বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ওয়াজ মাহফিলে নিয়ন্ত্রণ নয়, সাবধানতা কাম্য

| প্রকাশের সময় : ৫ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওয়াজ মাহফিলের বক্তাদের বয়ানে বিভিন্ন বিষয় আমলে নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ওই প্রতিবেদনে ১৫ জন বক্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘এই বক্তারা সাম্প্রদায়িক ধর্মবিদ্বেষ, নারী বিদ্বেষ, জঙ্গিবাদ, গণতন্ত্রবিরোধী ও দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী বয়ান দেন বলে লক্ষ করা যায়।’ আরো বলা হয়েছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা রেডিক্যালাইজড হয়ে উগ্রবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব উগ্রবাদী ও বিদ্বেষপূর্ণ ওয়াজ প্রচার করা হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে শ্রোতা, দর্শক শেয়ারকারী, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। এতে সমাজে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি হচ্ছে, দেশীয় সংস্কৃতি লালনে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে এবং কিছু সংখ্যক লোক প্রতিশোধপরায়ণ ও জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকছে বলে প্রতীয়মান হয়। এমতাবস্থায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৬টি সুপারিশ প্রদান করেছে। এগুলো হলো: ১. ওয়াজী হুজুররা যেন বাস্তবধর্মী ও ইসলামের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন, সে জন্য তাদের প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণের ব্যবস্থা করা। ২. যারা ওয়াজের নামে হাস্যকর ও বিতর্কিত বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে ধর্মীয় গাম্ভীর্য নষ্ট করার চেষ্টা চালান তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রো-অ্যাক্টিভ ও উদ্বুদ্ধকরণ করা। ৩. অনেক আলেমের উচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় তারাই জঙ্গিবাদ ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তাই মাদরাসায় উচ্চ শিক্ষিত ওয়াজকারীদের নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসা। ৪. অনেকেই আছেন, যারা হেলিকপ্টারে দিনে একাধিক ওয়াজ মাহফিলে যোগ দেন এবং ঘণ্টা চুক্তিতে বক্তব্য দিয়ে বিশাল অংকের অর্থ গ্রহণ করেন। তারা নিয়মিত আয়কর প্রদান করেন কিনা তা নজরদারির জন্য আয়কর বিভাগসহ সব বিভাগের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি করা। ৫. ওয়ায়েজ হুজুরদের বক্তব্য স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক সংরক্ষণ ও পর্যালোচনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া এবং উসকানিমূলক ও বিদ্বেষ ছড়ানোর বক্তব্য দিলে তাদের সতর্ক করা। প্রয়োজনে পরবর্তী সময়ে তাদের ওয়াজ করার অনুমতি না দেয়া। ৬. সাম্প্রদায়িক ও সম্প্রীতি নষ্টকারী ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য প্রদানকারীদের আইনের আওতায় আনা। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, এ বিষয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও সব বিভাগীয় কমিশনারদের প্রতি নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।
বিশ্বজুড়েই ধর্মীয় আলোচনা, সভা-সমাবেশ, সেমিনার, ওয়াজ-নসিহত হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীগণ এসব করে থাকে। এছাড়া সব ধর্মেই কিছু প্রচারক দল আছে, যারা ধর্মের বিষয়াদি প্রচার ও শিক্ষা দিয়ে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে উগ্রবাদ বিস্তার লাভ করছে, ধর্মবিদ্বেষ মাথা চাড়া দিয়ে দাঁড়াচ্ছে। এটা ধর্মীয় সহাবস্থান, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত হুমকিস্বরূপ। কোনো দেশবিশেষ নয়, সারাবিশ্বেই উগ্রবাদ ও ধর্মীয় বিদ্বেষ, হয়রানি ও অপ্রীতিকর ঘটনা বাড়ছে। মুসলমানদের মধ্যে উগ্রবাদ বিস্তারে সউদী আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোতে প্রশ্রয়প্রাপ্ত সালাফী ইজম বিশেষভাবে দায়ী। এই সালাফী ইজম ওইসব দেশ থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অন্যান্য মুসলিম দেশেও বিস্তৃত হয়েছে। বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। এখানে ওয়াহাবী বা সালাফী পন্থী গোষ্ঠির অস্তিত্ব যেমন লক্ষ করা যায়, তেমনি কোনো কোনো ধর্মীয় রাজনৈতিক দলও এই মতবাদ দ্বারা পুষ্ট। দেখা গেছে, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যেসব হামলা ও অঘটন ঘটেছে, সেসবে এই সালাফী মতবাদীরা কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট। এখন জানা যাচ্ছে, সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে সালাফী ইজম প্রতিষ্ঠার পেছনে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও সংঘাত সৃষ্টির জন্যই যে এই মার্কিন মদদ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিলম্বে হলেও সউদী আরব ও উপমহাসাগরীয় দেশগুলো এখন এটা অনুধাবন করতে পেরেছে। তারা এখন সালাফী ইজম থেকে সরে আসার পদক্ষেপ নিয়েছে। এটা অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। বাংলাদেশে শত শত বছরে ইসলামের নামে উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা কখনই প্রশ্রয় পায়নি। বাংলাদেশে ইসলাম এসেছে সূফী-দরবেশদের হাত ধরে। মুসলিম বিজেতারা এসেছেন তাদের অনেক পরে। ইসলামের সাম্য, উদারতা, সম্প্রীতি, সহশীলতা ও শান্তিবাদী দর্শন এবং সূফী-দরবেশদের অনাবিল চরিত্রমাধুর্য ও ধর্মনিষ্ঠা এদেশের মানুষকে ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে। ইসলামের এই ঐতিহ্যের কারণেই বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে অসম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে প্রশংসিত। প্রকৃত শান্তিবাদী ও ধর্মীয় বিদ্বেষমুক্ত এই দেশে যারা উগ্রবাদ ছড়াতে চায়, বিদ্বেষ বিষ বিস্তার করতে চায়, তাদের প্রতিহত করা দেশের সকল মানুষের এবং রাষ্ট্রের একান্ত কর্তব্য।
উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ, ধর্মবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ এবং আইন ও জাতীয় সংস্কৃতি সুরক্ষার জন্য একটি নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেয়া যে খুবই জরুরি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে যে সুপারিশমালা পেশ করেছে ও কার্যকর করার নির্দেশনা দিয়েছে, সেটা বিদ্যমান বাস্তবতায় বিশেষভাবে বিবেচ্য। তবে পর্যবেক্ষকমহল মনে করে, যে ১৫ জন বক্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা না করলেও চলত। তাদের ব্যক্তিগতভাবে তলব করে সতর্ক করে দিলেই হতো। এতে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। অন্যদের মধ্যে এটা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। পর্যবেক্ষক মহল আরো মনে করে, সুপারিশ বাস্তবায়নের আগে দেশের শীর্ষ আলেমদের নিয়ে বৈঠক ও তাদের অভিমত নেয়া উচিৎ ছিল। এখনো সেটা হতে পারে। তাদের পরামর্শ ও তত্ত¡াবধানে এটা হলে কোনো প্রশ্ন বা বিভ্রান্তি দেখা দেবে না। জুমার খুতবা, তালিম, বয়ান, ধর্মীয় আলোচনা ও ওয়াজ মাহফিল কোনো ক্রমেই যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। ওয়ায়েজিনের কোরান-সুন্নাহভিত্তিক সত্য ভাষণ বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। রাষ্ট্রকে বিষয়টি পুলিশী দৃষ্টিতে দেখলে চলবে না। তাতে ভুল বার্তা মানুষের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তত্ত¡বধানে শীর্ষস্থানীয় আলেমদের মাধ্যমে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা সক্রিয় থাকলে প্রশ্ন ও বিতর্ক সহজেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে। এ ব্যাপারে ওয়ায়েজিনেরও সতর্ক থাকতে হবে। এমন কিছু বলা ঠিক হবে না, যাতে উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মবিদ্বেষ উৎসাহিত হয় এবং রাষ্ট্রীয় আইন লংঘনের প্ররোচনা সৃষ্টি হয়। বক্তব্য দিতে গিয়ে তাদের ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও শুদ্ধতা বজায় রাখতে হবে। এর পরও কেউ প্রশ্নবিদ্ধ বক্তব্য দিলে তাকে আগে সতর্ক করতে হবে। পুনঃ পুন একই বিচ্যুতি ঘটলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, বিশ্বের সব দেশেই এ ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ আছে। যেখানে মনিটরিংয়ের চেয়েও দায়িত্বশীল আলেমদের সেলপ সেন্সরশিপ বেশি কার্যকর। লেখার সময় আলেমগণ যেমন সতর্ক থাকেন, বলার সময়ও সতর্কতা অবলম্বন করবেন। দীনি বিষয়ে কোনো ভুল বক্তব্য বা উপস্থাপনা ইসলামে কাম্য নয়। অন্যান্য দেশের মতো, আমাদের দেশেও সেটা থাকতে হবে। ধর্মের অপব্যাখ্যা বা ধর্মের নামে কোনো বিশেষ মতবাদ প্রকাশ ও প্রচার করার এখতিয়ার কারো থাকতে পারে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
শেখ মিজান ৫ এপ্রিল, ২০১৯, ৬:০৮ এএম says : 0
৬ প্রস্তাব যৌক্তিক, আবর বিশ্বে সব আলেম আয়কর প্রদান করেন, দেশেও এটি করা উচিৎ, তাতে আলেমদের লাভ হবে বলে বিশ্বাস করি।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন