বিনয় যেমন মাটির মানুষকে আকাশের উচ্চতায় উঠিয়ে নেয়, ঠিক এর বিপরীতে যশ-খ্যাতি, সম্মান, অর্থসম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, বিদ্যা-বুদ্ধি ইত্যাদি যে কোনো ক্ষেত্রে কেউ যখন সফলতার চূড়া স্পর্শ করে অহংকার করতে থাকে তখন তা তাকে নিক্ষেপ করে আকাশের উচ্চতা থেকে সাত জমিনের নিচে। এক আরবি গল্পে অহংকারের উপমা খুব চমৎকার ফুটে উঠেছে।
পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কেউ যখন নিচে তাকায়, তখন সব কিছুই তার কাছে ছোট ছোট মনে হয়। নিজের দুই চোখ দিয়ে হাজারো মানুষকে সে ছোট করে দেখে। আবার যারা নিচে আছে তারাও তাকে ছোটই দেখে। তবে দুই চোখের পরিবতে এক হাজার মানুষের দুই হাজার চোখ তাকে ছোট করে দেখছে। অর্থাৎ অহংকার করে একজন যখন সবাইকে তুচ্ছ মনে করে, তখন এ অহংকারীকেও অন্য সবাই তুচ্ছ মনে করে।
এই অহংকার হচ্ছে সকল পাপের মূল। একে আরবিতে বলা হয় ‘উম্মুল আমরায-সকল রোগের জননী’। বরং বলা যায়, এ জগতের প্রথম পাপই হচ্ছে অহংকার। সৃষ্টিজগতের প্রথম মানব আমাদের পিতা আদম (আ.) কে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের আদেশ করেছিলেন, তোমরা আদমকে সিজদা কর। এই আদম (আ.) কে সৃষ্টি করার পূর্বে আল্লাহ তায়ালা যখন ফেরেশতাদেরকে তাঁর মানব সৃষ্টির ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন তখন তারা বলেছিল, আপনি আমাদেরকে রেখে এমন কোনো জাতি সৃষ্টি করবেন, যারা নৈরাজ্য ঘটাবে, একে অন্যের রক্ত ঝরাবে, অথচ আমরা তো আপনার সার্বক্ষণিক ইবাদতে মগ্ন! মনে মনে তারা এও ভেবেছিল, আল্লাহ তায়ালা কিছুতেই এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন না, যে আমাদের চেয়ে বেশি জানে এবং তাঁর নিকট আমাদের তুলনায় অধিক সম্মানিত হবে।
এসবের পরও ফেরেশতাদেরকে যখন আল্লাহ বললেন, তোমরা আদমকে সিজদা কর, সকলেই সিজদায় লুটিয়ে পড়ল। এই তো ফেরেশতাদের পরিচয়, তাদেরকে যা আদেশ করা হয় তারা তাই করে। কিন্তু ফেরেশতাদের মাঝে বেড়ে ওঠা শয়তান মাটি আর আগুনের যুক্তি হাজির করল। সে আগুনের তৈরি বলে মাটির তৈরি মানুষকে সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানাল। পাক কোরআনের ভাষায় : সে অস্বীকৃতি জানাল এবং অহংকার করল। আর সে ছিল কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা বাকারা : ৩৪)।
এই হলো প্রথম অহংকারের ইতিহাস। কোরআনে কারীমে বর্ণিত প্রথম পাপের বিবরণ। এ পাপের দরুণ শয়তান অভিশপ্ত হলো, জান্নাত থেকে বিতাড়িত হলো, মানুষের শত্রুতার ঘোষণা দিয়ে পৃথিবীতে এলো। কত শক্ত শপথ সেদিন সে করেছিল, সে বলল, আপনি যেহেতু আমাকে পথচ্যুত করেছেন তাই আমি অবশ্যই তাদের জন্যে আপনার সরল পথে বসে থাকব। এরপর আমি অবশ্যই তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, তাদের পেছন থেকে, তাদের ডান দিক থেকে এবং তাদের বাম দিক থেকে। আর আপনি তাদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞ পাবেন না। (সূরা আরাফ : ১৬-১৭)।
এই যে শয়তানের শপথ এবং এ শপথের শক্তিতে সে বিভ্রান্ত ও পথহারা করে যাচ্ছে বনী আদমকে, এর মূলে তো সেই অহংকার। অহংকার তাই বিবেচিত হয় সবচেয়ে ভয়ংকর আত্মিক রোগ হিসেবে।
বর্তমান সময়ের একটি ভয়ংকর রোগ হচ্ছে ক্যান্সার। এ রোগ কিছুদিন মানুষের শরীরে লুকিয়ে থেকে একসময় প্রকাশ পায়। রোগ প্রকাশ পাওয়া, রোগীর শরীরে বিভিন্ন আলামত ফুটে ওঠাও এক প্রকার নিয়ামত। কারণ এর মাধ্যমেই রোগীর চিকিৎসার পথ উন্মোচিত হয়। কিন্তু অহংকার রোগটি এমন, মানুষ মনেই করে না তার মধ্যে অহংকার আছে। রোগের অনুভূতিই যখন না থাকে তখন এর চিকিৎসার কথা ভাববে কে?
অহংকার কী-এ প্রশ্নের সরল উত্তর হচ্ছে, কোনো বিষয়ে নিজেকে বড় মনে করে অন্য মানুষকে তুচ্ছ মনে করার নামই অহংকার। শক্তিতে, সামর্থ্যে, বয়সে, অভিজ্ঞতায় ত্রিশ বছরের যুবক যতটা সমৃদ্ধ, বার বছরের একটি ছেলে তো সবক্ষেত্রেই তার তুলনায় হবে রিক্তহস্ত। তার ছোট হওয়া এবং তাকে ছোট মনে করা এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা। বাস্তবেই যে ছোট তাকে ছোট মনে করা অহংকার নয়। বরং অহংকার হচ্ছে, সে ছোট বলে তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। কাড়ি কাড়ি টাকা যার ব্যাংক একাউন্টে সঞ্চিত, সে তো যে দিনে এনে দিনে খায় তাকে অর্থবিত্তে ছোট মনে করতেই পারে। এটা অহংকার নয়। অহংকার হচ্ছে তাকে তাচ্ছিল্য করা, গরীব বলে তাকে হেয় করা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন