বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মহিলা

আলাদা বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল নূরজাহান বোস

প্রকাশের সময় : ২৪ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বঙ্গোপসাগর-উপকূলবর্তী পটুয়াখালী জেলার প্রমত্তা আগুনমুখা নদীর কোলে সৃষ্ট কাঁটাখালী চরের এক আবাল্য সংগ্রামী মেয়ে নূরজাহান বোস। লড়াকু এই নারী ১৯৩৯ সালে সেখানে জন্মগ্রহণ করেন। অদম্য সাহসী এই নারী চর বাইশদিয়ার অসংখ্য জন্ম নেয়া এবং হারিয়ে যাওয়া গ্রাম্য বালিকার মতো হারিয়ে যাননি। সেখানকার মধ্যযুগীয় কারাগার ভেঙে উন্মুুক্ত দুনিয়ায়  তাকে নানা সংগ্রাম করে বেরিয়ে আসতে হয়েছে।
নূরজাহান বোসের জীবনাভিজ্ঞতার ভা-ার সমৃদ্ধ। শিক্ষালাভের আশায় মাত্র দশ বছর বয়সে অদম্য আগ্রহ নিয়ে গিয়েছিলেন বরিশালের অন্য একটি গ্রামে। সেখান থেকে তিনি যান বরিশাল শহরে, বরিশাল থেকে ঢাকায়। ঢাকা থেকে যান করাচি। করাচি থেকে ক্যামব্রিজ। ক্যামব্রিজ থেকে ওয়াশিংটন। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দশ বছর বয়সের মেয়েটির বয়স আজ সত্তরের কোটায়।  স্কুলের শেষ ধাপে উঠে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। সেখান থেকেই কমিউনিস্ট আদর্শের সৈনিক সেকালের তুখোড় বক্তা প্রখ্যাত যুবনেতা ইমাদউল্লাহর সঙ্গে তার প্রেম, বিয়ে, বিয়ের কয়েকমাস পরই স্বামীর আত্মগোপনে চলে যাওয়া। তারপর জলবসন্তে আক্রান্ত হয়ে ইমাদউল্লাহর অকালমৃত্যু। নূরজাহান বোসের বয়স তখন ১৮, তার গর্ভে সন্তান। সাহসিকার জীবনভর লড়াই নতুন করে শুরু হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর জীবনকে বিপর্যস্ত করেছিল ঠিকই কিন্তু তিনি একদম ভেঙে পড়েননি। উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং সংগ্রামের মধ্যদিয়ে প্রত্যয়ী হয়ে উঠেন।
এই মহীয়সীর অনবদ্য সৃষ্টি ‘আগুনমুখার মেয়ে’। দুর্গম যাত্রাপথের দুরূহ কঠিন কাহিনী সাহসের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন তার লেখায়। নূরজাহান ‘আগুনমুখা নদীর মতোই সাহসী। তার জীবন যেমন ঘটনাবহুল তেমনি বৈচিত্র্যময়। প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি ঘর বাঁধেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ স্বদেশ বোসের সঙ্গে। কিন্তু তিনি তাদের পরিচয়ে পরিচিত হতে চাননি। শৈশব থেকে স্বাধীনচেতা নূরজাহান নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।
তিনি দেখেছেন দরিদ্র বাংলাদেশের নারীরা যেমন অত্যাচার-বৈষম্যের শিকার তেমনি ধনাঢ্য আমেরিকার নারীরাও। তিনি সেই অসহায়, দুঃস্থ নারীদের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন। এ সবই তার আত্মজীবনীতে বিবৃত হয়েছে অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায়।  মার্কিন দার্শনিক জর্জ সান্তায়ানা বলেছিলেন, ‘যেকোনো মানুষের জীবনে নায়কোচিত কিছু থাকেই। কেউ প্রকাশ করেন। আর কেউ করেন না’। বলতে দ্বিধা নেই  নূরজাহান বোসের ‘আগুনমুখার মেয়ে’ তেমনই এক নারীর জীবন সংগ্রামের কাহিনী।  এক বিশাল ক্যানভাসে ধরে রাখা তার জীবন। তার ভাষায় যার শুরু ‘আগুনমুখা নদীর পারে এবং শেষ ওয়াশিংটনের পটোপাক নদীর পারে’।  নানা চড়াই-উতরাই পার হওয়া তিক্ত-মধুর শিহরণ জাগানো অভিজ্ঞতার কথা, প্রবাসজীবন এবং অসহায় মানুষের পাশে থাকার নানা জীবন স্মৃতি ও দৃষ্টান্তের শিক্ষাগুলো সহজভাবে বর্ণিত হয়েছে তার লেখা ‘আগুনমুখার মেয়ে’ অসামান্য আত্মস্মৃতি গ্রন্থে। বইটি কেবল ব্যক্তির আত্মস্মৃতি নয় এটি গ্রামবাংলার প্রায় অর্ধশতকের এক অনবদ্য সমাজদর্পণ। আত্মজীবনী নির্ভর উপন্যাস হলেও আগুনমুখার মেয়ে বইটি ইতিহাসের জ্বলন্ত দলিল। এর মাধ্যমে  শুধু তার ব্যক্তিগত সম্পর্কেই নয় সেই সময়ের সমাজব্যবস্থা, নারীর প্রতি নিপীড়ন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি হিন্দু-মুসলিম দাঙা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
আসলে নূরজাহান বোস স্মৃতিকথার মোড়কে তার সমাজ ও সময়কে তুলে ধরেছেন। আট পর্বে বিন্যন্ত তিন শতাধিক পৃষ্ঠার বইয়ে উঠে এসেছে এক সংগ্রামী নারীর জীবন কথা। যিনি কঠোর সামাজিক বিধি-নিষেধ, ধর্মীয় গোড়ামির বন্ধন ছিন্ন করে মুক্তির স্বাদ পেয়েছেন। কিন্তু আমাদের সমাজে অসংখ্য নূরজাহান এখনো সমাজ নামের কারগারে বন্দি, ধর্ম নামের বিধান তাদের চলার পথ আগলে দাঁড়ায়, দারিদ্র্য নামের নিষ্ঠুরতা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে তাদের স্বপ্ন-সাধ। তাদের জন্য প্রয়োজন নূরজাহানের মতো লড়াকুদের। প্রয়োজন আরো একটি যুদ্ধ। সর্বব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ।
নূরজাহান বোস যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই নিজেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল করে তুলেছেন আপন কর্ম ও সাধনায়, মানুষের প্রতি আকুণ্ঠ প্রীতি এবং ভালোবাসায়। জীবনের নানা ঘাটে, নানা দেশে বিচিত্র মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, তাদের নীতি ও ইতি দুটিই অকপটে বলেছেন।
গত ২৭ এপ্রিল বুধবার বিকেলে ‘আগুনমুখার মেয়ে’ গ্রন্থটি নিয়ে এক অন্যরকম আড্ডার আয়োজন করেন  বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র। এ সময় সংগঠনের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, নূরজাহান বোস এখনও লড়াই করে চলেছেন। তাই তার আত্মজীবনী আজও চলমান, জীবন্ত এবং উত্তপ্ত। তার জীবনের এই চলমানতা অব্যাহত থাকুক। নূরজাহান বোস বলেন, আমি সারাজীবন ধরে সংগ্রাম করে আসছি। আমার এই আত্মজীবনীতে কেবল আমার কথা নেই বাঙালির অন্দর মহলের নানা খুঁটিনাটি ঘটনা, অন্যদিকে বৃহৎ পরিসরে বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনকাহিনী এবং এদেশের নারীর জীবনসংগ্রামের কথাও বাদ যায়নি।
আড্ডায় আরো কথা বলেন, নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সহ-সভাপতি দিল মনোয়ারা মনু, চিত্রশিল্পী রোকেয়া সুলতানা, কোষাধ্যক্ষ আকতার জাহান মালিক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের জনকল্যাণ সম্পাদক উম্মুল ওয়ারা সুইটি, নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সদস্য শাহনাজ পলি, নাসরিন সুলতানা, নাসরিন শওকত, দিলরুবা খান, তাসকিনা ইয়াসমিন, আনজুমান আরা শিল্পী, মাহমুদা আকতার, শরীফা বুলবুল, তামান্না অলি প্রমুখ।

আনজুমান আরা শিল্পী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন