নবুওয়াতের একাদশ বছর। রজব মাসের সাতাশ তারিখ। শান্ত রজনী। কোথাও কোন সাড়া-শব্দ নেই। নীরব নিস্তব্ধ পৃথিবী। পুরো আকাশে ঝিকিমিকি তারারা যেন আজ নব অতিথির আগমন সংবাদে নিঃশব্দে বচনে বিস্তর সমীহের ছন্দ গেয়ে চলছে। অন্থহীন আবেগ নিয়ে কোন এক মহান সত্তার অপেক্ষায় উৎসুক আর কৌতূহল নেত্রে তাকিয়ে আছে ঊর্ধ্ব জগৎ। অপূর্ব আয়োজন যেন আজ ধরণীর বক্ষে হতে চলেছে সমগ্র প্রকৃতির মাঝে ঝিরঝির করে বয়ে চলছে শান্তির অফুরান হিমেল হাওয়া। পৃথিবীর বয়সে হয়ত এত প্রেমময় রাত নামেনি। এত উৎসবের রোল উঠেনি কখনও মরুর রাজনীতে।
আজ বিশ্বস্রষ্টা তার হাবিবের সঙ্গে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির সঙ্গে অতিসংগোপনে মিলিত হতে চান। নীরবে নিভৃতে অতি কাছে টেনে সৃষ্টির রহস্য অবগত করাতে চান। তাই ‘বুরাক’ দিয়ে হজরত জিবরাইল (আ.) ও হজরত মিকাইল (আ.) মারফত ডেকে পাঠিয়েছেন প্রিয়নবী (সা.)- কে। তখন তিনি চাচাতো বোন উম্মে হানীর গৃহে গভীর ঘুমে বিভোর। স্বর্গীয় দুতদ্বয় এসেই বিপুল সংকোচবোধ অতি জড়সড় ও সুবিনীত পদচুম্মনে জাগিয়ে তুললেন রাসুল (সা.) কে। অনন্তর বিনয় বিগলিত কণ্ঠে মহান প্রভুর আমন্ত্রণ ব্যক্ত করে নবীজিকে সৌরভ মাখা আবেদন জানালেন ভ্রমণ প্রস্তুতির। তারপর তাকে কাবার হাতীমে নিয়ে গেলেন এবং বক্ষ বিদীর্ণপূর্বক জমজমের স্বচ্ছ ও পবিত্র বারিধারায় বিধৌত করলেন তার অন্তরাত্মাকে। ইমান, একিন ,হিকমত ও এলাহি তাজাল্লীর স্বর্ণালী ঐশ্বর্যে কনায় কনায় ভরে দিলেন তার সত্যপ্রেমী হৃদয়ের প্রতিটি রন্ধ্রে।
শুরু হল সফর। ধন্য হলেন জিবরাইল ও মিকাইল (আ.) মহান অতিথির সহযাত্রীর গৌরব অর্জনে। গতির ধাপে ধাপে বাতাসের তালে তালে এগিয়ে চলছে বুরাক। ইয়াসরিব, সিনাই পর্বত, বাইতে লাহামের প্রান্ত ছুঁয়ে ছুয়ে অবশেষে এসে পৌঁছলেন জেরুজালেমস্থিত মসজিদে আকসায়। যেমনটি ইরশাদ হচ্ছে, ‘পবিত্র সেই সত্তা যিনি একান্ত প্রিয় বান্দাকে রজনীকালে মসজিদে হারাম থেকে সেই মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করালেন যার চতুষ্পার্শে আমি বরকতমন্ডিত করেছি। (সুরা বনী ইসরাইল: ০১)।
সেখানে অন্থহীন ব্যাকুলতা আর অতৃপ্তি তৃষ্ণা নিয়ে প্রতিক্ষা করছিলেন পূর্বতীর সকল নবী-রাসুল ও ফেরেশতাদের এক বিশাল কাফেলা পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মানুষটির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। মসজিদে আকসায় অবতরণ করে অদূরে একটি বড় প্রস্তরখণ্ডের সঙ্গে বেধে রাখলেন বুরাকটি। অবসান ঘটলো প্রতিক্ষার। ফুলের চারপাশে মৌমাছি ভিড় করার মতই চারদিক ঘিরে জমায়েত হলেন সকল উম্মতের নেতৃবর্গ আম্বিয়ায় কেরাম।
এদিকে জিবরাইল (আ.)- এর কণ্ঠস্বরের তালে তালে ধ্বনিত হল আজানের সুমধুর ধ্বনি ‘আল্লাহু আঁকবার আল্লাহু আঁকবার’। আজান শেষ হল। সবাই কাতারবন্দি হয়ে বুকের মাঝে পুঞ্জিভূত একটি প্রত্যাশাকে কেন্দ্র করে বসে আছেন। কিন্তু কেউ কিছু বলছেন না। অধীর সবাই, আবার নিয়ন্ত্রিত। অবশেষে হজরত জিবরাইল (আ.) অতি বিনীতভাবে প্রিয়নবীর হস্ত মোবারক ধারণ করে ইমামতির আগে বাড়িয়ে দিলেন। কৃতজ্ঞচিত্তে সকলেই নামাজ আদায় করলেন।
এরপর শুরু হল, মেরাজ বা ঊর্ধ্বভ্রমণ। আবারও আসমানি বুরাকে সওয়ার হলেন প্রিয়নবী (সা.)। স্বল্প সময়ে এসে পড়লেন প্রথম আকাশের তোরণদ্বারে। অতি শালীন শব্দে করাঘাত করলেন নির্ধারিত দরজায়। ভেতর থেকে পরিচয় জিজ্ঞেস করা হল; জিবরাইল (আ.) স্বীয় পরিচয় দিলেন। পুনঃ প্রশ্ন হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি জবাব দিলেন, মুহাম্মদ (সা.)। সঙ্গে সঙ্গেই বৃষ্টির শেষে ভেসে ওঠা নরম সূর্যালোকের মতো স্নিগ্ধতা ও কোমলতার পরশ কণ্ঠ মেখে দ্বার রক্ষী ফেরেশতা জানালেন, খোশ আমদেদ, মোবারকবাদ। প্রবেশ করতেই চোখে ভেসে ওঠলো মনব পিতা হজরত আদম (আ.)- এর পবিত্র অবয়ব। আপন পিতার প্রথম দর্শনে মহানবী (সা.)- এর নব উদ্দীপনাপূর্ণ ব্যাকুলতাকে ভাষা ভাষা দিলেন জিবরাইল (আ.)। সালাম করতেই গুচ্ছ গুচ্ছ দরদ আর অসীম স্নেহময়ী মুখ তুলে গর্বিত পুত্রকে সালামের জবাব দিয়ে বললেন, সুযোগ্য পুত্র ও সুযোগ্য নবী। তোমার আগমন শুভ হোক।
এভাবেই চলতে থাকল তাদের ঊর্ধ্বলোক ভ্রমণ আর শুভেচ্ছা বিনিময়ের পালা আকাশ থেকে আকাশে। সপ্ত আকাশ পর্যন্ত। রজনী সফরের এই সুখকর ধারায় আর যাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন তারা হলেন, ‘ দ্বিতীয় আকাশে হজরত ইয়াহইয়া ও হজরত ইসা (আ.)। তৃতীয় আকাশে হজরত ইউসুফ (আ.)। চতুর্থ আসমানে হজরত ইদ্রিস (আ.)। পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন (আ.)। ষষ্ট আসমানে হজরত মুসা (আ.) ও সপ্তম আসমানে হজরত ইব্রাহীম (আ.)। পথিমধ্যে দর্শন লাভ করেন ফেরেশতাদের ইবাদতের প্রাণকেন্দ্র ও পবিত্র কেবলা বাইতুল মামুর, যা কাবা শরিফের একদম সরাসরি সোজা চতুর্থ আসমানে অবস্থিত। এ যেন কাবারই এক অবিকল প্রতিচ্ছবি। যেখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা উপস্থিত হন তা তাওয়াফ করার জন্য। যারা একবার সুযোগ পান, তারা কেয়ামত অবধি আর দ্বিতীয়বার সুযোগ পাবেন না, সংখ্যাধিক্যের কারণে।
সাত আসমানের দীর্ঘ সফর শেষে প্রিয়নবীকে নিয়ে হজরত জিবরাইল (আ.) চললেন আরও সামনে। বিশাল বিস্তৃত প্রান্তর। অনবরত ভাগ্যলিপি লেখার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ফেরেশতাদের ওপর অর্পিত আল্লাহর নির্দেশাবলী লেখার স্থানই এ প্রান্তর। জিবরাইল (আ.) রাসুল (সা.) নিয়ে চললেন খানিকটা সামনে। সেখানে অবস্থিত সিদরাতুল মুনতাহা যা একটি বড় প্রকাণ্ড কুলবৃক্ষ বিশেষ, যার মূল ছিল ষষ্ট আকাশে আর শাখা-প্রশাখা সপ্তম আকাশে। নিরাকার, নিরাধার পরম করুণাময়ের নূরের তাজাল্লী আর আলোর বিন্দুরা হেলে-দুলে সাতার খেলে খেলে ক্রমেই উহার শোভাবর্ধন করছিল। ফেরেশতাদের আনাগোনা এ পর্যন্ত বলেই সিদরাতুল মুনতাহা বলা হয়। সেখানে প্রিয়নবী দেখলেন চারটি প্রবহমান চারটি প্রস্রবণ। তন্মধ্যে দুটি ভেতরের দিকে, অন্যদুটি বাইরের দিকে। মহানবী (সা.) জিজ্ঞেস করলেন এ প্রস্রবণ সম্পর্কে। জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘ভেতরের দুটি বেহেশতের প্রবহমান সালসাবীল ও কাউসার নামক প্রস্রবণ। আর বাইরের দুটি ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থিত নীল ও ফোরাত নদীর উৎসস্থল।
হঠাৎ স্থির হয়ে গেলেন জিবরাইল (আ.)। তিনি বিনয় বিগলিত কণ্ঠে প্রিয়নবী (সা.)-কে শুধালেন যে, সম্মুখে এক পা অগ্রসর হওয়া আপনি ব্যতীত অন্য কারও সাধ্য নেই। তাই বিদায়ী সালাম জানিয়ে থেমে পড়লেন তিনি। আর অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘটবে আশিক মাশুকের দীর্ঘ প্রতীক্ষার মহামিলন। কাছ থেকে কাছে, অতি কাছে। মাত্র এক ফলক কিংবা দুফলক ব্যবধান হাবিব মাহবুবের মাঝে। ডুবে রইলেন মাহবুবের কল্পনাতীত সৌন্দর্যের স্বচক্ষ দর্শনে। যা বলার বললেন একান্ত কাছে টেনে। যা দেবার দিলেন তিনি প্রিয় হাবিবকে ভালোবেসে।
এবার ফেরার পালা, তবে বিদায় সম্ভাষণ জানানোর পূর্বে মহামহিম স্রষ্টা তার প্রিয় হাবিবকে ও তার হৃদয় উজাড় করা প্রেমাস্পদ উম্মতকে কিছু উপঢৌকন প্রদান করতে চান। আর তার প্রদান হল নামাজ। হ্যাঁ দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ তিনি উপঢৌকন হিসেবে প্রদান করলেন। তারপর বিদায় জানালেন মহান আল্লাহ তার পরম বন্ধুকে, আসমানি অতিথিকে। মহান রাব্বুল আলামিনের দেয়া পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়ে তিনি ফিরে এলেন পৃথিবীর বুকে। তিনি এলেন মাহবুবের সান্নিধান থেকে শাশ্বত বিশ্বাসের রাশি রাশি প্রাচুর্য অঢেল বৈভব, অগণিত আলোর ফোয়ারা নিয়ে। মাত্র অল্প সময়ে। তখনও প্রিয়নবীজির শয্যা গরম ছিল। গৃহের তালা ঝুলছিল।
ধীর-স্থির শান্ত একটি মজলিস। তাবৎ জাগতিকতা, পার্থিবতাকে তুচ্ছ করে চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী বসে আছেন রাসুল (সা.)। প্রিয়নবীর প্রশান্ত অবয়ব আজ এক ভিন্ন আবেগের ছাপ। প্রশান্তির এক ঝলক আলোকচ্ছটা ঝলমল করছে তার পুণ্যময়ী আদলে পবিত্র ঔজ্জ্বল্য নিয়ে। ইতিমধ্যে শান্ত সম্বোধনে রাসুল (সা.)- এর মুখ থেকে ধীরেধীরে ব্যক্ত হতে থাকলো তার অলৌকিক ঊর্ধ্বভ্রমণের বিস্ময়কর ইতিবৃত্ত। কৌতূহল সাহাবায় কেরাম তখন অদ্ভুত এক অবাক করা নৈশব্দে নিজেদের সপে দিলেন প্রিয়নবীর চরণে। বুক উজাড় করা উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে শ্রবন করলেন তারা প্রিয়নবীজি (সা.)- এর কথা। বিশ্বাস করে নিলে একবাক্যে, দ্বিধা-সংকোচ দূরে ঠেলে দিয়ে।
সত্যিকারার্থে মেরাজের বৃত্তান্ত যেমন সুস্পষ্ট, তেমনি বলিষ্ঠ। যে বৃত্তান্ত ফুটে উঠেছে সৃষ্টির সেরা মানবের শ্রেষ্ঠত্ব পরিচয়। স্রষ্টার নৈকট্যের তারতম্যের পরিমাপ। পবিত্র মেরাজ রাসুলের মহা উত্থানের ইতিবৃত্ত। আর এ উত্থানই হল মানবতার আত্মিক মহা অভ্যুত্থান। যার সিপাহসালার স্বয়ং মহানবী (সা.)। প্রিয়নবীর এই মহা উত্থানের প্রারম্ভ হল পবিত্র কাবা থেকে, আর পূর্ণতা পেল বাইতুল মুকাদ্দাসের নবী-রাসুল ও ফেরেশতাদের ইমামতিতে। প্রমাণিত হল, তিনিই হলেন সেরা মানবকুল আর তিনিই হলে নবীকুল শিরোমণি। মুমিনের জন্য এনে দিলেন শ্রেষ্ঠ উপহার দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। ধন্য করলেন ধরার ধূলি। ধুলার মানুষকে এনে দিলেন সৃষ্টির সেরা সনদ ‘তোমরাই হলে শ্রেষ্ঠ উম্মত’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন