গত আলোচনায় উল্লেখিত নবীগণের কাছে নিরাশ হয়ে সবাই যখন সরদারে কায়েনাত দু’জাহানের বাদশাহ আমাদের নবী (সা.) এর কাছে আসবেন, সে ব্যাপারে নবীজী বলেন, তারপর সবাই আমার কাছে আসবে। বলবে, আপনি আল্লাহর রাসূল। সর্বশেষ নবী। আল্লাহ পাক আপনার জীবনের পূর্বা-পরের সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। আমাদের জন্য আপনি আল্লাহর কাছে সুপারিশ করুন! আমাদের যে কী কঠিন মসিবত যাচ্ছে তা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন।
নবীজী বলেন, তখন আমি আরশের নীচে গিয়ে আল্লাহর দরবারে সিজদায় লুটিয়ে পড়ব। আল্লাহ তাআলার প্রশংসা শুরু করব। এমন ভাষায় প্রশংসা করব, যে ভাষায় অন্য কেউ কোনোদিন আল্লাহর প্রশংসা করতে পারেনি। আল্লাহ তাআলা সেই প্রশংসার ভাষা আমার অন্তরে ঢেলে দেবেন। আমি আল্লাহর প্রশংসা করতে থাকব। আমাকে বলা হবে, মুহাম্মাদ! মাথা তোলো। তুমি যা চাইবে দেওয়া হবে। তুমি সুপারিশ করবে তোমার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।
আমি বলব, ইয়া রব! উম্মতী উম্মতী! আমার উম্মতের কী হবে! আমার উম্মতের কী হবে! আপনি আমার উম্মতের নাজাতের ফয়সালা করুন। এরপর নবীজী তাঁর উম্মতকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে থাকবেন। (সহীহ মুসলিম : ৩২৭)।
সুবহানাল্লাহিল আযীম! ইনি হচ্ছেন আমাদের নবী, যিনি দুনিয়াতে উম্মতের জন্য হেদায়েতের ফিকির করেছেন। তাদেরকে ঈমানের দাওয়াত দিতে গিয়ে যারপরনাই কষ্ট সয়েছেন। আর হাশরের ময়দানের কঠিন সেই দুর্যোগে যখন সবাই ‘নফসী নফসী’ করতে থাকবে তখন একমাত্র সেই নবীর যবানেই উচ্চারিত হতে থাকবে ‘উম্মতী উম্মতী’। নবীজী বলেন : প্রত্যেক নবীরই একটি দুআ বিশেষভাবে কবুল হয়। সকল নবীই তা করে ফেলেছেন। কিন্তু আমি আমার সেই দুআ রেখে দিয়েছি- কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের শাফাআতের জন্যে। (সহীহ মুসলিম : ১৯৮)।
নবীজী আরো বলেন : আমার শাফাআত হচ্ছে আমার উম্মতের কবীরা গুনাহ করে ফেলেছে এমন ব্যক্তিদের জন্য। (সুনানে আবু দাউদ : ৪৭৩৯)। কুরআনে কারীমের বিভিন্ন স্থানে রাব্বুল আলামীন তাঁর হাবীবের পরিচয় ফুটিয়ে তুলেছেন বিভিন্নভাবে। আল্লাহ বলেন : তোমাদের মাঝে তোমাদের মধ্য থেকেই রাসূল আগমন করেছেন, তোমাদের কষ্ট যার নিকট অসহনীয়, যিনি তোমাদের (কল্যাণের) জন্য ব্যাকুল, যিনি মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত দয়াপরবশ, পরম মমতাবান। তারপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে (হে রাসূল! তাদেরকে) বলে দাও, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তাঁরই উপর আমি ভরসা করেছি এবং তিনি মহা আরশের মালিক। (সূরা তাওবা : ১২৮-১২৯)।
লক্ষ করুন, প্রিয় হাবীবের শানে আল্লাহ তাআলার শব্দচয়ন হচ্ছে : ‘তোমাদের কষ্ট যার কাছে অসহনীয়, যিনি তোমাদের কল্যাণের জন্য ব্যাকুল।’ বস্তুত নবীজীর গোটা জীবনটাই ছিল এই আয়াতের বহিঃপ্রকাশ। তিনি উম্মতের কল্যাণ কামনায় কতটা ব্যাকুল ছিলেন, উম্মতের হেদায়েত ও নাজাতের জন্য কতটা বিভোর থাকতেন তারই কিছুটা এখানে বিকরিত হল। নববী যিন্দেগীর পরতে পরতে সীরাত ও সুন্নাহর পাঠক যার নজীর অহরহই দেখতে পান।
পরিশেষে আয়াতের শেষাংশটি সবিশেষ খেয়াল করার মতো। আল্লাহ তাআলা বলছেন : ‘তারপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে (হে রাসূল! তাদেরকে) বলে দাও, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তাঁরই উপর আমি ভরসা করেছি এবং তিনি মহা আরশের মালিক।’
অতএব গোটা পৃথিবীবাসীও যদি নবীজীকে ছেড়ে দেয় নবীজীর তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি তো তিনি, যাঁর প্রশংসা স্বয়ং রাব্বুল আলামীন করেছেন। তাঁর আলোচনাকে সমুন্নত করেছেন। তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ গুণের অধিকারী বলে ঘোষণা দিয়েছেন। স্বয়ং আল্লাহ এবং পুত পবিত্র ফেরেশতাদের জামাত যাঁর উপর দরূদ ও সালাম পেশ করেন। যাঁর প্রতি দরূদ পেশ করতে হুকুম করা হয়েছে বিশ্ববাসীকে।
ধন্য সে, যে নবীজীর এ ‘দরদ ও ব্যাকুলতার’ কদর করল। তাঁর আনীত দ্বীন কবুল করল। তা প্রচার প্রসারে আত্মনিয়োগ করল। তাঁর রেখে যাওয়া আমানতের হেফাযত করল। তাঁর ইজ্জত রক্ষায় নিবেদিত হল। সফল সে, যে তাঁর সুন্নত আঁকড়ে ধরল। জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁকে এবং একমাত্র তাঁকেই উসওয়া ও আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করল। সৌভাগ্যবান সে, যে নিজের মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি এমনকি নিজের জীবন থেকেও নবীজীকে ভালবাসতে পারল।
মন্তব্য করুন