ফেনীর আলোচিত মাদ্রাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফির গায়ে আগুন দিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আরও অন্তত ১২ জন জড়িত। রোববার মামলার অন্যতম দুই সন্দেহভাজন আসামী নূরুদ্দিন এবং শাহাদত হোসেন শামীম আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে তাদের নাম উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনের নামও রয়েছে। বাকিদের বেশিরভাগই ওই মাদ্রাসার আলিম ও ফাজিল শ্রেণির শিক্ষার্থী। ঘটনায় জড়িত ছিলেন মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষকও। এর ফলে অন্তত ২৫ জন এই মামলায় আসামি হতে যাচ্ছেন।
রোববার দীর্ঘ ৯ ঘন্টা ধরে ফেনী জেলা ও দায়রা জজ আদালদের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ জাকির হোসাইন। তাদের দু’জনের জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে এজাহারভুক্ত আসামি নুরুদ্দিন ও শাহাদাত পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
এর আগে ঢাকায় পিবিআই সদর দপ্তরে এজাহারভূক্ত আসামীসহ মোট ১৩ জন হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত বলে জানান পুলিশের এই ইউনিটের প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। পিবিআই-এর ফেনীর দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান রাতে জবানবন্দি গ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের বলেন, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে নুরুদ্দিন ও শাহাদাত অনেক তথ্য দিয়েছে। তারা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে। প্রিন্সিপাল সিরাজের নির্দেশে তারা কিভাবে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল এবং তা বাস্তবায়নের জন্য কীভাবে কী করে তা বিস্তারিত বলেছে।
পিবিআই-এর এই কর্মকর্তা বলেন, নুরুদ্দিন ও শাহাদাত আরও কিছু নাম বলেছে। আমরা তদন্তের স্বার্থে তা প্রকাশ করছি না। এসব তথ্য যাচাই বাছাই করে বাকিদেরও গ্রেপ্তার করা হবে।
সরাসরি হত্যাকান্ডে অংশ নেয়া শাহাদাত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে জানায়, নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর সে দৌঁড়ে নিচে নেমে উত্তর দিকের প্রাচীর টপকে বের হয়ে যায়। এর মিনিট খানেকের মধ্যে নিরাপদ স্থানে গিয়ে সে রুহুল আমিনকে ফোনে আগুন দেয়ার বিষয়টি জানায়। সে সময় রুহুল আমিন বলে, আমি জানি। তোমরা চলে যাও।
শাহাদাত বলেছে, নুসরাতের দায়ের করা মামলার পর রুহুল আমিন থানা ম্যানেজ করার দায়িত্ব নিয়েছিল। এজন্য সে সিরাজের পরিবারের কাছ থেকে টাকাও নেয়।
নুসরাতের প্রতি নিজেরও ক্ষোভ থাকার কথা উল্লেখ করে শাহাদাত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বলেছে, দেড় মাস আগেও সে নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু নুসরাত তাকে প্রত্যাখান করার পাশাপাশি অপমানও করে। এ কারণে সে নিজেও নুসরাতের প্রতি ক্ষুদ্ধ ছিল। যার ফলে সিরাজের নির্দেশে অন্যদের সঙ্গে নিয়ে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়।
আরেক আসামী নুরুদ্দিন জানিয়েছে, তার সঙ্গে সিরাজের ভালো সম্পর্ক ছিল। এ কারণে তার নির্দেশে তারা পরিকল্পনা করে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ঘটনার সময় সে ভবনের নিচে ছিল। আর পরিকল্পনা অনুযায়ী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও সিরাজের ভাগনি পপি গিয়ে নুসরাতকে ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে যায়। মূলত এই পপিই হলো নুসরাতের জবানবন্দিতে বলে উল্লিখিত আলোচিত শম্পা। পুলিশ ও নুসরাতের পরিবারকে বিভ্রান্ত করতে শম্পা নামে কল্পিত চরিত্রের গল্প ফাঁদে নুরুদ্দিন।
নুরুদ্দিন জানিয়েছে, সিরাজ নানা সময়ে ছাত্রীদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাদের যৌন হয়রানি করতো।
ফেনীর সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত আক্তার রাফিকে যৌন হয়রানি করেছিল ওই মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল সিরাজুদৌলা। এ ঘটনায় নুসরাত থানায় অভিযোগ করলে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর থেকেই মাদ্রাসার সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে নুসরাতের যৌন হয়রানির মামলা তুলে না নেয়ায় তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। গত ৬ই এপ্রিল পরীক্ষার আগ মুহুর্তে মিথ্যা কথা বলে নুসরাতকে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে গিয়ে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়া হয়। শরীরের প্রায় ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় জীবনের সঙ্গে লড়াই করে হেরে যান তিনি। গত ১০ই এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মৃত্যু হয় তার ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন