দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে বিদেশ গমনেচ্ছু যুবকরা বিপর্যস্ত হচ্ছে। দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে অবৈধ পথে স্বপ্নের দেশে যাওয়ার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাখ লাখ টাকা দিয়ে বিদেশের কারাগারে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে শত শত যুবক। অবৈধভাবে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় যাওয়ার আশায় বিভিন্ন সময়ে মেক্সিকোর কারাগারে আটক ৩শ ৯১ জন বাংলাদেশী যুবককে এখনো দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। আটককৃত এসব যুবক কয়েক বছর যাবত দেশটি জেলে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ থাকায় মানবপাচারকারী দালাল চক্র থেমে নেই। দেশটিতে ভালো চাকুরি আশ্বাস দিয়ে যুবকদের কাছ থেকে ৩/৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। মানবপাচারকারী দালাল চক্রের সাথে ইমিগ্রেশনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার দহরমহর সর্ম্পক রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দালাল চক্র মালয়েশিয়ায় পাচারের লক্ষ্যে নতুন রুট হিসেবে ইন্দোনেশিয়াকে বেছে নিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় অন অ্যারাইভাল ভিসার সুবাধে প্রতারক চক্র গ্রামাঞ্চলের সহজ সরল যুবকদের মালয়েশিয়ায় পৌছে দেয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় নিয়ে যাচ্ছে। সরকারের দক্ষ কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় মালয়েশিয়ার পাশের দেশ ইন্দোনেশিয়াতে চালু হয় অন অ্যারাইভাল ভিসা। ভ্রমণপিপাসু বাংলাদেশিদের নির্বিঘ্নে ভিসা ছাড়াই ভ্রমণ করার সুযোগ তৈরি হয় দেশটিতে। আর সেই অন অ্যারাইভাল ভিসাকে পুঁজি করে গড়ে উঠছে মানবপাচারকারীদের নিরাপদ রুট। অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে মানবপাচারকারী দালাল চক্র।
বাংলাদেশী যুবকদের ভিজিট ভিসার নামে ইন্দোনেশিয়ার মানবপাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়ার পর তাদের জড়ো করা হয় দেশটির বিভিন্ন ভাড়াটে বাড়ীতে। এসব যুবকদের সুযোগ বুঝে পাচারের অপেক্ষায় থাকতে হয় দিনের পর দিন। অনেকেরই খেয়ে না খেয়ে আবদ্ধ রুমে দিনাতিপাত করতে হয়। দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থেকেও ইন্দোনেশিয়ার মেদান শহর থেকে গ্রেফতার হতে হয়েছে মালয়েশিয়ায় পাচারের অপেক্ষায় থাকা দুই শতাধিক বাংলাদেশি যুবককে। আগেও পাচারের অপেক্ষায় থাকা বহু বাংলাদেশিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল বালি থেকে।
ইন্দোনেশিয়া পুলিশ সম্প্রতি দেশটির মেদান শহরের পাশের এলাকায় বসবাসকারী এসব বাংলাদেশিকে সন্দেহভাজন বাসিন্দা হিসেবে আটক করে। একটি দোতলা ভবনে অভিযান চালিয়ে ১শ ৯২ জন বাংলাদেশী যুবককে খুঁজে পায় তারা। আটকদের মধ্যে বেশিরভাগের বয়স বিশের কোঠায়।
দেশটির কর্তৃপক্ষ জানায়, গত ৬ ফেব্রুয়ারি মেদান শহরের দোতলা একটি ভবনে অবস্থিতছোট ছোট দোকান ঘরে গাদাগাদি করে আশ্রয় নেয়া ওই সব মানুষের বেশিরভাগই অভুক্ত। তাদের ধারণা, বাংলাদেশ থেকে এসে কয়েক মাস ধরে এখানে বসবাস করছে তারা। কাজের আশায় পাশের দেশ মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য তারা এখানে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছেন সে দেশের অভিবাসন বিভাগের কর্মকর্তারা।
মেদান শহরের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থার প্রধান মোনাং শিহিতি বলেন, আমরা ধারণা করছি তারা নৌকায় করে এখানে এসেছে। তাদের কাছে কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। এ বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলে তাদের ফেরত পাঠানো হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এছাড়া গত ৮ ফেব্রুয়ারি ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে আরও ৫৯ বাংলাদেশি যুবককে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ইন্দোনেশিয়া হয়ে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারের কারণে ইতোমধ্যে মালয়েশিয়া আরও নজরদারি বাড়ানোর কথা বলছে ইন্দোনেশিয়াকে।
বিগত ২০১৮ সালের এপ্রিলে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন ও মেরিন পুলিশ অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের চেষ্টাকালে ৩০ বাংলাদেশিকে আটক করে । মেরিন পুলিশের কমান্ডার (পিপিএম) সহকারী কমিশনার রোজমান ইসমাইল বলেন, সাগরপথে ইন্দোনেশিয়া থেকে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের সময় একটি ট্রলারসহ এ ৩২ জনকে আটক করা হয়। আটকদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের মামলা হয়েছে। মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন পুলিশ গত মার্চ মাসে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া অনুপ্রবেশকালে ১০ জন বাংলাদেশি এবং ২১ জন মিয়ানমার নাগরিককে আটক করে । দু’দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে, যাতে কোনো প্রকার নৌকায় ভেসে অভিবাসীরা মালয়েশিয়ায় ঢুকতে না পারে।
মেক্সিকোর জেলে আটককৃত ৩শ ৯১ জন বাংলাদেশীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশকে চিঠি দিয়েছে । কিন্ত এখনো এসব আটককৃত বাংলাদেশীকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। দালাল চক্রের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথে মেক্সিকোতে তারা আটক হয়েছে। দালাল চক্র এসব বাংলাদেশীদের কাছ থেকে জনপ্রতি ২৫ হাজার মার্কিন ডলার থেকে ৩০ হাজার ডলার হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বায়রার সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব আলহাজ আবুল বাশার দালাল চক্রের মাধ্যমে ট্যুরিষ্ট ভিসার নামে অবৈধভাবে বিদেশে যাত্রার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ট্রাভেলস এজেন্সী থেকে টিকিট নিয়ে যারাই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে তাদের দায়-দায়িত্ব কেউ নিবে না। অবৈধভাবে বিদেশে গিয়ে জেল খেটে যারাই দেশের ভাব-মর্যাদা বিনষ্ট করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দিতে হবে। বিএমইটি থেকে বর্হিগমন ছাড়পত্র নিয়ে বৈধভাবে যে সব কর্মী বিদেশে যাচ্ছে তারা যাতে অহেতুক হয়রানির শিকার না হয় সে ব্যাপারেও সজাগ দৃষ্টি রাখার অনুরোধ জানান আলহাজ আবুল বাশার। বৈধভাবে বিদেশে কর্মী প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো মানবপাচারের ঘটনার সাথে জড়িত নন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন