শাহনাজ বেগম
দেশে দৃশ্যত নারী-পুরুষের ব্যবধান অনেকাংশেই কমছে, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে বিস্তর ব্যবধানও রয়ে গেছে। এরমধ্যে মজুরি বৈষম্য উল্লেখযোগ্য। একদিকে নারীর সঙ্গে পুরুষের নানাদিকের নানা বৈষম্য দূর হচ্ছে ঠিকই, নারীর পক্ষে পুরুষদের মজুরি পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি। ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্র, রাজনীতিতে বা অর্থনৈতিক কর্মকা-ে সবখানে নারীর এখন উজ্জ্বল উপস্থিতি যা নারীর অভূতপূর্ব অর্জন। মজুরিহীন কাজ থেকে মজুরি আছে এমন কাজে যোগ দিলে প্রথমে মজুরি কিছুটা কম পাওয়া যায়। এমন কাজে যোগদানকারীদের বেশিরভাগই নারী। তাই নারীর গড় মজুরি কমে গেছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দুই বছরে মাসিক মজুরি বা বেতন গড়ে মাত্র ৪৯ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে শ্রমিক ও চাকরিজীবীরা প্রতি মাসে গড়ে ১১ হাজার ৫৪২ টাকা মজুরি পান। ২০১৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৪৯৩ টাকা। এ হিসাব মতে দেখা যাচ্ছে, পুরুষদের গড় মজুরি বাড়লেও নারীদের কমেছে। দুই বছরের ব্যবধানে নারী শ্রমিক বা চাকরিজীবীদের মজুরি ৩১৯ টাকা কমে গড়ে ১০ হাজার ৮১৭ টাকা হয়েছে। আর ১১২ টাকা বেড়ে পুরুষদের হয়েছে ১১ হাজার ৭৩৩ টাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বিবিএসের ২০১৩ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, সে সময়ে একজন নারী কর্মী মাসে গড়ে ১১ হাজার ১৩৬ টাকা মজুরি পেতেন। পরের দুই বছর তাদের গড় মজুরি তো বাড়েইনি, বরং কমে ১০ হাজার ৮১৭ টাকা হয়েছে। অন্যদিকে, পুরুষেরা এখন মাসে গড়ে ১১ হাজার ৭৩৩ টাকা মজুরি পান। দুই বছর আগে তারা পেতেন ১১ হাজার ৬২১ টাকা।
সর্বশেষ ২০১৫ সালের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, বর্তমানে দেশের ২ কোটি ৩১ লাখ নারী-পুরুষ মজুরি বা বেতন পান। দুই বছর আগে এমন কর্মজীবীর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৩৯ লাখ ৭০ হাজার।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডাবি-উইএফ) এর জরিপে মজুরি সমতার দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশি নারীরা। সমান সময় বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমান কাজ করেও কেবল নারী হওয়া সত্ত্বেই পুরুষের তুলনায় কম মজুরি পান। নারী শ্রমিকদের অভিমত, একজন নারী শারীরিক শক্তি বিবেচনায় পুরুষের চেয়ে কম মজুরি পান। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে নারী শ্রমিককে পুরুষের সহযোগী হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয়।
সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে নারীর প্রতি সবধরনের বৈষম্য দূর করার দাবি করেছেন নারী অধিকার আন্দোলন কর্মীরা। পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন নারীরা। সমান সময়ে সমান খাটুনি হলেও কেবল সমান নয় মজুরি। কোন কোন ক্ষেত্রে মজুরির ব্যাপারে তারা কিছুই জানেন না। দেশের অপ্রতিষ্ঠানিক খাতের প্রায় সবখানেই পুরুষের সঙ্গে বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ। তবে কম পয়সায় বেশি শ্রম পাওয়ায় মালিকরা নারী শ্রমিকদের নিয়োগ দেয়ায় বেশি আগ্রহ।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী বছরে পুরুষদের গড় আয় ৩ লাখ ১৮ হাজার টাকা আর নারীদের গড় আয় ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। বিশ্লেষকদের পরামর্শ, বৈষম্য দূর করতে হলে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনকে সঠিক ভূমিকা পালন করতে হবে।
আশার কথা, স্বাস্থ্যখাতেও নারীর উন্নয়ন হয়েছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ মাতৃ মৃত্যুর হার ২৫ শতাংশ কমিয়ে এনেছে। নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় মাপকাঠি। প্রতিটি গ্রামে গ্রামে, তৃণমূলে, প্রান্তিক মানুষের হাতের নাগালে রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। নারীরা খুব সহজে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন। এছাড়া প্রতিটি জেলায় নারীবান্ধব জেলা হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে নারীদের চিকিৎসায় আলাদা সেল রয়েছে। দেশব্যাপী ১২ হাজার ৯৫৬টি মাতৃসদন রয়েছে, যাতে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন নারীরা। এছাড়াও বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ করে এগিয়েছে নারীর শিক্ষা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে।
শিক্ষায় অংশগ্রহণে এবার বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম, স্কোর ০.৯৪৮। গত বছরেরর মতো এবারও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে উচ্চ শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে গতবছরের ১১৮তম অবস্থান থেকে পিছিয়ে এসেছে ১১৯তম অবস্থানে। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে গত বারের দশম থেকে এগিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এবার অষ্টম। কমছে নারী ও পুরুষের লিঙ্গ বৈষম্য। সেইসঙ্গে পুরুষের ওপর নারীর আর্থিক নির্ভরশীলতার হারও কমছে উল্লেখযোগ্য হারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন