মানুষের কাছে যেসব বিষয় তার প্রাণের মতোই প্রিয়, মাতৃভাষা তার মধ্যে অন্যতম। মাতৃভাষার মাধ্যমে কোনো মানুষ নিজেকে এবং তার জাতিসত্তার পরিচয় বিশ্বের কাছে তুলে ধরে। আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার চেয়ে গৌরবের, কারণ বাংলা ভাষা একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই। আমাদের দেশই পৃথিবীর একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। ভাষার জন্য বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বীর সৈনিকদের। তাদের অবদান ও আত্মত্যাগের ফলেই যেমন রক্ষা পেয়েছে বাংলা ভাষার মর্যাদা, তেমনি সৃষ্টি হয়েছে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিসংগ্রামের প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি। ভাষা আন্দোলনের চেতনা প্রতিটি বাঙালির অন্তরে মিশে আছে, যা বাঙালির আত্মপরিচয় ও আত্মানুসন্ধানের প্রধান প্রতীক। এটা আমাদের জন্য এক বড় পাওয়া, আমাদের গৌরব, আমাদের অহঙ্কার। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্ব দরবারে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা ভাষাকে করেন মহিমান্বিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। ১৯৯৯ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আরও সুপ্রতিষ্ঠিত। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৯৩টি দেশে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের ভূমিকার কারণেই ২০০২ সালের ১২ ডিসেম্বর দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আহমাদ তেজান কাব্বাহ বাংলাকে সিয়েরা লিওনের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। এটা আমাদের জন্য অনেক গর্বের বিষয়।
উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল যে পাকিস্তান, ভাষাশক্তির বৈশ্বিক সূচকে সেই দেশটি বাংলাদেশের চেয়ে এখন ১৫ ধাপ পেছনে। ফ্রান্সভিত্তিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ইনসিয়েড’-এর সম্মানিত ফেলো ড. কাই এল চানের তৈরি ‘পাওয়ার ল্যাংগুয়েজ ইনডেক্স-পিএলআই-২০১৬’ এমনই তথ্য প্রকাশ করেছে। মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের সক্ষমতা বিবেচনায় এনে সূচকটি তৈরি করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫তম এবং পাকিস্তানের অবস্থান ১৩০তম।
ভাষাবিদদের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীর মোট ভাষার সংখ্যা প্রায় আটহাজার। আবার ‘এথনোলগ- দ্য ল্যাংগুয়েজেস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামের ভাষা সংক্রান্ত একটি প্রকাশনার ১৯৯৯ সালের জরিপ অনুযায়ী পৃথিবীর ভাষার সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। এর মধ্য থেকে মাত্র ৪ শতাংশ ভাষা (আনুমানিক ৩০০) ভাষা দিয়ে পৃথিবীর ৯৬ শতাংশ মানুষ তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে। বাকি সাড়ে পাঁচ হাজারের মধ্যে যেসব ভাষায় কথা বলার লোক এক লক্ষের ওপর নেই সেগুলোকে বলে বিপন্ন ভাষা। এক লক্ষ জনের কম কথা বলে বিশ্বে এমন ভাষার সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এক হাজার জনের কম কথা বলে এমন ভাষার সংখ্যা প্রায় পনেরশ। মাত্র একশত জন লোক কথা বলে এমন ভাষার সংখ্যা পাঁচশত। ৫১টি ভাষা রয়েছে প্রতিটিতে মাত্র ১ জন করে লোক কথা বলে। এই ৫১টি ভাষার মধ্যে শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই আছে ২৮টি। ভাষাতত্ত্ব বিদদের মতে, আগামী ১০০ বছরের মধ্যে প্রায় ৩ হাজারের মতো ভাষা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ১০০ বছরে ৩ হাজার ভাষার বিলুপ্তি মানেই বর্তমান সময়ে প্রতি দুই সপ্তাহে অবলুপ্ত হতে চলেছে একটি করে ভাষা।
ভাষাগত পরিবর্তন ও ভাষার বিলুপ্তি শুরু হয়েছিল পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে। ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদের অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার পরিবর্তন ও বিলুপ্তি ধারা সমান গতিতে চলতে থাকে। ইংরেজি, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ প্রভৃতি বড় বড় ভাষার তান্ডবে সে সময় থেকে হারিয়ে যেতে থাকে অনেক ছোট ছোট উপনিবেশের ভাষা। এ ছাড়া দুর্ভিক্ষ, খরা, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি কারণে ছোটখাটো অনেক জনগোষ্ঠি পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে। ফলে বিলুপ্ত হয়ে গেছে তাঁদের ভাষাও। অর্থনৈতিক কারণে এবং সাংস্কৃতিক একাত্বকরণের ফলে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষ অন্য অঞ্চলে গিয়ে ঘর বাঁধে। এতে মানুষ নতুন লোকালয়ের ভাষাকে গ্রহণ করে নিজের ভাষাকে ভুলে যায়। তবে অনেক দেশই নিজের ভাষা বাঁচিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যেমন: ‘হিব্রু’, ‘ওয়েলশ’ নিউজিল্যান্ডের ‘মাউরি’, হাওয়াই দ্বীপের ভাষা, তাহিতী দ্বীপের ভাষা, উত্তর আমেরিকার ‘নাভাজো’, ‘সেনেকা, ইত্যাদি ভাষাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার প্রক্রিয়া চলছে।
পরিসংখ্যানবিদদের মতে, বাঙালি এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। তাই বাংলা ভাষার পরিধিও প্রসারিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় এখন বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি লোক কথা বলে। ২০৫০ সাল নাগাদ কেবল ১৪ থেকে ২৫ বছর বয়সী বাংলাভাষীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৩১ কোটি ৬০ লাখ। প্রচলিত ভাষার মধ্যে মাতৃভাষার বিবেচনায় বিশ্বে বাংলার স্থান চতুর্থ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এসআইএল ইন্টারন্যাশনালের তথ্য ব্যবহার করে তৈরি ‘ইথনোলগ’-এর প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে উইকিপিডিয়ার ২০১৭ সংস্করণে বলা হয়েছে, ভাষাভাষীর বিবেচনায় বিশ্বে বাংলা ভাষা অষ্টম। তবে মূল ভাষা হিসেবে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলার অবস্থান বিশ্বে ষষ্ঠ। বিশ্বের প্রায় ৩০০ মিলিয়ন বা প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। ২৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাংলাকে মূল (প্রথম) ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। ২০১১ সালের হিসাবে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহার করে এমন মানুষের সংখ্যা এক কোটি ৯০ লাখ। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার কথা বলা হয়েছে। ভারতের ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যবহৃত প্রধান ভাষা বাংলা। বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের কাছাড় জেলায় বিপুল সংখ্যক বাংলাভাষী মানুষ বাস করে। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার প্রশাসনিক ভাষা বাংলা। কাছাড় জেলারও অন্যতম প্রশাসনিক ভাষা বাংলা। ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলে তালিকাবদ্ধ ১৮টি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগে ও ইমিগ্রেশন ওয়েবসাইটে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের হিথরো বিমানবন্দর বাংলায় ঘোষণা দেওয়া হয়। এখন বাংলা ভাষাটাকে অনেক জায়গায় ব্যবহার করা হয়। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের বিষয়।
বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষা বুক উঁচু করে দাঁড়ালেও, বাংলাদেশের অবস্থা নাজুক। সারা বছর জুতা পায়ে শহীদ মিনারে বসে আড্ডা দেয়া আর ২১ ফেব্রুয়ারির সকালে খালি পায়ে ফুল দেয়া। শুধু কি তাই? দেশের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয় না। এই কি বাংলার প্রতি ভালবাসা? এখানেই ক্ষান্ত নয়, রাজধানী থেকে শুরু করে মফস্বল শহরগুলোর অলিতে-গলিতে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছড়াছড়ি। নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত সবাই সন্তানদের নিয়ে এসব তথাকথিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ছুটছেন। সরকারের বিনামূল্যের প্রাথমিক শিক্ষাকে গরিবি শিক্ষা ভেবে অনেক অভিভাবকই সেদিকে যাচ্ছেন না। টেলিভিশন নাটক, এফএম রেডিওতে এমন ভাষা বলা হচ্ছে যার সাথে প্রকৃত বাংলার কোনো সম্পর্কই নেই। সোশ্যাল মাধ্যমগুলোতে ইংরেজি বানানে বাংলার অভিনব রূপ দেখা যাচ্ছে। এমন বাংলাদেশের জন্যই কি ১৯৫২-তে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, জব্বার, বরকত, শফিক, সালামসহ আরো অনেকে? দেশের এই বেহাল দশা দেখেই স¤প্রতি মহামান্য হাইকোর্ট সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা তো সবই পারি। তার প্রমাণ দিয়েছি ১৯৫২, ১৯৬৯ আর ১৯৭১-এ। সেই আমরাই কি আবার হেরে যাব? না, যে জাতি নির্ভীক, দুর্বার সে জাতি হারতে পারে না। তাই যে করেই হোক দেশের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চা করে বিদেশি অপসংস্কৃতি রোধ করতে হবে। আমাদের দেশপ্রেম, স্বজাতিপ্রীতি এবং সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে হবে। এর জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। সর্বোপরি, ভাষাসৈনিকদের তালিকা প্রণয়ন, সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং বাংলা ভাষার দূষণ রোধ করতে সরকারকে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। বাঙালি, বাংলা ভাষা, একুশের চেতনা, একাত্তরের স্বাধীনতা, দেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও সার্বভৌমত্ব এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাষ্ট্রকেই নজরদারি করতে হবে।
লেখক: প্রভাষক, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন