বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

ওয়াজ মাহফিল : সমাজ সংস্কার ও শুদ্ধ মানব গড়ার অনন্য আয়োজন

মুফতী পিয়ার মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৫ এএম

পুরো বছর জুড়ে দেশের আনাচে-কানাচে, শহরে-গ্রামে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন বাংলাদেশের বিশেষ ঐতিহ্য। বিশেষ করে শীতকাল নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ওয়াজ মাহফিলের ভরা মৌসুম। মাদরাসা, মসজিদ, সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন, পাড়া, মহল্লা বা ওয়ার্ডের উদ্যোগে প্রতি বছর হাজার হাজার ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয় এ দেশে। এ ওয়াজ মাহফিল এ দেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য ও অবিচ্ছেদ্য সংস্কৃতি। এর সূচনা দেড় হাজার বছর আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে। দেশের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান অপেক্ষার প্রহর গুনে ওয়াজ মাহফিলের জন্য। হাজার হাজার শ্রোতার সমাগম হয় মাহফিলগুলোতে। কোনো কোনোটাতে তো উপস্থিতি লক্ষের কোটা ছাড়িয়ে যায়। আমার জানা মতে ভিন্ন ধর্মের লোকেরাও ওয়াজ মাহফিল শুনে গভীর মনোযোগ দিয়ে। মূলত ওয়াজ মাহফিল অন্য দশটা অনুষ্ঠান বা সভা-সমাবেশের মতো নয়। সমাজ সংস্কার ও শুদ্ধ সমাজ বিনির্মাণে ওয়াজ মাহফিলে ভূমিকা সুদূরপ্রসারী ও সুদৃঢ়। কারণ ওয়াজ মাহফিলে কুরআন-হাদীস ও তার যুগপোযগী ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। আর কুরআন-হাদীসের মূল প্রতিপাদ্যই হলো বিশুদ্ধ মানব গঠন। মানুষের অন্তুর শুদ্ধ করণ। মানবগোষ্ঠিকে সামাজিক ও ধর্মীয়সহ সকল প্রকার অপরাধ থেকে বিরত রাখা এবং মানবিক ও সামাজিক সকল মহৎগুণ অর্জন করে সমাজ সংস্কারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা। সাহাবী উবাদা ইবনে ছামিত রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বায়আত গ্রহণ করেছেন এই শর্তে- ১. আমরা মহান আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করবো না। ২. চুরি করবো না। ৩. ব্যভিচার ও ধর্ষণ করবো না। ৪. নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করবো না। ৫.কাউকে কোনো মিথ্যা অপবাদ দিবো না। ৬. সৎ ও মহৎ কাজে নাফরমানী করবো না। এরপর তিনি বলেন, যারা এ অন্যায় কাজগুলো থেকে বিরত থাকবে তাদের যথাপোযুক্ত প্রতিদান আল্লাহ তাআলা দিবেন। আর যারা এ অন্যায় ও অপরাধগুলোর কোনো একটিতে জড়াবে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে দুনিয়াতে শাস্তি দিবেন। [বুখারী, হাদীস:১৮] একজন গন্ড মুর্খও মহানবীর এই সোনালী বাণীগুলো শোনার পর চোখ বুজে অকপটে বলে দিবে, সমাজ সংস্কার ও শুদ্ধ মানব গঠনের জন্য এ বাণীগুলোর কোনোই বিকল্প নেই। আর যে মাহফিল বা সমাবেশে এ জাতীয় অমূল্য বাণীর উপর আলোচনা হয়, সেই মাহফিলের কোনো বিকল্প হতে পারে না। এছাড়াও অন্যান্য হাদীসে মাদক, ঘুষ ও সুদসহ আমাদের সমাজের অন্যান্য অপরাধগুলোর ব্যাপারেও এসেছে কঠোর হুশিয়ারী। বর্ণিত হয়েছে ভয়ানক শাস্তির বিধান। পাঠক! বর্ণিত অপরাধগুলোর যে কোনো একটিই একটি সমাজ বা রাষ্ট্রকে ব্যর্থ বা অস্থির করার জন্য যথেষ্ঠ। ইসলাম ও ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চেয়েছেন অপরাধমুক্ত নিষ্কলুষ ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র উপহার দিতে। তাই তাঁর বাণীগুলো মূলত ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অপরাধের মূলে কুঠার আঘাত করেছে সেগুলোকে শিকড়সহ উপড়ে ফেলতে। বুখারী শরীফের এক বর্ণনায় এসেছে, রোমের বাদশা হিরাক্লিয়াস আবূ সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিল, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদেরকে কিসের নির্দেশ দেন। উত্তরে আবূ সুফিয়ান বলেছিলেন, তিনি আমাদেরকে বলেন, তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর। তাঁর সাথে কোনো কিছু শরীক করবে না। তোমাদের বাপ-দাদারা যে মূর্তি পুজার কথা বলত, তা ছাড়ো। তিনি আমাদেরকে আরও নির্দেশ দেন নাামায ও যাকাত আদায় করতে। সত্য কথা বলতে। সততা অবলম্বন করতে। অন্যায় ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকতে। আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখতে। [ুবখারী, হাদীস: ৭] সাহাবী জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেছি এই শর্তগুলোর উপর- ১. নামায আদায় করবো। ২. যাকাত দিবো। ৩. প্রত্যেক মুসলমানের কল্যাণ কামনা করবো। [বুখারী, হাদীস:৫৭] ইতিহাস ও বাস্তবতা সাক্ষি ওয়াজ মাহফিলগুলোতে ইসলামের এ সকল অনন্য ও অনবদ্য বাণীগুলোকেই বিভিন্ন আঙ্গিকে আলোচনা করা হয়ে থাকে। তাই অকপটে বলা যায়, ওয়াজ মাহফিল শুদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ ও সমাজ সংস্কারের এক অনন্য ও অনবদ্য আয়োজন। কোনো ঠুনকো ও অপ্রমাণিত অজুহাতে এ আয়োজনকে বাঁধাগ্রস্থ বা সংকোচন করার চেষ্টা বা পায়তারা সমাজ সংস্কার ও শুদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ বাঁধাগ্রস্থ ও সংকোচন করার পায়তারার শামিল।

সাহাবী আবূ হুরায়রা রা. এর বাচনিক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যারা আল্লাহ তাআলার কোনো ঘর বা স্থানে একত্রিত হয়ে কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করে এবং কুরআন-হাদীসের পাঠদান ও আলোচনা করে, তাদের উপর আল্লাহর পক্ষ হতে সাকিনাহ বা প্রশান্তি অবতির্ণ হয়। তাদেরকে আল্লাহর রহমত ঢেকে নয়। ফেরেশতারা চারদিক থেকে ঘিরে রাখেন এবং এ সকল লোকদেরকে নিয়ে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের সাথে আলোচনা করতে থাকেন। [মুসলিম, হাদীস:২৬৯৯; তিরমিযী, হাদীস: ২৯৪৫] সুবহানাল্লাহ! ওয়াজ মাহফিলের কি অপূর্ব ফযীলত। যে মাহফিলে অংশ গ্রহণকারীদের উপর সাকিনাহ অবতির্ণ হয়। আল্লাহর রহমত ঢেকে নয়। ফেরেশতারা চারদিক থেকে ঘিরে রাখেন এবং এ সকল লোকদেরকে নিয়ে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের সাথে আলোচনা করতে থাকেন, এমন মাহফিলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কোনো মাহফিল বা সমাবেশ হতে পারে। করোনা ভাইরাসের অজুহাত বা অন্য কোনো দোহাই দিয়ে এমন মাহফিল আয়োজনে বাঁধা দেওয়া বা সংকোচন করার চেষ্টা করা কোনো চৌকস ও বিজ্ঞ ব্যক্তি বা প্রশাসনের কাজ হতে পারে না। কারণ মহামারি, বিপাদপদ ও বালা-মুসিবত দূর হয় আল্লাহর বিশেষ কৃপায়। আর বর্ণিত হাদীস প্রমাণ করে কুরআন-হাদীসের মাহফিলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাকিনাহ ও বিশেষ কৃপা অবতির্ণ হয়। কাজেই ওয়াজ মাহফিল কোনো মহামারি, রোগ-ব্যাধি ও বিপদাপদ বিস্তারের কারণ হতে পারে না; বরং ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে মহামারি, রোগ-ব্যাধি ও বিপদাপদ নির্মূল হতে পারে। বাস্তবতাও তাই সাক্ষি দেয়। কারণ মসজিদ-মাদরাসাগুলোতে দৈনিক প্রচুর লোক সমাগম হয়। করোনার প্রথম ঢেউ চলাকালে সরকার মসজিদ-মাদরাসাগুলো খুলে দেওয়ার পর কোনো মুসল্লী নামাযে এসে কোরনায় আক্রান্ত হয়েছেন কিংবা কোনো মাদরাসার ছাত্র বা উস্তায কোরনায় আক্রান্ত হয়েছেন এমন কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই। অথচ সেইফ হাউজ, অন্দর মহল, সুরক্ষিত বাসভবনে থেকে ও বিশ্ব সাস্থ সংস্থার বাতলানো সব রকমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেও মহামারি কোরানা ভাইরাসে আক্রন্ত হয়েছে, এমন নজীর ভূরি ভূরি। তাই বিজ্ঞ প্রসাশনকে বলবো, আল্লাহর রহমত প্রাপ্তি ও করোনা নির্মূলের জন্য ওয়াজ মাহফিল বন্ধ বা সংকোচন নয়; বরং ওয়াজ মাহফিগুলোকে বাঁধামুক্ত করুন। এতে আল্লাহর রহমতের বারিধারা নেমে আসবে আমাদের উপর। আমরা দুনিয়া ও আখেরাতে নাজাত পাবো আল্লাহর গজব ও ক্রোধ থেকে। ফলে করোনা বিদায় নিবে পৃথিবী থেকে ইনশাআল্লাহ।

লেখক: প্রধান মুফতী ও সিনিয়র মুহাদ্দিস জামিয়া মিফতাহুল উলূম, নেত্রকোনা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন