শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা

রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে ঘোষণা দাবি

হাসান সোহেল : | প্রকাশের সময় : ৪ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

একটি কারখানার চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক শহিদুল হক। দৈনিক মজুরি হিসেবে যে অর্থ পান, তা দিয়ে কোনোরকমে খাওয়া-পরা চলে। ছোটখাটো অসুখে ওষুধপত্রের অর্থ জোগাতে যার হিমশিম অবস্থা, সেই শহিদুলের হঠাৎ ধরা পড়ে হৃদরোগ। এ রোগের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারে খরচ হয় বড় অঙ্কের অর্থ, যা জোগাড় হয়েছে পরিচিতজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে। সামর্থ্যের অতিরিক্ত চিকিৎসা ব্যয় দরিদ্র শহিদুলকে নিয়ে গেছে অতিদরিদ্রের কাতারে।
কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা এলাকার আলী হোসেন মস্তিস্কজনিত সমস্যা নিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে আসেন। চিকিৎসক তাকে দেখার পর এমআরআই, রক্তসহ ছয়টি পরীক্ষা দেন। বাধ্য হয়েই তিনি ওই পরীক্ষাগুলো করান। এতে তার ১৮ হাজার টাকা চলে যায়। এভাবে শুধু শহিদুল হক আর আলী হোসেনই নন, তাদের মতো অনেক মানুষকেই অতি দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে অতিরিক্ত স্বাস্থ্য ব্যয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, অতিরিক্ত চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ দরিদ্র হচ্ছে। চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে সাড়ে ৪ শতাংশ মানুষ। ১৫ শতাংশ পরিবার অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে বছরে প্রায় ৬৪ লাখ মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টের তথ্য অনুযায়ী, চিকিৎসা নিতে গিয়ে একজন মানুষের পকেট থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ টাকা ব্যয় হচ্ছে। যার মধ্যে ৬৭ শতাংশই হয় ওষুধপত্রে। অথচ জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৭টি উদ্দেশ্যের অন্যতম হচ্ছে সবার জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা।
শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষাই নয়, ওষুধের অস্বাভাবিক মূল্য, চিকিৎসকদের অস্বাভাবিক ফি, রোগ নির্ণয়ে কমিশন বাণিজ্য, রেফারেল পদ্ধতি না থাকা, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ, নিয়ন্ত্রণহীন বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, ওষুধ কোম্পানীর আগ্রাসী বাণিজ্য ও চিকিৎসকদের অনুপ্রাণিত করা, দালালের দৌরাত্ম্য ও সর্বোপরি অব্যবস্থাপনায় মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশের ৪০ ভাগ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা হলেও ৫০ ভাগ মানুষ এখনো ভালো মানের স্বাস্থ্যসেবা পায় না। অপরদিকে, দেশে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যব্যয় দিনকে দিন বাড়ছে। এ অবস্থায় সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ) বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে বীমা পলিসি বাস্তবায়নের আহ্বান জানান তারা। বর্তমানে দেশে সংসদ নির্বাচনের উত্তাপ বিরাজ করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহার প্রণয়নের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সে ইশতেহারে আগামী পাঁচ বছরে স্বাস্থ্যখাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ইশতেহারে সুনির্দিষ্ট ঘোষণারও আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
দেশের চিকিৎসা ব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ওষুধের দাম, অপারেশন খরচ, প্যাথলজি ফি, চিকিৎসকের ভিজিট এই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ অবস্থায় বেসরকারি খাতকে একটি নীতিমালার আওতায় আনার সুপারিশ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডীন প্রফেসর ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবাকে রাজধানীর বাইরে নিয়ে যেতে হবে। এজন্য জেলা ও উপজেলা শহরগুলোয় গড়ে তুলতে হবে পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। উপজেলায় যদি অন্তত ১০০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল গড়ে তোলা যায় তাহলে চিকিৎসার ভোগান্তি অনেক কমে যাবে। সেখানে মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, শিশু এরকম গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ সেবার ব্যবস্থাও করতে হবে। এছাড়া জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে স্বাস্থ্যবীমা চালু করতে হবে। এর আগে একাধিকবার স্বাস্থ্য বীমা নিয়ে আলোচনা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি প্রফেসর ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, নির্বাচনী ইশতেহার করার প্রথম কথা হচ্ছে স্বীকার করে নেওয়া যে, আমরা এই কাজগুলো করব। এরপর এই কাজগুলো বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা। স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বাড়াতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে এই বিষয়গুলো থাকা দরকার।
ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, চিকিৎসক, নার্স, প্যারামেডিকসসহ জনবল বাড়াতে হবে। বেসরকারি খাতে শৃঙ্খলা নেই, সেটি শৃঙ্খলায় আনতে হবে। একই সঙ্গে জনগণ ও চিকিৎসকের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে, সেটি নিরসনে প্রক্রিয়াগতভাবে রোগীদের কাউন্সেলিং হিসেবে নতুন উপাদান যোগ করতে হবে এবং এটি নিয়মিত চালিয়ে যেতে হবে। চিকিৎসকদের জবাবদিহি করার জন্য একটা ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি প্রফেসর ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, স্বাস্থ্য বাজেট বাড়ানোর বিষয়ে আমাদের আকাক্সক্ষার একটি প্রতিশ্রুতি নির্বাচনী ইশতেহারে রাখা দরকার। স্বাস্থ্য খাতে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, সেবা, এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনিক যে অবকাঠামোগুলো এবং মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চয়তার জন্য প্রাইমারি হেলথ কেয়ার বিষয়গুলো অর্জনে যেসব কর্মপদ্ধতি আছে, সেই কর্মপদ্ধতি ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের বিষয়টি থাকতে হবে।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও পেশেন্ট ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ডা. রাকিবুল ইসলাম লিটু বলেন, মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা সবচেয়ে জরুরি। কিন্তু দেশে রোগীর তুলনায় চিকিৎসাসেবায় জনবল অনেক কম। তাই সুষ্ঠু স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে দক্ষ, মেধাবী ও আন্তরিক চিকিৎসক, নার্স এবং স্টাফ নিয়োগ দিতে হবে। তিনি বলেন, গুণগত সেবা বৃদ্ধিতে নজর দিতে হবে। তাই চিকিৎসক ও নার্সদের দক্ষ করে তুলতে চিকিৎসা শিক্ষা আরও বেশি ব্যবহারিকনির্ভর করতে হবে। চিকিৎসাসেবা প্রদানকারীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে না পারলে স্বাস্থ্যসেবার মান প্রশ্নবিদ্ধ হবে। দেশের জনগণের পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত না হলে পিছিয়ে পড়বে দেশের অর্থনীতি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা প্রফেসর ডা. মোজাহেরুল হক স্বাস্থ্যসেবার জন্য আমাদের পাশ্ববর্তী দেশেও বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেমন নেপালে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ হিসেবে হৃদপিন্ডের ভাল্ব প্রতিস্থাপন বিনামূল্যে করে দেয়া হয়। ক্যান্সার রোগী হলেই সরকার তাকে ৫ লাখ টাকা দেয়। একই সঙ্গে কিডনি বিকল রোগীদের ডায়ালাইসিস করতে কোনো অর্থ খরচ করতে হয় না। এভাবে নেপালে স্বাস্থ্য সেবার মান বাড়ছে। প্রফেসর মোজাহেরুল হক বলেন, সম্প্রতি ভারতে বয়োবৃদ্ধ নাগরিকদের ১৫ লাখ রুপির একটি ফিক্সড ডিপোজিট করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। হতদরিদ্র মানুষ সরকার থেকে পাবে ৫ লাখ টাকা। সরকারের এ উদ্যোগের ফলে সেখানে দরিদ্ররা আর দরিদ্র হবে না। কিন্তু বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হচ্ছে এবং মধ্যবিত্তরাও পরিণত হচ্ছে দরিদ্রে। তাই ইশতেহারে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বীমার আওতায় আনার কথা বলেন। এক্ষেত্রে হতদরিদ্রদের বীমার প্রিমিয়াম সরকারীভাবে দেয়ার কথাও বলেন তিনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন