জাহানারা আরজু
তোমরা ছিলে তোমরা আছ
তোমরা ছিলে, তোমরা আছো যেমন করে
সুপ্ত বীজে সবুজ অরণ্যানীর বিপুল সম্ভার থাকে
যেমন করে হলুদ সূর্যের বুকে তপ্ত রশ্মি-শায়ক থাকে-
হৈমন্তী সোনাধান মাঠের বুকেজুড়ে সোনালী চাদর হয়ে থাকে,
তেমনি করে-তোমরা আছো!
তোমরা মায়েদের বুকে শীতের উত্তাপ হয়ে আছো,
বোনের স্নেহ বৃষ্টি-স্নাত চোখে দামাল ভাই হয়ে আছো-
প্রিয়ার পুষ্পিত ঠোঁটে-ঠোঁটে লাল গোলাপ হয়ে আছো,
ভাই-এর মিছিলে সোচ্চার স্লোগানে প্রতিবাদ হয়ে আছো,
শিশুর ঘুমন্ত বুকে সাহসী পিতা হয়ে আছো।
আমরা তো দেখেছি সেদিন কেমন করে এক একটি
মাটির প্রদীপ প্রমত্ত বিসুভিয়াস হয়-
কেমন করে ঈশান কোণের এক খন্ড লাল মেঘ বৈশাখের ঝড় হয়-
কেমন করে রমনার পথঘাট বারদরিয়ার
মাতাল ঢেউ হয়-
কেমন করে হঠাৎ করেই পলাশ-শিমুল আমাদের
সত্তাজুড়ে ফুলের আখর হয়-
শহীদ মিনারের টুকরো টুকরো ইটগুলো সরব
কণ্ঠস্বর হয়-আমরা দেখেছি সেসব!
আমরা তো শুনেছি-
ওরা বলে আমরা আছি, এখানেই আছি-
বলে মাটির আস্তরণে আমরা ঢাকা পড়িনি-
বুলেট বারুদে আমরা নিশ্চিহৃ হইনি-
ওই যে ফাল্গুনের কৃষ্ণচূড়ায় আগুনে আর আমের বোলের
লুটোপুটি ওখানে আমরা আছি-কৃষ্ণ কোকিলটার কণ্ঠে আছি,
শ্যাওলা ঢাকা পুকুরটার পাড়ে মায়ের কবরের পাশে আছি-
পিতার ফেলে যাওয়া জায়নামাজটার কাছে আছি-
খোকন সোনার ছড়ার পাতায় পাতায় আছি-
খুকুর পুতুলে পুঁতির মালায় আর ঝুমঝুমিতে আছি!
কোনো বার্ধক্য জড়া-মৃত্যু কেড়ে নিতে পারবে না কোনোদিন
এখন আমাদের-
তারুণ্যে শিকল-ভাঙা-গান হয়ে আমরা এখানে বারবার
ফিরে আসি- তোমাদের কাছে আসি!
শুধু প্রথাবদ্ধ ফুলের আস্তরণে ঢাকা স্মরণের
জলসার নয়, নিত্যকার কর্মকোলাহলে স্বপ্নে জাগরণে,
শিরা উপশিরায়, জীবনের স্পন্দনে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর
সরব সোচ্চারে-বাংলার হাটে-মাঠে-বাটে ধুলো ও কাদায়
একটি বিশ্বাসের পতাকায় তোমরা আছো-
এবং তোমাদের স্পর্শ করেই আমরা বারবার বেঁচে উঠি
অস্তিত্বের মুখোমুখি দাঁড়াই-
যখনই ঘন অন্ধকারে প্রেতপুরীর মতো হয়ে যায়
আমাদের দিনগুলো-তখন বুকে হাতা রেখে বলি-
তোমরা ছিলে, তোমরা আছো-
মায়ের আতপ্ত সোহাগে আছো, বোনের আদুরে দুলাল
হয়ে আছে, ভাই-এর মিছিলে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর
হয়ে আছো, প্রিয়ার পুষ্পিত ঠোঁটে ঠোঁটে পিপাসা
হয়ে আছে, ঘুমন্ত শিশুর বুকে সাহসী পিতা হয়ে আছো।
বিপুল অরণ্যানীর সবুজ বিস্তার হয়ে আছো-
হলুদ সূর্যের বুকে উত্তপ্ত রশ্মি-শাষক হয়ে আছো-
বিক্ষুব্ধ জীবনের উত্তাল তরঙ্গ মালায় জনতার ঢেউ হয়ে আছো-
তোমরা ছিলে, তোমরা আছো!
ফাহিম ফিরেজ
মহিলা অদ্ভুত
একটি মহিলা পুরষের শার্ট গায়ে, রাতে শুয়ে থাকে
আছিলো, ছিলরে কি মজার...
জামার আস্তিন ধরে এমন ভাবেই কামড়াতে থাকে ক্ষুধা
সব রক্তের ভেতর ঝাঁজালো মরিচ হয়ে যায়
ফুঁশে,কুঁদে দুই চোখে সাপ
আর,বারবার কেশকুল ঝড়াক্রান্ত
নুয়ে পড়া বট...
এত বড় নিশি!তার উপর কেমন রোজ একা পড়ে রয়।
কাকীমারে,বিষয়টা কিন্তু বেমানান!
কিছু হওয়া দরকার। কচিকাল...
জোঁকেরা প্রায়ই চায়,ঘর বায়। বেড়া কেটে উঁকি দেয় রহিম মাতবরও!
তবু অবলা ওরকমই করে। ঘামে আর কাঁপে... শার্টের আস্তিন ধরে ঝুলতে, দোলতে
একদিন চলে যাবে নাকি
স্বর্গের নিকট!
সামনে নদীটা পেরোলেই।
শাহীন রেজা
যদি না দাঁড়াও
যদি না দাঁড়াও তবে বসে থাকো
বসতে বসতে ছোট হও ; ঝিমে বক
আমি তোমার দাফনে অংশ নেবো নিশ্চিত
আমার বিষন্ন বুকে গতকালও ফুটেছিলো
অপরাজিতা; নীলরঙ
আমি তাকে তুলে দেবো তোমার বেদীতে
যদি না দাঁড়াও তবে নীচু হও
ক্রুশবিদ্ধ যীশুর কান্না স্থিত হোক
অস্তিত্বে তোমার।
রকি মাহমুদ
ভুলভাল আত্মজীবনী
এখোন অনায়াসে ঢুকে পড়ি পরিত্যক্ত মৌচাকের ভিতর
পতঙ্গের আসা যাওয়া মানুষেরা ভালো চোখে দেখেনা ইদানিং
কেনো জিম্মি জিম্মি খেলা একুশের বই মেলার ফ্লাপে
বসন্তেড় পুড়ে যায় নিস্তরঙ্গ গন্ধি পাতার ঢাউস চাতাল
নেতিবাচক সম্পর্কের টানাপোড়েন মনোলোভা অন্ধকারের কথকতা
জন্মের আয়োজন বিলুপ্তবিশ্বাসের নিত্য সহজিয়া কুহক
গ্রন্থের মেজাজ ধ্রুপদী যুবতী, শার্টপকেট উষ্ণতায় নিবদ্ধ
ধ্বনির আনুগত্য নিঃসঙ্গ আর্তনাদে লেখে ভুলভাল আত্মজীবনী।
ইদ্রিস সরকার
মাতৃভাষা
ধনো-ধান্যে পুষ্পে ঘেরা গোলা পূর্ণ
হলেই হাসতে থাকো হো হো হি হা
জীবনের নাতিদীর্ঘ আঙিনায়
দাঁড়িয়ে সাহসে যাকে দৃপ্ত হতে দেখলাম
তার হাতে ছিলো বিজয়ের মূল নকশাটা
তাকে অভিবাদন জানাবার সাহস চাই
জীবনের যুদ্ধক্ষেত্রে কী কী ঘটবে সেসব বর্ণনাও
বয়ে নিয়ে এসেছিলো
তার বিবরণ ছিলো মর্মভেদী
তাকে স্বাগত জানাবার বিশ্বাস চাই
অলক্ষে যেনো ঘটছে অহরহ ঝগড়া-বিবাদ
তাকে প্রাণ ভরে সারাদিন অর্ঘ্য দেবো প্রেম
তার নামে ছিলো পৃথিবীর
দৃঢ় আধিপত্য। তাকে দৃষ্টি ভরে শুধু
দেখার প্রতিক্ষা চাই
জীবনের দীর্ঘ তীর্থ আঙিনায়
প্রথমেই দাঁড়িয়ে দেখেছি যাকে আবডালে।
মুহাম্মাদ এমদাদুল্লাহ
সরেতাজ আল মাহমুদ
ভোরের আলো যায়নি দেখা দিল সে আজ ডুব,
কোথায় গেল, বলল সবাই কেন আজি চুপ?
রাত্রি শেষে গায়নি পাখি নিথর কেন সব,
শোকের মাতম গুণগুণিয়ে উঠলো কেন রব?
এলোমেলো সবি যেন শোকের হাহাকার,
আকাশ-বুকে ছেঁয়ে গেছে আঁধার-অন্ধকার।
চারিদিকে শোনা গেল মস্ত যে হইচই,
প্রিয় কবি প্রাণের কবি কই গেল আজ কই?
কবিতারা তুলে যাবে বিরহিণী সুর,
তোমার ছবি বাসবে ভাল সবার হৃদয়পুর।
হৃদয়ের এই আলাপনে এঁকে দিলে আজ,
প্রেমে-প্রাণে তুমি ছিলে সবার সরেতাজ।
এরশাদ জাহান
একুশ অতঃপর বাংলাদেশ
একুশ মানেই ভাষার জন্য অগ্নিমিছিল রাজপথে,
একুশ মানেই রফিক শফিক সালাম জব্বার বরকতে।
একুশ মানেই বুকের তাজা রক্তে লেখা অ আ ই,
একুশ মানেই মায়ের মুখে বর্ণমালার সুখ হাসি!
একুশ মানেই মাতৃভাষার ভালোবাসা অনিঃশেষ,
একুশ মানেই বাংলা ভাষা বাঙালি ও বাংলাদেশ।
অ আ ক খ
তোফায়েল হোসেন
শুকনো রক্তের দাগ চিহ্ন বাংলাদেশের মাটিতে
খাঁকি উর্দিপরা একদল কষাইয়ের বুটের লাথি
থেতলে দেয় শাণিত শ্লোগানমূখর বুলেট ঠোঁট,
সালাম বরকত রফিক জব্বার শফিউর এর
শার্টের বোতাম ছিড়ে ফিনকি দিয়ে বেরোয়
রঞ্জিত কৃষ্ণচূড়া। বুকের ছিদ্রে চোখে পড়ে
কিশোর অহিদের নিথর দেহ। লেখা অ আ ক খ,
পিঁচঢালা রাজপথে নব ইতিহাসের জন্মোত্থান।
মা বললেন- খোকা মুক্ত করে দে কথার স্ফুটন,
সেই থেকে শুকনো রক্তের চিহ্ন পৃথিবীর চোখে,
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের বুক পকেটে কালো ব্যাচ্,
কণ্ঠে শোকার্ত গান- আ-ম-রি বাঙলা ভাষার।
সুমন আমীন
বিশ্বজয়ী বাংলা ভাষা
হাজার বছরের শৌর্যময় পথ হেঁটে হেঁটে
তুমি আজ বিশ্বজয়ী বাংলা ভাষা
চর্যাপদের সহজিয়া হিমেল পথের শেষে
চন্ডীদাস মুকুন্দরামের কর্ষিত সবুজ জমিনে
সুলতানি বাংলায় এসে তুমি
পুষ্পিত হও গভীর মমতায়।
আরাকান রাজসভায় তোমার দৃপ্তময় পদচারণা
আমাদের শিনা আজো টান টান সেই ইতিহাসে
মানুষ- মাটির কথা তুমিই প্রথম শোনাও।
অত:পর শ্বেত শকুনের পলায়নে
আমাদের স্বপ্ন দেখার কালে
তোমার টুটি চেপে ধরে
স্বৈরাচারী হায়েনার দলে
কিন্তু তোমার অধিকার আদায়ে
লোহিত রক্তের স্রোতে ভাসে বর্ণমালা-
এই রক্তাক্ত শ্বাপদ পথ হেঁটে হেঁটে
তুমি আজ বিশ্বজয়ী বাংলা ভাষা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন