আয়িশা লুবাইনা
আজ আমার ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী। অর্থাৎ আমার মৃত্যুর বয়স দশ। জন্মের বয়স বাবা-মার হিসাবের ভুলের কারণে পাঁচ সন্তানের বাবা হওয়ার পরও বয়স ছিল ত্রিশ। সন্তানের ত্রিশ বছর হলে আমি মৃত্যুবরণ করি। তবে সেই হিসাব তারা ঠিকই রেখেছে। তাদের হিসাবের সঠিক নির্ণয় হিসাবে আজ আমার ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রতিবছরের মতোই আজও তারা আমার কুলখানি করবে। পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে প্রচুর মানুষ দাওয়াত করা হয়েছে। তারা একে একে উপস্থিত হতে শুরু করেছে। আমার সন্তানেরা একত্রিত হয়েছে। কৌশল বিনিময় করছে। কার পরিবারের কেমন অবস্থা তা নিয়ে তারা আলোচনা করছে। কারো কথায় কেউ হাসতে হাসতে আধমরা হয়ে যাচ্ছে। আমার স্ত্রীও সেই সাথে আছে। রান্না কতজনের হবে, কী হবে, কীভাবে হবে তদারক করছে। আমার মেয়েরাও বসে নেই। কেউ জামাই নিয়ে এসেছে। তাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। কেউ বা ভাইয়ের বৌয়ের সাথে কাজ করছে। কাজ আর কথার ফুলঝুরি একসাথেই হচ্ছে।
বেলা ১০টা-১১টার দিকে অধিকাংশ আত্মীয়স্বজন চলে এলো। তাদের আনা মিষ্টি-ফলমলে ডাইনিং টেবিল ভরে গেল। মিষ্টি আমার খুব প্রিয় ছিল। কারো মনে আছে কিনা বলতে পারি না। হাসি-খুশি, আনন্দ-উল্লাস কোনোটারই কমতি নেই। দেখলে বোঝাই যাবে না আজকের অনুষ্ঠান কিসের? বড় ছেলের পাঞ্জাবি এখনো কেনা হয়নি। বৌয়ের তাগাদায় মার্কেটে গেছে ভালো পাঞ্জাবি কেনার জন্য। আজ নতুন পাঞ্জাবি না পরলে মেহমানের সামনে কেমন লাগবে এই হলো তার চিন্তা। বেশ ভালো চিন্তা। মেজো ছেলে জিদ ধরেছে, বড় ভাইয়ের বাসায় সে যাবে না। সুতরাং বাবার দশম কুলখানিতে সে অনুপস্থিত থাকবে। তার বৌও তাই করল। এক ঝা আরেক ঝাতে খুব হিংসা। কারণ একটাই, বড় ঝায়ের স্বামীর টাকা বেশি। তার স্বামীর কম।
ছোট ছেলে এখনো বিয়ে করেনি। সে অপেক্ষায় আছে, তার মা মারা গেলে বিয়ে করবে। নইলে মায়ের সাথে বৌয়ের মনমালিন্য হবে। এতে মায়েরও মনে কষ্ট, বৌয়েরও মনে কষ্ট হবে। তার মাও তারই মতো। বৌ তার কুলখানি অনুষ্ঠানেই উপস্থিত হবে এটা মনে হয় সে চায়। তাই ছেলে বিয়ে নিয়ে তার চিন্তা নেই। যেন বিয়েটা সে সারাজীবন না করলেই ভালো হয়।
বড় মেয়ে অনেক দিন পরে এসেছে। মেয়ের জামাই নিয়ে এসেছে। তাই তাকে সমাদর করতে ব্যস্ত। নতুন জামাই, তার আপ্যায়নে যেন কোনো ত্রুটি না হয় সে চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে। ছোট মেয়ের স্বামী রাগ করেছে। এ বাড়িতে আসবে না। তার আত্মীয়-স্বজন সবাইকে দাওয়াত করা হয়নি কেন এই তার রাগ করার কারণ। নাতি-নাতনিরা অনেক দিন পর নানার বাড়িতে এসেছে। তারা আনন্দ, হৈ-হুলোড় করে সময় কাটাচ্ছে। মামাতো ভাইয়েরা ফুফাতো ভাইদের পেয়ে ক্যারাম খেলতে বসেছে। বোনেরা বোনেরা বিভিন্ন আলাপ করছে। দূরের আত্মীয়-স্বজনদের নাস্তা দিতে ব্যস্ত বড় ছেলের বৌ।
বেলা নিজের পথ ধরে গন্তব্যে যাচ্ছে। সবারই ব্যস্ততা বাড়ছে। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে সেই ব্যস্ততাও ফুরাবে। লেগে গেল হট্টগোল। বিরিয়ানিতে লবণ তুলনামূলক বেশি হয়েছে। কেউ বলছে, সেরে যাবে সমস্যা নেই। কেউ বলছে, এত লোক খাবে। কে কী বলবে? নতুন করে রান্না করা হোক। আরেকজন রেগে উঠল, তাহলে এগুলো কী করবে? কথা ঠিক তাই সিদ্ধান্ত হলো, এগুলোই খাওয়ানো হবে। তবে বিশেষ মেহমানদের জন্য নতুন করে পাকানো হবে।
হাসিখুশিতে সময় পার হয়ে যাচ্ছে। মেহমানের আপ্যায়নের পালা শেষ হলো। বেলাও অনেক গড়াল। একে একে বিদায় নিচ্ছে। আমি রওনা হলাম। হাঁটছি তো হাঁটছিই। দেখছি সব, আকাশে লালটিপ, বাতাসে সুরভী, ফুল কাননে ভ্রমরের নৃত্য, মালীর গুনগুনিয়ে গাওয়া গান সবই ভালো লাগছে। কেমন জানি হারিয়ে পাওয়ার মতো। এলাম, হ্যাঁ আমার বাড়িতে এলাম। যেই মুখটা সবার আগে দেখি, সে হাসছে। নাতজামাইয়ের সাথে। কৌতুকে কৌতুকে কথাবার্তা চলছে। আমার স্ত্রী। চারদিকে চোখ বুলালাম। এই তো এখনো অনেক মানুষ আছে। আত্মীয়-স্বজন অনেকেই এখনো আছে। গল্প করছে, একটু হাসির ঝংকার, একটু আবার মলিনতা। ক্ষণিক আফসোস আবার খুশিতেও উদ্বেলিত কিছুক্ষণ। আমি হেঁটে হেঁটে দেখছি, চারদিকে প্রদক্ষিণ করছি। ছেলেরা আমার ব্যবসার আলাপ করছে। একটা দালান করতে কত খরচ হয় কেউ হিসাব করছে।
ছেলের বৌয়েরা সব গোছগাছে ব্যস্ত। মেয়েদের বিদায়ের পালা। গোধূলিটাও নেমে যাচ্ছে, আমি পথ ফিরে চলার মনস্থ করলাম। হঠাৎ ডাইনিংয়ে চোখ পড়ল, অনেক মিষ্টি। আমার খুব প্রিয় খাবার। বড় বউ এসে আফসোস করতে লাগল, আহা সবাই তো চলে যাচ্ছে, কাউকে তো মিষ্টি দেওয়া হলো না। যারা আছে তাদের ডাকাডাকি শুরু হলো। মিষ্টি খাওয়ার আসর শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে রইলাম।
সূর্যটা ডুবু ডুবু। আপন বাড়িতে যাওয়ার আয়োজন প্রায় শেষ। আমি তার সাথী হলাম। ফিরে যেতে যেতে মনে হলো, এই দিনটি হাজারবার আসবে, তবে একবারও হয়তো আমার জন্য আসবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন