোন গেঞ্জিটা পরলে বেশি স্মার্ট লাগে ইত্যাদি।
ও জানে শ্রাবন মুসলমান, তবুও জাত পাতের তোয়াক্কা না করে সে তার অজান্তেই শ্রাবন কে ভালবেসে ফেলে।
ওদিকে শ্রাবন বর্ষার মিষ্টি গানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, এমন মেয়ে হাজারেও একটা হয়না,গল্প দেয় অন্বেষার সাথে। হিংসা হয় অন্বেষার।
পরীক্ষা শেষ। তবুও মাঝে মধ্যে শ্রাবন যায়, এটা ওটা দেখায়, পরামর্শ দেয়। অনেকটা বাড়ির একজন সদস্যের মতই। সবাই তাকে অসম্ভব ভালবাসে। বর্ষার কথা নাইবা বললাম,সে তো শ্রাবন অন্ত প্রাণ। শ্রাবন ও তার গান শোনে, তার অনুষ্ঠানে যায়, আরও বেশি মুগ্ধ হয় সে, বুকের কোনে লুকিয়ে রাখা ভালবাসা টুকু আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
একদিন একটা আমন্ত্রণ পত্র দেখালো বর্ষা।শ্রাবনের সেকি আনন্দ!
মনিরামপুরের ভাসমান সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গান গাইবে বর্ষা। ও গান জানেনা, কিš‘ বর্ষার গানগুলো তার হৃদয়ের পরতে পরতে এক অবচৈতনিক পরশ বুলিয়ে যায়।
বর্ষা জানে শ্রাবন তার অনুষ্ঠানে গান শুনতে যাবে। ভাসমান সেতু আর কি? সে তো তার হৃদয়ে শ্রাবন কে ভালবাসার এক বিশাল পদ্মা সেতু বানিয়ে তাতে ডেকোরেশন দিচ্ছে। সে শুধু শ্রাবনকেই মুগ্ধ করতে যাচ্ছে।
একদম জিরো ফিগার। এলো মেলো ঝকঝকে দাঁত গুলো থেকে ঝরঝরে হাসি নেমে আসে। ভারি মিষ্টি,চটপটে আর যেন ভয়ংকর সুন্দর সে।
শ্রাবনের সংসারে নতুন সদস্য কয়েকমাস হলো। ভাবলো অন্বেষাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসা যাক।
: চল তোমাকে আজ ভাসমান সেতু দেখাতে নিয়ে যাব।
ভিষণ আনন্দ পেল অন্বেষা, অনেকদিন পর যেন সে শ্রাবন কে তার কাছে ফিরে পেল!
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান চলছে। সঙ্গীত একাডেমির সবচেয়ে মেধাবী, সকলের প্রিয় বর্ষা এখন মঞ্চে।
মাইক্রোফোন হাতে মঞ্চে এসে দাড়াল বর্ষা, করতালিতে ফেটে পড়ছে চারপাশ। একটার পর একটা গান শেষ হয়, আবার অনুরোধ, আবার গান। কি‘ কোথায় শ্রাবন? কোথাও তো নেই।
চোখ দুটো টলমল করছে বর্ষার, এবার তার শেষ গান। সেই রাধারমনের গান-
‘কইও কইও কইও ভ্রমর কৃষ্ণ রে বুঝাইয়া
তোমার রাধা মইরা গেছে গো কৃষ্ণ হারা হইয়া রে
ভ্রমর কইও গিয়া’
গাইছে আর দর দর করে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে তার।
নাহ! এমন তো হতে পারেনা। হাজারো দর্শকের চোখ বর্ষার দিকে আর বর্ষা কাকে যেন খুজছে আর খুজছে।
হঠাৎ ভাসমান ব্রিজের উপরে তার চোখ আটকে গেল। হ্যা ওই তো শ্রাবন! মঞ্চ থেকে একটু দুরে - শ্রাবন, একটি ফুটফুটে বাচ্চা আর একটি সুন্দরী মহিলা মঞ্চের উল্টো দিকে মুখ করে একে অপরের ঘাড়ে হাত দিয়ে সেলফি তুলছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন