বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে অর্থনেতিক অগ্রগতি লাভ করলেও তৃণমূলে অর্থনৈতিক সঙ্কট রয়েগেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বারবার অর্থনৈতিক সঙ্কট কমেছে বলে দাবি করছেন। কিন্তু অধিকাংশ পরিবারে এখনও অভাব লেগেই আছে। সামান্য পড়ালেখার খরচ জোগাতে সাত ছাত্র নিজ এলাকা থেকে কয়েক শ’ মাইল দূরে ইটভাটার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যায়। সেখানে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তাদের মৃত্যু হয়। ছেলে ও পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে ওই পরিবারগুলোতে চলছে আহাজারি। নিহত শ্রমিকদের মধ্যে তরুণ চন্দ্র রায়, বিপ্লব কুমার রায়, অমল চন্দ্র রায়ের ছেলে প্রশান্ত রায় দীপু, মৃণাল চন্দ্র রায় ও সেলিম নামের পাঁচজন নীলফামারী জেলার জলঢাকা থানার মীরগঞ্জ হাট বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। পাশ্ববর্তী শিমুলবাড়ি এসসি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র নিহত বিকাশ চন্দ্র রায় ও মনোরঞ্জন রায়।
পারিবারিক আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে ঠিকমত লেখাপড়ার খরচ ও স্কুলের পোশাক ব্যবহার করতে না পারায় গত বছরের নভেম্বর মাসে কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামের ‘কাজী এন্ড কোং’ নামের একটি ইটভাটায় যায়। সেখানে তারা শ্রমিক হিসেবে কমিশন ভিত্তিতে কাজ করছিল। প্রতিদিনের ন্যায় কাজ শেষ করে গত ২৪ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে তারা ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, পরদিন শুক্রবার ভোর সোয়া পাঁচটায় কয়লাভর্তি ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে সাত স্কুল ছাত্রসহ ১৩ জন নিহত হয়েছে।
বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, গত ২৫ জানুয়ারি শুক্রবার ভোর সোয়া পাঁচটায় কয়লাভর্তি ট্রাক (ঢাকামেট্রো-ট-১৬-০১১৪) থেকে ওই ইটভাটায় কয়লা নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল শ্রমিকরা। হঠাৎ করে ট্রাকটি উল্টে গেলে কয়লাগুলো ঘুমন্ত শ্রমিকদের মেসে উপর গিয়ে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলে ১৩ শ্রমিক নিহত ও ৩ জন আহত হয়। হতাহতেরা একই এলাকার হওয়ায় গোটা এলাকার মানুষ যেন শোকে পাথর হয়ে আছেন। নিহতদের বাড়িতে চলছে আহাজারি।
মীরগঞ্জ হাট বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান বিভিন্ন মিডিয়ায় জানিয়েছেন, নিহতদের মধ্যে পাঁচজন তার বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। বিকাশ ও মনোরঞ্জন রায় শিমুলবাড়ি এসসি উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী বলে জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষক জ্যোতিশ চন্দ্র রায়।
নতুন বছরে এটিই আলোচিত ট্রাজেডি। ফেসবুক, ট্যুইটার, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এই ট্রাজেডি নিয়ে ফলাও করে সংবাদ প্রকাশ করেছে। মূল কথা হলো, অভাবের তাড়নায়, পড়ালেখার খরচ জোগাতে পরিবারকে সহযোগিতার জন্য ওই অঞ্চলের বেশিরভাগ ছাত্র বিভিন্নস্থানে গিয়ে শ্রমিকের কাজ করে। চৌদ্দগ্রাম ট্র্যাজিডিতে নিহত শ্রমিকদের আত্মীয়-স্বজন সূত্রে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
ওদিকে দেশের অধিকাংশ ইটভাটার মালিকরা শ্রম আইন মানছে না। তারা কাঁচা ইট রোদে শুকানো, ইট তৈরি, ট্রলিতে করে ইট টেনে ভাটাস্থলে পৌঁছানো, মাটি বহন করাসহ সব কাজেই শিশু শ্রমিক ব্যবহার করছে। ভাটাগুলোতে ১২-১৮ বছরের বয়সী অনেক শিশুই কর্মরত আছে। ভোর ছয়টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত তারা ভাটাগুলোয় কাজ করে। গড়ে ১০ ঘণ্টা কাজের পর তারা ভাটাতেই ঘুমায়। তাদের দৈনিক আয় ১০০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে। দারিদ্র্যের কারণে শিশুরা ভাটার কাজে যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছ বলে জানায় তাদের অভিভাবকরা। ভাটার মালিকরা অর্থনৈতিক সংকটের সুযোগ নিয়ে স্বল্প মজুরিতে দিন রাত কাজ করাচ্ছে। আর এসব শিশুদের একটি দালাল চক্রের মাধ্যমে দূর-দূরান্তের বিভিন্ন এলাকা থেকে চুক্তিতে আনা হয়। যেসব ইটভাটায় শিশুদের নিয়োগ করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সচেতন মহল থেকে বারবারই দাবি তুলেছে। কিন্তু কয়েকটি ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে শিশুদের আটক করলেও বেশির ভাগ ইটভাটা অভিযানের বাইরে থেকে যায়।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে এখন প্রায় আট হাজার ইটভাটা রয়েছে। এসবের অধিকাংশই অবৈধ। ৩৮ শতাংশ বায়ুদূষণ হয় ইটভাটার কারণে। ইটভাটায় বছরে ১২৭ কোটি ঘনফুট মাটির প্রয়োজন হয়। আইনে বলা হয়েছে, তিন ফসলি জমি থেকে মাটি নেওয়া যাবে না। জলাশয় থেকে মাটি তোলা যাবে না। এলজিইডির রাস্তার পাশে ভাটা করা যাবে না। জ্বালানি-কাঠ ব্যবহার করা যাবে না। আবাসিক এলাকা, সিটি করপোরেশন, সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বনের এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নির্মাণ করা যাবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা করা যাবে না। কিন্তু এসব নিয়ম না মেনেই বেশির ভাগ স্থানে ভাটা করা হয়েছে। তাই পরিবেশ অধিদপ্তর এসব ইটভাটার জন্য ছাড়পত্র দেয়নি এখনো।
আবার আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে বেশ জটিলতায় পড়তে হচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের। আইনে বলা হয়েছে, ইটভাটায় জ্বালানি সাশ্রয়ী ও আধুনিক প্রযুক্তি যেমন হাইব্রিড টানেল, জিগজ্যাগ ও ভার্টিক্যাল শ্যাফট ব্যবহার করতে হবে। এগুলো বায়ুদূষণকে সহনীয় পর্যায়ে রাখে। কিন্তু প্রযুক্তি নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত নয়। কারণ প্রযুক্তি পরিবর্তনশীল। তাই সংশোধনীতে বলা হয়েছে, জ্বালানি সাশ্রয়ী, আধুনিক ও বায়ুদূষণ সহনীয় মাত্রায় রাখে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। ইটভাটার জন্য মজা পুকুর, খাল, বিল, দীঘি, নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়, চর ও পতিত জমি থেকে মাটিকাটা নিষিদ্ধ করা আছে ২০১৪ সালের ১ জুলাই পাস করা ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইনে’। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে সংশোধনীতে এসব শর্ত শিথিল করা হয়েছে। বলা হয়েছে, জেলা প্রশাসক বা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে খাল-বিল, হাওর, চর ও পতিত জমি থেকে মাটি কাটা যাবে। বিদ্যমান আইনে পাহাড় ও টিলার আধা কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা না করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সংশোধনীতে এক কিলোমিটারের মধ্যে না করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারকে আরও এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সচেতন মহল এগিয়ে এসে-মানুষকে সচেতন করলে স্কুল শিক্ষার্থীরা পড়াকালীন সময়ে আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যোগ দিতো না। আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যোগ না দিলে নিহত ওই সাত ছাত্রের মত কারও ভাগ্যে এমন পরিণতি হওয়ার সম্ভাবনা নাই।
‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’- এই মন্ত্রে উজ্জিবীত হয়ে সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি দেশের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি ভিডিও কনফারেন্সে দেশের উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে সম্পৃক্ত হতে সকলের প্রতি আহŸান জানিয়েছেন। তিনি দেশের সার্বিক উন্নয়নে সচেতন নাগরিক, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত হতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ আহবানে সাড়া দিয়ে মানবতার পক্ষে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। এতে বাংলাদেশ স্বচ্ছল ও দারিদ্রম্ক্তু হবে।
লেখক : সাংবাদিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন