ভারত অধিকৃত জম্মু কাশ্মীর বরাবরই অবহেলিত জনপদ। বিস্তৃত পরিধির সৌন্দর্যতীর্থ কাশ্মীর। ভূস্বর্গ বলা হয় একে। ভারত সরকার সে সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে বিপুল রাজস্ব আয় করলেও কাশ্মীরের স্থানীয় সরল সাধারণ জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তেমন কোন পরিবর্তনই হয়নি। পর্যটন শিল্পে পুঁজিপতিদের দৌরাত্ম্য সেখানে চোখে পড়ার মত। সামরিক বাহিনীর মোড়লিপনা তো রয়েছেই। এসব সমস্যার বোঝা মাথায় নিয়ে জনগণকে নতুন জীবনের স্বাদ পাইয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাশ্মীরের প্রথম এবং মুসলিম নারী মুখ্যমন্ত্রী হলেন মেহবুবা মুফতি সাইদ।
তিনি পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) প্রধান। তার বড় পরিচয় তিনি পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও জম্মু কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মোহাম্মদ সাইদের কন্যা। গত ৭ জানুয়ারি মুফতি সাইদের আকস্মিক মৃত্যুতে পদটিতে শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তারই পদে অধিষ্ঠিত হলেন তারই কন্যা মেহবুবা মুফতি। তিনি জম্মু কাশ্মীরের প্রথম তবে সমগ্র ভারতের দ্বিতীয় মুসলিম নারী মুখ্যমন্ত্রী। এর আগে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন আরেকজন মুসলিম নারী। আনোয়ারা তৈমুর (১৯৮০-১৯৮১)। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বলে খ্যাতি আছে মেহবুবা মুফতির।
সম্প্রতি কাশ্মীরের ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও পিডিপির মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। দু’দলের সমন্বয়ে কাশ্মীরে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছে। এই কোয়ালিশন সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মেহবুবা মুফতি। কাশ্মীরে বর্তমানে পিডিপির বেশ জোরালো অবস্থান রয়েছে। কাশ্মীরে ভারতীয় মূলধারার রাজনীতিকে পেছনে ফেলে একমাত্র স্থানীয় দল পিডিপিই নিজের শক্ত অবস্থান গড়তে সক্ষম হয়েছে। এজন্য অবশ্য পিডিপিকে অনেক কাঠখড়ও পোড়াতে হয়েছে। পিডিপির এ অবস্থানের পেছনে ৫৮ বছর বয়েসী মেহবুবার অবদান তার সমালোচকরাও স্বীকার করেন।
মেহবুবা বারবার বলে এসেছেন তিনি কাশ্মীরের উন্নয়ন বলতে স্থানীয় জনতার উন্নয়ন করতে চান। মেহবুবা স্থানীয়দের সত্যিকার উন্নয়ন চাইলে তাকে অবশ্যই জেঁকে বসা ভারতীয় পুঁজিপতি ব্যবসায়ী শ্রেণী ও নিয়ন্ত্রণহীন সামরিক বাহিনী এ দুটি মোড়লকে আগে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। স্থানীয়দের যোগ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি নায্য পারিশ্রমিক প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। কাশ্মীরে স্থানীয়রা উচ্চ পদে খুব কমই আছেন। যারা যেতে পেরেছেন তারা তাদের রাজনৈতিক সহযোগিতা থেকেই যায়। আর সাধারণ বা নি¤œশ্রেণীর কর্মজীবীরা সচ্ছল জীবনযাপনের জন্য লড়াইরত। কাশ্মীরেও এখনও অনেক লোক দারিদ্র্যসীমার নীচে অবস্থান করে। বিলাসবহুল পর্যটন হোটেলের পাশেই বিদ্যুৎবিহীন বস্তি জনপদ হামেশাই দেখা যায়।
মেহবুবা মুফতি ২০০৯ সালে দলে প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। রাজনীতিতে আসার আগে তিনি একজন সমাজসেবিকা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। পেশায় আইনজীবী। তিনি প্রথম রাজনৈতিক লাইমলাইটে আসেন ১৯৯৬ সালে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অ্যাসেম্বলী পোলে বিজবেহারা অঞ্চলের সদস্য হয়ে। সমগ্র ভারতের অন্যান্য স্থানের চাইতে কাশ্মীরের মুসলিম সমাজ আলাদাই বলা চলে। কিছুটা রক্ষণশীল। সেরকম সমাজে মুসলিম নারী রাজনীতিতে আসাটাই একটি চমক ছিল সে সময়। তবে মুফতি পরিবার বরাবরই উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত।
এরপর ১৯৯৯ সালে পিতা মুফতি মোহাম্মদ সাইদ কংগ্রেস থেকে বের হয়ে পিডিপি গঠন করলে মেহবুবা দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং নিজের অবস্থান গঠনে ব্যাপক কাজ করেন। বলা হয়ে থাকে কংগ্রেস থেকে বের হওয়াটাই মেহবুবাকে বিজেপির কাছাকাছি হতে সাহায্য করেছে শুরুতে। সে বছরই সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও ওমর আব্দুল্লাহর কাছে হেরে যান। পরবর্তীতে ২০০২ সালে আবার অ্যাসেম্বলী সদস্য হন এবং ২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে পহলগাঁও নির্বাচনে জয়ী হয়ে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পুনরায় একই নির্বাচনী এলাকা থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। জম্মু কাশ্মীরে মুফতি পরিবার বেশ আলোচিত পরিবার। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক পরিবার হিসেবে সুনামও রয়েছে। মুফতি সাইদ সক্ষম থাকা সত্ত্বেও নবীনদের মাঝে দলের দায়িত্ব হস্তান্তর দলে ও সাধারণ মানুষের মাঝে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। পরিবারটি প্রথম আলোচনায় আসে ১৯৮৯ সালে তালেবানদের হাতে মুফতি সাইদের আরেক কন্যা রুবাইয়ার জিম্মি হওয়ার মধ্যদিয়ে। তিনজন বন্দি বিনিময়ের মাধ্যমে রুবাইয়া ছাড়া পান। রুবাইয়া জিম্মি হবার পাঁচদিনের মাথায় মুফতি সাঈদ রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন। তখন রুবাইয়াকেই ভবিষ্যৎ রাজনীতিক মনে করা হলেও মেহবুবাই নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন স্বীয় যোগ্যতায়।
রাজনীতিতে এসেও ব্যাপক পরিবর্তন-পরিবর্ধনের উদ্যোগ তাকে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। রাজনীতিক হয়েও সমাজসেবিকা পরিচয় ধরে রাখা তাকে আলাদা বৈশিষ্ট্যম-িত করেছে। নিজ দায়িত্বে নিয়েছেন অনেক পদক্ষেপ। যা তাকে ঘিরে প্রত্যাশা বাড়িয়েছে জনগণের। বিজেপির সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করছেন। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার তার উপর সন্তুষ্ট। কিছুদিন আগে কাশ্মীরের বন্যা পরিস্থিতিতেও তার ব্যাপক উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। বর্তমানে কাশ্মীরে বেশ কয়েকটি সমস্যা প্রকট। মেহবুবাকে শুরু থেকেই একটা করে সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে।
তার দায়িত্ব গ্রহণের আমেজ কাটতে না কাটতেই কাশ্মীরে সামরিক বাহিনীর হাতে যুবক খুন হওয়ায় শুরুতেই চাপে পড়েছেন মেহবুবা। বরাবরই কাশ্মীরে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর স্বেচ্ছাচার চলে। কাশ্মীর অশান্ত থাকার পেছনে কাশ্মীরবাসীর অধিকাংশই সামরিক বাহিনীকেই দায়ী মনে করেন। মেহবুবাকে এ দিকটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। সামরিক বাহিনীর সাথে সাধারণ জনগণের বিশাল দূরত্ব রয়েছে। যুগ যুগ ধরে জুলুমের মাধ্যমে তৈরি হওয়া এ দূরত্ব ঘোচানোর কাজটি সহজ নয়।
রক্ষণশীল কাশ্মীর সমাজে মেহবুবা নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। সমালোচকেরা বারবার মুফতি পরিবারের আলোচনায় আসাটাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বললেও মুফতি পরিবার জনগণের বিশ্বাসের জায়গায় নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে, কাশ্মীরের যথার্থ উন্নয়ন চাইলে কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীটিকে বাদ দিয়ে কিছু করার চিন্তা ফলপ্রসূ হবে বলে মনে করেন না কেউ। যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত, নির্যাতিত, অবহেলিত হয়ে জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। জঙ্গিবাদ বা চরমপন্থার উত্থানের মূল গোড়াটা যদি চিহ্নিত এবং সহমর্মিতা দিয়ে অনুভব করা না যায় তাহলে চরমপন্থা নির্মূল সম্ভব নয়। আর কাশ্মীরের ইস্যুটি অন্যান্য জায়গার থেকে একেবারেই আলাদা। ভারতের অভ্যন্তরেতো বটেই আন্তর্জাতিক মহলেও কাশ্মীরের আন্দোলনকারীদের প্রতি সহমর্মিতা রয়েছে। মুসলিমদের পাশাপাশি পাশ্চাত্যের অনেক জায়গাতেও তাদের কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, তাদেরও একটি অবস্থান রয়েছে। তারাও একটি অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে। আর একাংশকে বাদ দিয়ে সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। বরং পরিস্থিতি আরো অস্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। মুফতি পরিবারের এ জায়গাটিতেই দুর্বলতা রয়েছে।
কাশ্মীরবাসীরা মেহবুবাকে ঘিরে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছে। নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়নের স্বপ্ন। মানবিক ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। মেহবুবা নিজেই সে স্বপ্ন দেখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ছোট্ট অবহেলিত মুসলিম জনপদটির ঘুরে দাঁড়ানোর আশা আন্তর্জাতিক মহলও করছে। ভারতের কেন্দ্রীয় নীতি অনুযায়ী আয়ত্বে আনা আঞ্চলগুলোকে পুরোপুরি স্বাবলম্বী করা ও সেনা নিয়ন্ত্রণ বিলুপ্ত করার তত্ত্ব আজ অবধি কোথাও দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণে ও প্রয়োগে ধর্ম বিশ্বাসও যে কোন ভূমিকা রাখে না তা বলা মুশকিল। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মেহবুবা ভারতের সে নীতি কতটা বুঝতে এবং তাতে ভারসাম্য আনতে পারেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। দেখা যাক তিনি কতটা কি করতে পারেন।
-সুমাইয়া হাবীবা
সমাজ ও মানব উন্নয়ন কর্মী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন