গত ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দু’টি মসজিদে নামাজ পড়তে আসা মুসলমানদের ওপর চালনো বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়েছিল। সে শোকাবহ ঘটনার রেশ কাটার আগেই দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় ঘটে গেল আরেক নরমেধযজ্ঞ। গত ২১ এপ্রিল ইস্টার সানডে’র দিন একযোগে তিনটি গির্জা ও তিনটি অভিজাত হোটেলসহ আটটি স্থানে বোমা হামলা চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। প্রাথমিকভাবে মৃতের সংখ্যা ২৯০ বলা হলেও পরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ শ’ ৬০ জনে। আহত পাঁচ শতাধিক। দীর্ঘ ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের পর শ্রীলঙ্কায় এটাই সবচে বড়ো সন্ত্রাসী হামলা। এমন কি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এটা সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলা বলে উল্লেখ করা হয়েছে গণমাধ্যমে।
ওই হামলার পর আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয়েছে এর নেপথ্য শক্তি কারা তা নিয়ে। শ্রীলঙ্কার সরকার শুরুতেই কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে দায়ী না করলেও বলেছে, এ হামলাকারীরা সে দেশেরই নাগরিক। প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা বলেছেন, এ হামলায় স্থানীয় সন্ত্রাসীদের বিদেশি সন্ত্রাসীরা মদদ দিয়েছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।ঘটনার যে বিবরণ সংবাদমাধ্যমে এসেছে তাতে দেখা যায়, মাত্র কুড়ি মিনিটের একটি সমন্বিত অপারেশনে শ্রীলঙ্কা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। সকাল পৌনে নয়টায় রাজধানী কলম্বো থেকে ২০ মাইল উত্তরের শহর নেগোম্বোতে সেন্ট সেবাস্তিয়ান চার্চে প্রথম হামলা চালানো হয়। এরপরপরই সেইন্ট অ্যান্থনি চার্চ, জিয়ন চার্চ, কলম্বোর পাঁচ তারকা হোটেল সাংগ্রি লা, কিংসবারি, ও সিনামন গ্র্যান্ডে বোমা হামলা চালায় আত্মঘাতীরা।দেশটির মন্ত্রিসভার মুখপাত্র রাজিথা সেনারতে্ন ঘটনার দিনই বলেছেন, স্থানীয় উগ্রবাদী ইসলামী দল ন্যাশনাল তাওহিদী জামাত (এনটিজে) এ হামলার সঙ্গে জড়িত। তবে, আন্তর্জাতিক কোনো গোষ্ঠী এনটিজেকে সমর্থন করেছে কি-না সরকার তা তদন্ত করে দেখছে। তিনি এও বলেছেন, তারা বিশ্বাস করেন না যে, দেশের ভেতরের কোনো গোষ্ঠী এ হামলা চালিয়েছে। হামলায় আন্তর্জাতিক নেওয়ার্ক জড়িত। আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ছাড়া এ ধরনের হামলা সফল হতো না। সেনারতে্নর কথার সত্যতা পাওয়া যায় দুইদিন পরেই। মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) লঙ্কা হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, হামলার বেশ কয়েকদিন আগেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা থেকে শ্রীলঙ্কার গোয়েন্দা দফতরকে এ ধরনের হামলার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল। তা সত্বেও দেশটির প্রতিরক্ষা বিভাগ, পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কেন আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, সেটা একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
ঘটনাটি আমাদের জন্য আরো দুঃখজনক। কারণ সন্ত্রাসীদের বোমা কেড়ে নিয়েছে আমাদের দেশের একটি নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ। একই সাথে গুরুতর আহত হয়েছেন শিশুটির পিতা।নিহত শিশু জায়ান চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই সাবেক মন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নাতি। বাবা-মা’র সাথে শ্রীলঙ্কা বেড়াতে গিয়েছিল জায়ান। ওইদিন হোটেলের ডাইনিং হলে বাবার সাথে নাশতা করছিল সে। আর তখনই এক সন্ত্রাসী সেখানে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়। শিশু জায়ানের করুণ মৃত্যু আমাদেরকে বেদনাহত করেছে। গত ২৪ এপ্রিল তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে।তার পিতাএখনো কলম্বোর একটি হাসপাতালে জীবনের জন্য লড়ছেন দুই পা হারিয়ে।শ্রীলঙ্কা আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সহযোগিতা ফোরাম সার্কেরও সদস্য রাষ্ট্র। সেদিক থেকে এ ঘটনায় আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ হামলার প্রভাব যে বাংলাদেশে পড়বে না তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। বরং নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা সে আশঙ্কাই করছেন।বাংলাদেশও যে উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য তা পরিষ্কার হয়ে গেছে ২০১৬ সালের ১ জুলাইহলি আর্টিজান হামলার মধ্য দিয়ে। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, হলি আর্টিজান হামলায় অংশগ্রহণকারীরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক ছিল। শ্রীলঙ্কার হামলার হোতারাও সে দেশেরই নাগরিক।
একটি হামলা কতগুলো পরিবারকে নিমিষেই বিপর্যস্ত করে দিতে পারে, কত স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিতে পারে, কত প্রতিভার অকাল মৃত্যু ঘটাতে পারে, তা হয়তো হামলাকারীরা হিসাব করে না। তারা এটাও ভেবে দেখে না যে, তাদের এ মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড মানুষের অধিকারকে খর্ব করছে। তারা কী উদ্দেশ্যে এসব সন্ত্রাসী হামলা করছে, তাও স্পষ্ট নয়। নিউজিল্যান্ডের মসজিদে হামলাকারীর উদ্দেশ্য আজো জানা যায়নি। তেমনি শ্রীলঙ্কার হত্যাযজ্ঞের উদ্দেশ্য ও স্পষ্ট নয় এখনো পর্যন্ত। বলা হয়েছে, আইএস এ হামলার দায় স্বীকার করেছে।তবে, বার্তা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, আইএস হামলার দায় স্বীকার করলেও তার স্বপক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ এখনো দেয়নি। সেটা দিক বা নাদিক, এটা অন্তত জানা গেল যে, এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পেছনে মদদদাতা শক্তিটি কারা।
এ ভয়াবহ বোমা হামলার পর শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দীর্ঘদিন আত্মঘাতী সংঘাতে লিপ্ত থাকার পর দেশটি যখন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, ঠিক সে সময়ে এমন হামলা নতুন করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পূর্বাভাস কি-না সে প্রশ্ন উঠেছে। এমনিতে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক পরিবেশ দৃশ্যত শান্তিপূর্ণ মনে হলেও সরকারের অভ্যন্তরে নানা টানাপোড়েনের খবর অজানা নয়। রাষ্ট্রপতি মাইথ্রিপালা সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের মধ্যে মতানৈক্য ও ক্ষমতার টাগ অব ওয়ার গোপন কোনো বিষয় নয়।দুই প্রধান চেয়ারের এ দ্ব›দ্বসরকারের অভ্যন্তরে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি করেছে। শ্রীলঙ্কার প্রশাসনযন্ত্রের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বহীনতা ও স্থবিরতার বিষয়টি এ হামলার ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যে কারণে দেশটির সামরিক-বেসামরিক কোনো গোয়েন্দা সংস্থাই এ ধরনের একটি হামলা সম্পর্কে আগাম কোনো তথ্য সরকারকে দিতে পারেনি।ইস্টার সানডে’র মতো খ্রীষ্টানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে যে ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া দরকার ছিল, তার কিছুই নেয়া হয়নি। এমন কি চার্চ কিংবা হোটেল, কোথাও আর্চওয়ে ছিল না। ছিল না আগতদের শরীরে বিষ্ফোরক বা অস্ত্র আছে কি-না তা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা। গৃহযুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসা একটি দেশের সরকার শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কেন ব্যর্থ হলো, এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
একটি বিষয় লক্ষণীয়, ঘটনার পর শ্রীলঙ্কা সরকার হুট করেই কোনো ব্যক্তি বা দলের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেনি। বলে দেয়নি যে, হামলার জন্য বিরোধী দল দায়ী। বরং সরকার তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে প্রকৃত হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে। যদিও এ আত্মঘাতী হামলায় অংশ নেয়া কাউকেই জীবিত পাওয়া যায়নি। তবে, তাদের পরিচয় বের করে সে সূত্র ধরে এর পেছনের শক্তির সন্ধানেই শ্রীলঙ্কার সরকার এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, এই নৃশংস ঘটনার তদন্তের জন্য সরকার আন্তার্জাতিক সহযোগিতাও চেয়েছে। এরপরই ইন্টারপোল ও এফবিআই তদন্তে সহযোগিতা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
এদিকে ঘটনার পর এর নানা দিক নিয়ে চলছে আলোচনা-পর্যালোচনা। কারা কোন উদ্দেশ্যে এ প্রাণঘাতী হামলা চালালো তা নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। শ্রীলঙ্কা সরকার বলেছে, স্থানীয় একটি জঙ্গী গোষ্ঠী বিদেশি কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের মদদে এ হামলা চালিয়েছে। এদিক দিয়ে আইএসের দায় স্বীকার সে সন্দেহকে সত্যি বলেই প্রমাণ করে।শ্রীলঙ্কা সরকারের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, এ পর্যন্ত নয়জন হামলাকারীকে চিহ্নিত করা গেছে, তাদের মধ্যে একজন নারী। সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে অন্তত ৬০ জনকে। শ্রীলঙ্কা পুলিশ জানিয়েছে, হামলাকারীরা সবাই শ্রীলঙ্কার নাগরিক এবং উচ্চ শিক্ষত। তাদের কেউ কেউ বৃটেন ও অষ্ট্রেলিয়া থেকে উচ্চতর ডিগ্রিধারীও। হামলাকারীদের পরিচয়ের সূত্র ধরে তাদের স্বজনদের বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। এ রকম একটি বাড়িতে গেলে নিহত হামলাকারীর স্ত্রী বিষ্ফেরণ ঘটালে ওই নারীসহ তিন পুলিশ নিহত হয়েছে।
এদিকে গত ২৩ এপ্রিল রাতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট মাইদ্রিপালা সিরিসেনা হামলা ঠেকাতে সংশ্লিষ্টদের চুড়ান্ত ব্যর্থতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিরক্ষাবাহিনীর প্রধানদের সরিয়ে দেয়া হবে। সিরিসেনা ইতোমধ্যেই পুলিশ প্রধান ও প্রতিরক্ষা সচিবকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে দেশটির সরকারি প্রতিষ্ঠান বিষয়ক মন্ত্রী লক্ষণ কিরিয়েলা পার্লামেন্টে দেয়া ভাষণে বলেছেন, ভারত থেকে যে সতর্কবার্তা এসেছিল, তা শ্রীলঙ্কার কয়েকজন সিনিয়র গোয়েন্দা কর্মকর্তা উদ্দেশ্যমূলকভাবে গোপন করে গেছেন। হাতে তথ্য থাকার পরও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত শীর্ষ কর্মকর্তারা যথাযথ ব্যবস্থা নেননি। এ থেকে এটা পরিষ্কার যে, হামলা যারাই করে থাকুক, তার আগাম তথ্য শ্রীলঙ্কার গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তাদের গোচরে ছিল। তাহলে তারা সে তথ্য কেন চেপে গেলেন? প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা প্রকাশ্যেই বলেছেন যে, ওইসব তথ্য তার সাথে কেউ শেয়ার করেনি।একরকম অন্ধকারেই ছিলেন তিনি। তাহেলে কি শ্রীলঙ্কা সরকারের অভ্যন্তরের কোনো একটি চক্র এ হামলার সাথে জড়িত?নাহলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর গোচরে আনা হলো না কেন? কেউ কেউ সন্দেহ করছেন যে, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বৈরি সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে দেশটিতে আবারো একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য কোনো মহল এটা করে থাকতে পারে। যদি সেরকম কিছু হয়ে থাকে, তাহলে শ্রীলঙ্কাবাসীর জন্য তা যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয়। কেননা, দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময়ের গৃহযুেদ্ধ ব্যাপক প্রাণ ও সম্পদহানির পর দেশটি কেবল মাত্র স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে যদি সরকারের অভ্যন্তরের কোনো শক্তি বিশেষ কোনো খেলায় মেতে ওঠে, তাহলে তা দেশটিকে আবারো গভীর সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন