আলম শামস
এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম সাহিত্যে নোবেল পুুরস্কার লাভ করেন বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১৩ সালে ইংরেজিতে লেখা গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ’র জন্য তিনি এ পুরুস্কার লাভ করেন। সে সময়ে তার এ পুরস্কার প্রাপ্তিও একটা বিস্ময়কর ঘটনা। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ড. ইউলিয়াম রাদিচে’র কথায় জানা যায়-তখনকার দিনে ইউরোপবাসীরা বিশ্বাস করতো-রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি করতেন। তিনি যে বাংলা সাহিত্যে এত কিছু সৃষ্টি করেছেন-সেটা তারা জানতো না।
রবীন্দ্রনাথকে বলা হয় কবিদের কবি। কবি গুরু। তিনি আমাদের জাতীয় সঙ্গীতেরও রচয়িতা। বিশ্বের প্রায় সকল বাংলা-ভাষাভাষি পাঠকের প্রিয় কবি বিশ্বকবি রবি ঠাকুর। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সব্যসাচী লেখক। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের সকল শাখায়ই পদচারণা করেছেন সগৌরবে। যখন যেখানে হাত দিয়েছেন তখনই তা হয়েছে সরস, উর্বর, বৈচিত্র্যময়। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সভ্যতা-সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার, মাটি ও মানুষের কবি। তাই শিশুরা তার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়নি। শিশুদের জন্যে তিনি লিখেছেন অসংখ্য ছড়া, কবিতা, গান, গল্প নাটকসহ নানা রকম শিশুতোষ রচনা।
নিতান্ত অল্প বয়সে জ্ঞান নন্দিনী দেবীর পরিচালনায় প্রকাশিত ‘বালক’ পত্রিকা লেখার ভার অনেকটাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ফলে সৃষ্ট হয়েছে ছড়া আর গল্পের পসরা। জীবনের শেষ পর্যায়েও আরো মনোযোগ আর দরদের সঙ্গে শিশু সাহিত্য রচনায় আত্ম নিয়োগ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ শিশুদের জন্যে প্রচুর লিখেছেন। আমরা তার শিশুকাব্য ছড়া ও কবিতা নিয়ে আলোচনা করব। শিশু, শিশু ভোলানাথ, খাপছড়া, ছড়া ও ছবি, গল্প-সল্প- কল্পনা, সহজ পাঠ ইত্যাদি অসংখ্য ছড়া ও কবিতা গ্রন্থ তিনি শিশুদের জন্যে রচনা করেছেন।
ছড়াগুলোকে রবীন্দ্রনাথ মেঘের সাথে তুলনা করেছেন। যখন ছোটদের জন্যে লিখেছেন তখন তিনি যেন শিশুর চোখ নিয়েই দেখেছেন। কবি যখন ছোট নদীর কথা তুলে ধরেন তখন তা পাঠ করে শিশুরা নিজ চোখে দেখা নদীটাকেই মনে মনে ধরে নেয়।
পড়তে তা চমৎকার :
‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক। (আমাদের ছোট নদী, সহজ পাঠ)।
প্রকৃতি দরদী কবি প্রকৃতির নানান বিষয়কে তুলে এনেছেন শিশুদের ছড়া কবিতায়। আষাঢ় মাসের মেঘ দেখে লিখেছেন-
নীল নবঘনে আষাঢ় গগণে
তিল ঠাঁই আর নাহিরে
ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে। (আষাঢ়, ক্ষণিকা)
‘কড়ি ও কোমল গ্রন্থে বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ সোনার তরী, দুই পাখি শিশুদের জন্যে অসাধারণ সৃষ্টি। বৃষ্টি, নদী, চাঁদ, ফুল, পাখি এসব কিছুই শিশুদের দারুণ প্রিয়। আর এগুলো নিয়ে যখন ছড়া ও কবিতা হয় তখন তা আরো উপভোগ্য। কবিতায়:
দিনের আলো নিভে এল
সূর্যি ডোবে ডোবে।
আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে
চাঁদের লোভে লোভে। .......
‘কোন ছেলেরে ঘুম পাড়াতে
কে গাহিল গান,
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
নদেয় এল বান’। (বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর)
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন সচেতন খেয়ালি মনের মানুষ। বিচিত্র্য রকম সাধ, ইচ্ছে ছিলো তার মনের মধ্যে। ছোটদের মতো তার মনটাও যখন যা দেখেছেন তাই করতে চেয়েছেন, হতে চেয়েছেন।
কবির ভাষায় :
‘যখন যেমন মনে করি
তাই হতে পাই যদি,
আমি তবে এক্খনি হই
ইছামতী নদী।
অথবা
‘মা যদি হও রাজি
বড়ো হলে আমি হব
খেয়াঘাটের মাঝি’ (মাঝি, শিশু)
রবীন্দ্রনাথের এই বিচিত্র ইচ্ছে বিচিত্র সাধ, কবিতায় আরো প্রসারিত হয়ে শিশুদের মনের যাবতীয় কল্পনা, ইচ্ছেগুলো ব্যক্ত হয়েছে। এই কবিতায় কবির শিশুমন গলির পাশে ফেরিওয়ালাকে দেখে ফেরিওয়ালাকে, মালিকে দেখে মালী, পাহারাদারকে দেখে পাহারাদার হতে চেয়েছেন। আর বীর পুরুষ কবিতায় কবি বীর হয়ে মাকে নিয়ে বিদেশ ঘুরতে বেড়িয়েছেন। পথের বাধা সৃষ্টিকারী ডাকাতদলগুলো মেরে শেষ করেছেন। শিশুদের আনন্দ দানকারী এই অসম্ভব সুন্দর কবিতাতেই রবীন্দ্রনাথ ইচ্ছে পূরণ না হওয়া শিশু মনের ব্যথাহত অভিব্যক্তি তুলে ধরেছেন;
‘রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা,
এমন কেন সত্যি হয় না আহা’।
শিশুদের কাছে মা অতি প্রিয় একটি শব্দ। সবকিছু যদি তাকে দাও, তারপরও সে মাকে তালাশ করবে। মা যেন তার থাকতেই হবে। তাই মাকে নিয়েও রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন অনেক ছড়া, কবিতা। মাতৃবৎসল কবিতায় লিখেছেন :
‘মেঘের মধ্যে মা গো যারা থাকে
তারা আমায় ডাকে, আমায় ডাকে।.........
আমি বলি, ‘মা যে আমার ঘরে
তারে ছেড়ে থাকব কেমন করে’।.......
ছোট শিশুদের থাকে নানান রকম দুরন্তপনা। আধো আধো কথায় শিশুরা মন ভরিয়ে দেয়। শিশু ছোট হলেও তার রং ঢং সত্যি মুগ্ধ করে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় :
‘একটি ছোট মানুষ, তাহার একশো রকম রঙ্গতো।
এমন লোককে একটি নামে ডাকা কি হয় সঙ্গত’। (পরিচয়, শিশু)
রবীন্দ্র নাথ যখন ছোটদের জন্যে লিখেছেন, তখন তিনি মনে প্রাণে নিজেই ছোট্ট শিশু বনে গেছেন। শিশুদের চাওয়া পাওয়া, আধো আধো কথা বলা তাই তার কাব্যে হয়েছে জীবন্ত, প্রাণবন্ত। মূলকথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিশু কাব্য রচনায় যে রস ও ছন্দের আয়োজন করেছেন তা শিশু মনের শ্রেষ্ঠ খোরাক সন্দেহ নেই। তাই শিশুদের কাছেও তিনি কিংবদন্তি।
বাংলা সাহিত্য তথা সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে একজন অসাধারণ মানুষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ১৮৬১ সালের ৭ মে তথা ২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ বঙ্গাব্দ কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন এবং প্রায় ৮০ বছর বয়সে ১৯৪১ সালের ৭ অগাস্ট মৃত্যুবরণ করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন