ইলেকশনের আর মাত্র ৩২ দিন বাকি। আজ ২৭ নভেম্বর মঙ্গলবার। তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে ৮ নভেম্বর বৃহস্পতিবার। এর মধ্যে ১৯ দিন পার হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীতে যেটা হয় বাংলাদেশেও সেটাই হওয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ তফসিল ঘোষণার দিন থেকে রাজনীতি এবং নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। রাজনৈতিক কারণে কাউকে গ্রেফতার করা হয় না, রাজনৈতিক কারণে যারা আটক তাদেরকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশেও সেটিই হবে বলে অভিজ্ঞ মানুষরা ধারণা করেছিলেন। কিন্তু সেই ধারণাও মিথ্যা হলো। নমিনেশন পেপার দাখিলের পূর্ব মুহূর্তে বিরোধীদলের বিশেষ করে বিএনপির শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতাই নন, যারা নির্বাচনে দাঁড়াবেন বলে ফরম কিনেছিলেন এবং প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাদেরও কাউকে কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে। চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ৫/৬ দিন আগে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। তিনি ইলেকশনে দাঁড়ানোর সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এবং বিএনপি নেতা এহসানুল হক মিলন নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার জন্য বিদেশ থেকে ঢাকা আসেন। ঢাকা আসার পর থেকেই তার মাথার ওপর গ্রেফতারের খড়গ ঝুলছিলো। অবশেষে তিনি গ্রেফতার হন।
এছাড়াও তফসিল ঘোষণার পরে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা সাইফুদ্দিন মণি, তুখোড় বক্তা এবং ক্ষুরধার যুক্তির অধিকারী শেখ রবিউল আলমকে সেদিন গ্রেফতার করা হয়েছে। এরা সকলেই নির্বাচনে বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের সম্ভাব্য প্রাথী ছিলেন। বিএনপিতে যে কজন তরুণ মহিলা নেতা রয়েছেন তাদের মধ্যে নিপুন রায় চৌধুরী অন্যতম। একজন এ্যাডভোকেট হওয়া সত্বেও তিনি ছিলেন মাঠকর্মী। যেমন সাহসী তেমনি টেলিভিশন টকশোতে অকুতোভয়ে কথা বলতেন। তাকে গ্রেফতার করে ৫ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ড শেষে এখন তিনি কারাগারে। এই সরকারের রাজনৈতিক দমননীতি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের বিরুদ্ধে মুখর সমালোচক ছিলেন ব্যরিষ্টার মইনুল হোসেন। টেলিভিশন টকশোতে একটি মন্তব্যের কারণে তিনি এখন কারাগারে। প্রথমে তাকে গ্রেফতার করা হয় মানহানির অভিযোগে। পরে ডিজিটাল নিরাপত্তার আইনে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। আজও তিনি কারাগারে। আজ যদি তিনি কারাগারের বাইরে থাকতেন তাহলে একজন প্রার্থী হতেন এবং বর্তমান সরকারের একজন কঠোর সমালোচক হতেন। বিএনপি নেতা ব্যরিষ্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াও নির্বাচনের আগের মুহূর্তে কারাগারে। তার বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করার যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটির ফয়সালা অনেক আগেই করা যেতো। অথবা ইলেকশনের পরে করা যেতো। সেটি না করে ইলেকশনের ঠিক ৩৬ দিন আগে তাকে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
যাদের নাম এতক্ষণ বলা হলো তাদের মধ্যে নিপুন রায় ছাড়া অন্য সকলে বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোটের সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন। আর একজন হলেন জহির উদ্দিন স্বপন । তিনিও সম্ভাব্য প্রার্থী। কিন্তু প্রাণ ভয়ে তিনি এলাকায় যেতে পারছেন না। তিনি অভিযোগ করেছেন যে, তার নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রকাশ্য জনসভায় হুমকি দিয়েছেন যে, স্বপন যদি এলাকায় আসে তাহলে তার জীবন বিপন্ন হবে। যাদের নাম বলা হলো তারা সকলেই আইনের প্রটেকশন চেয়েছিলেন। কেউ পুলিশের নিকট থেকে, কেউ নির্বাচন কমিশনের নিকট থেকে। কিন্ত কেউ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। বিচারের বানী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে।
এই হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবস্থা। বিরোধীদলসমূহকে একদিকে উপেক্ষা করা এবং অন্যদিকে তাদের ওপর জুলুমের স্টিম রোলার চালানোর এমন নজির পৃথিবীতে বিরল। এমন একটি ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নির্বাচন হচ্ছে। এই পরিস্থিতি অবলোকন করে দেশের একাধিক সুধী ব্যক্তি সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম করে বলছেন যে, নির্বাচন হয়তো অংশগ্রহণ মূলক হবে। কিন্তু সেটি যে অবাধ,সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে সেব্যাপারে কেউই নিশ্চিত নন। লেভেল প্লেইং ফিল্ডের কথা বহু দিন থেকেই বিরোধীদল বলে আসছে। এখন দেখা যাচ্ছে, তফসিল ঘোষণার পর মাঠের অবস্থায় খেলার জন্য সমতল তো নয়ই, বরং দিনের পর দিন সেটি অসমতল হচ্ছে। এর মধ্য দিয়েও বিরোধীদল নির্বাচন করছে এবং নেতারা বলছেন যে, যতই বাধা বিপত্তি আসুক, যতই দমন-পীড়ন হোক, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা নির্বাচনের মাঠে থেকে যাবেন। শত প্রতিকূলতার মুখেও তারা মাঠ ছেড়ে যাবেন না।
দুই
লেভেল প্লেইং ফিল্ড, সকলকে সমান সুযোগ দেওয়া, গায়েবি মামলা, রিমান্ড, জেল-জুলুম এসব কথা এতদিন বলে আসছিলো বিরোধীদল বিশেষ করে বিএনপি। যারা বিএনপির নন এবং এই তো কিছু দিন আগেও আওয়ামী ঘরানায় ছিলেন তারাও এখন ঐসব বক্তব্য বলিষ্ঠভাবে দিচ্ছেন। ব্যরিষ্টার আমিরুল ইসলাম এতদিন পর্যন্ত একজন প্রবীণ আওয়ামী লীগার ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আমলে তিনি একজন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। এছাড়া তিনি সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতিও ছিলেন। সেই আমিরুল ইসলাম গত ২৪ নভেম্বর শনিবার এক সেমিনারে বলেছেন, ‘পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রশাসন রাজনৈতিক দলের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের এখানে আইনের শাসন অনুপস্থিত। এক্সিকিউটিভ পাওয়ার পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং এর কোনো একাউন্টিবিলিটি বা দায়বদ্ধতা নেই।’ নির্বাচনের এই সময়েও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন আমীর উল ইসলাম। এই অভিযোগটি নিয়মিত করে আসছে বিএনপি। আমীর উল ইসলাম বলেন, ‘কোর্টে এখনও গেলে আপনারা পাবেন হাজারেরও বেশি লোক জামিন নেওয়ার অপেক্ষায় আছে। এখন মানুষ নির্বাচন করবে, নাকি বেইল নেবে, নাকি জেলে যাবে? এখনও মানুষকে ঘরছাড়া করা হচ্ছে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে পাঁচ বছর আগে নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি এবার ভোটে গেলেও দলীয় সরকারের অধীনে এই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে তার। পুলিশ ও প্রশাসনে দলীয়করণের অভিযোগ তুলে শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি দাবি জানিয়েছে দলের নেতারা। তবে তাদের এ দাবি খারিজ করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ব্যরিষ্টার আমীর উল ইসলাম আরও বলেন, ‘পত্রিকায় দেখেছি সিইসি নাকি পুলিশকে বলেছে, আপনার সম্ভাব্য প্রিজাইডিং অফিসারদের তথ্য সংগ্রহ করার জন্য তাদের বাড়িতে বাড়িতে কেন যাচ্ছেন, যা করবেন চুপচাপ করবেন। তাহলে কারা প্রিজাইডিং অফিসার হবে এবং হবে না সেটাও ওখানে সিদ্ধান্ত হচ্ছে? ইভিএম কি জিনিস আমি তো বুঝি না। ইভিএম কোম্পানিটা কোথাকার সেটাও জানি না। এটা কি এমআরআই মেশিনের মতো কোনো মেশিন নাকি? আমি এর সম্পর্কে কিছুই জানি না।’
সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে সাধারণ মানুষ কোনো রকম পুলিশি হয়রানিতে পড়বে না, সেই ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি কি না? নিচে কেন তারা কোনো জামিন পাচ্ছে না, সুপ্রিমকোর্ট-হাইকোর্টে বেইল নিতে আসছে। পরিস্থিতি এখন এ রকম। ইতিহাস বলে নির্বাচন হচ্ছে মুক্তির পথ।’
তিন
গত ২৫ নভেম্বর মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সন্মেলনে ড. কামাল হোসেন অভিযোগ করেছেন যে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থতার অভিযোগে তিনি তার পদত্যাগ দাবি করেছেন। ওই সংবাদ সন্মেলনে তিনি বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভূমিকা নিরপেক্ষ হচ্ছে না। তাই তার জায়গায় অন্য কাউকে নিয়োগ দেওয়া হোক। আর তা না হলে আমরা আইনি পদক্ষেপ নেব।’ ড. কামাল বলেন, ‘যারা আদিষ্ট হয়ে কাজ করে তারা সংবিধান লঙ্ঘন করছে। এদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।’ গণফোরাম সভাপতি বলেন, ‘অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব। এ জন্য চারদিকে নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকতে হবে। রাষ্ট্রের মালিক ভেবে জনগণকে ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার নানা অগণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। বিনা কারণে, বিনা অপরাধে গ্রেফতার, অন্তরীণ চলছে। আমরা সুশাসন চাই, গণতন্ত্র চাই। সুষ্ঠুভাবে জনগণ যাতে ভোট দিতে পারে সেই পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে। পুলিশ এক্ষেত্রে সুন্দর ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা যদি নিজেদের সরকারের বাহিনী না ভেবে রাষ্ট্রের বাহিনী মনে করে তাহলেই তা সম্ভব। এতদিন যা হয়েছে আমরা তা মেনে নিয়েছি। এখন থেকে নির্বাচনে লেভেল প্লেইয়িং ফিল্ডের জন্য যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সরকারকে নিতে হবে। তা না হলে আমরা কঠিন পদক্ষেপ নেব।’
নির্বাচন কমিশন শুধু মাত্র যে ব্যর্থ তাই নয়, তারা এখন ঐক্যফ্রন্ট বিশেষ করে বিএনপির বিপক্ষ শক্তির ভূূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলাল উদ্দিন বলেছেন যে, বিএনপি নাকি নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে। তিনি বিএনপিকে এই ভূমিকা থেকে বিরত থাকার আহবান জানান। প্রিয় পাঠক, চিন্তা করুন, কতখানি পক্ষপাত দুষ্ট হলে নির্বাচন কমিশনের এমন একজন সিনিয়র অফিসার দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটির বিরুদ্ধে এমন বক্তব্য দিতে পারেন। হেলাল উদ্দিন নিজ থেকে কিছু বলেননি। তিনি সিইসি থেকে আদিষ্ট হয়েই একথা বলেছেন। তাই ড. কামাল হোসেন সঠিক ভাবেই সিইসির পরিবর্তন দাবি করেছেন। ইলেকশন কমিশন বা ইসি তো বিরোধী দলের কোনো কথাই গায়ে মাখছে না। প্রথমে বিরোধী দল তফসিল পেছানোর দাবি করেছিল। আওয়ামী লীগ বললো, এক ঘন্টাও পেছানো যাবে না। ইসি সেটাই করলো। বিরোধী দল বলেছে, ইভিএম ব্যবহার করা যাবে না। সিইসিও কিছু দিন আগে বলেছিলেন, যে সব দল না চাইলে ইভএম ব্যবহার করা হবে না। এখন বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলীয় জোট ইভিএম চায় না। কিন্তু তার পরেও ৬টি নির্বাচনী এলাকাতে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে। যেভাবে এখনও গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং মামলা দেওয়া হচ্ছে সেগুলো ইসিকে টাইম টু টাইম অবহিত করা হচ্ছে। একবার নয়, দুই বার বিএনপির প্রতিনিধি দল ইসি অফিসে গিয়ে তাদেরকে দুটি তালিকা দিয়েছে। এই দুটি তালিকায় গায়েবি মামলা ও গ্রেফতার এবং সর্বশেষ গ্রেফতার সম্পর্কেও খুটিনাটি তথ্য রয়েছে। কিন্তু ইসি মনে হয় সেগুলি খুলেও দেখেনি। বিএনপি কতিপয় পুলিশ অফিসার এবং কিছু সিভিল অফিসারের একটি তালিকা দিয়েছে। বিএনপি দাবি করেছে, এরা প্রকাশ্যে সরকারের পক্ষে কাজ করছে । এদেরকে সরিয়ে দেওয়া হোক। আওয়ামী লীগ দাবি করেছে, নির্বাচনের আগে কোনো প্রশাসনিক রদবদল চলবে না। সিইসি সেই দাবিই মেনে নিয়েছে। তিনি ডিসি এবং এসপিদেরকে বলেছেন, আপনাদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নাই। আপনাদের বদলি করা হবে না।
আর কত উদাহরণ দেবো? প্রতিদিনই এক বা একাধিক ঘটনা ঘটছে যেখানে ইসি আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করছে। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়, এবার অংশ গ্রহণমূলক নির্বাচন হচ্ছে, কিন্তু অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হচ্ছে না। লেভেল প্লেইং ফিল্ড তো চুলায় উঠেছে। তারপরেও বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট হতোদ্যম নয়। চারিদিকে আছড়ে পড়া গণজোয়ার। বিরোধী দলের বিপুল জনপ্রিয়তা যেন সমুদ্রউত্তাল জনতাতরঙ্গ। এই জনতা তরঙ্গ কি বালির বাঁধ দিয়ে ঠেকানো সম্ভব?
journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন