সো হে ল রা না : এক রাজ্যে একজন সৎ রাজা বাস করতেন। রাজা এতটাই ভালো ছিলেন যে প্রজাদের তার প্রতি কোনো অভিযোগ ছিল না। সবকিছু ঠিকমত চললেও রাজার মনে একটা বড় ধরনের কষ্ট ছিল, কারণ তার কোন সন্তানাদি ছিল না। রাজার একটাই চিন্তা ছিল যে, তিনি মারা গেলে এই রাজ্যের ভার কে নেবে, আর কেউ কি প্রজাদেরকে তার মত সুখে শান্তিতে রাখতে পারবে? এসব ভাবতে ভাবতে রাজা এক সময় অসুস্থ্য হয়ে পড়লেন। রাজার এই অসুস্থ্যতার কথা রাজ্যের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ল। সবাই রাজার জন্য দোয়ার পাশাপাশি রাজার সংসারে যেন একটা সন্তান আসে তার জন্য বিভিন্ন ধরনের মানত করতে থাকল।
এভাবে বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর হঠাৎ একদিন সকালে রাজ দরবারের খুশির খবর শুনতে পাওয়া গেল। একজন দাসি দৌড়াতে দৌড়াতে রাজদরবারে এসে জানিয়ে গেল যে রাজার ছেলে হয়েছে। রাজার কানে খবরটা পৌঁছানোর সাথে সাথে অসুস্থ রাজা বিছানা থেকে উঠে বসলেন। রাজ্যের উজির নাজিররা সবাই আনন্দে লাফালাফি করতে থাকল ঠিকই কিন্তু রাজার নিকটাত্মীয়রা খুব একটা আনন্দিত হলো না। এর কারণ হলো রাজা মারা গেলে হয়ত তারাই সিংহাসনে বসবে এমনটাই ধারণা করেছিল।
নতুন রাজকুমারকে নিয়ে সবাই আনন্দ ফুর্তিতে মত্ত। রাজার নিকটাত্মীয়রাও লোক দেখানো আনন্দ ফুর্তি করছে এবং এর পাশাপাশি কিভাবে রাজকুমারের ক্ষতি করা যায় সেটাও ভাবছে। রাজ্যের প্রজারা দলে দলে রাজকুমারকে দেখতে আসছে এবং তার জন্য দোয়া করে যাচ্ছে। ছোট্ট রাজকুমারকে চোখ খুলতে না দেখে একজন বিজ্ঞ কবিরাজ রাজরাণীকে বললেন- ‘রাণীমা, রাজকুমার জন্মের পর থেকে কী চোখ মেলেননি’? রাজকুমার যে চোখ মেলে তাকাননি সে খবরটা রাণীমা জানতেন না, তাই তিনি দাসিদের এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তারা রাজকুমারকে চোখ মেলে তাকাতে দেখেনি বলে জানায়। তখন বিজ্ঞ কবিরাজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রাণীমাকে বলে - ‘রাজকুমার কখনও চোখ মেলে তাকাবেন না, কারণ তিনি অন্ধ’।
অন্ধ রাজকুমারের খবর রাজ্যের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। অসুস্থ্য রাজা রাজকুমার হওয়ার খবরে কিছুটা সুস্থ হলেও অন্ধ রাজকুমারের খবর শুনে আবারও অসুস্থ্য হয়ে পড়লেন। রাজার নিকটাত্মীয়রাও বেজায় খুশি। তারা এখন ভাবছে যে তাদের মনের স্বাদ বুঝি এবার পূরণ হতে যাচ্ছে। এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর হঠাৎ একদিন রাজা মৃত্যুবরণ করলেন। রাজার মৃত্যুতে রাজ্যে শোকের ছায়া নেমে পড়ল। এই সুযোগে রাজার নিকটাত্মীয়দের একজন সিংহাসনে বসে নিজেকে রাজ্যের রাজা বলে ঘোষণা দিলেন। রাজ্যের এই শোকের সময়ে কেউ কোনো প্রতিবাদ না করে নতুন রাজাকে রাজ্যের অভিভাবক হিসাবে মেনে নিতে বাধ্য হলো।
সুখ শান্তিতে ভরপুর রাজ্য আস্তে আস্তে অশান্তির কালো ছায়াতে ঢেকে যেতে থাকল। নতুন রাজা অত্যাচারী হিসেবে পরিচিত হতে থাকলেন। তিনি অন্ধরাজকুমার ও রাণীমাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন কেউ কখনও জানত না। রাজ্যের প্রজারা মনে করত তারা রাজপ্রাসাদের ভিতরেই আছে কিন্তু আসলে তারা সেখানে ছিল না।
একদিন এক কাঠুরিয়া কাঠ কাটার জন্য জঙ্গলের ভিতরে যাচ্ছিল। যেতে যেতে অনেক দূর থেকে সে কান্নার শব্দ শুনতে পেল। এই গহীন জঙ্গলে কে কান্নাকাটি করছে তা দেখার জন্য এগিয়ে গেল সে। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর দেখতে পেল একজন যুবক এক বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। এসব দেখে সে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতে গিয়ে দেখল এই বৃদ্ধা আর কেউ নয় তিনি হলেন তাদের রাণীমা আর ছেলেটা হলো সেই অন্ধ রাজকুমার। কাঠুরিয়া এক দৌড়ে গ্রামের আরো কিছু মানুষকে নিয়ে এসে অসুস্থ রাণীমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেল এবং অতি গোপনে কবিরাজ এনে তার চিকিৎসা করাতে থাকল। রাজ্যের মানুষজন যেহেতু পূর্বের রাজাকে খুব শ্রদ্ধা করত তাই তারা রাণীমা ও অন্ধ রাজকুমারকে শ্রদ্ধাভরে সেবা ও দেখভাল করতে থাকল।
আস্তে আস্তে রাণীমা সুস্থ হয়ে উঠলেন। তার কাছ থেকে বর্তমান রাজার সকল কুকৃত্তি শুনে প্রজারা রাগান্বিত হয়ে গেল এবং তারা সিদ্ধান্ত নিল যে এই জালিম রাজার বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ ঘোষণা করবে এবং সেই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিবেন রাণীমা নিজেই। প্রজাদের সাহস দেখে রাণীমা তাদেরকে অভয় দিয়ে বললেন রাজ্যের সৌন্যদের অনেকেই এই রাজাকে পছন্দ করে না তাই তাদের কাছে যদি আমাদের এই বার্তা পৌঁছানো সম্ভব হয় তাহলে আমরা খুব সহজেই জালিম রাজাকে পরাজিত করতে পারব। যেই কথা সেই কাজ। রাজ্যের যে সকল মেয়েরা রাজদরবারে কাজ করত তারা দায়িত্ব নিল এই খবর সৌন্যদের কাছে পৌঁছানোর এবং খুব সহজেই সেই কাজটা সম্পন্ন করতে পারল তারা। কয়েকদিনের মধ্যে সৌন্যদের একাংশ রাণীমার সাথে দেখা করে একাত্মতা ঘোষণা করল এবং আক্রমণের দিন ঠিক করল।
একদিন খুব সকালে রাণীমার নেতৃত্বে বিদ্রোহী সৌন্য ও রাজ্যের আপামর মানুষরা রাজদরবারের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল। এই খবর রাজার কানে পৌঁছানো মাত্র সে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রাজদরবারের এক কালকুঠরির মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। কারণ সে জানতে পেরেছিল যে, তার রাজ্যের অধিকাংশ সৌন্য তার বিরোধিতা করে রাণীমার সাথে যোগ দিয়েছে। তাই সে নিজেকে প্রাণে বাঁচানোর জন্য এই কাজ করতে বাধ্য হল।
রাণীমা কোন প্রতিরোধ ছাড়াই রাজদরবার দখল করে নিলেন এবং জালিম রাজাসহ তার অনুসারীদের বন্দি করে ফেললেন। জয়ের আনন্দে আত্মহারা প্রজারা রাণীমার কাছে একটা প্রস্তাব দিলেন যে তারা অন্ধ রাজকুমারকে রাজ্যের রাজা হিসাবে দেখতে চায়। প্রজাদের কথাতে রাণীর চোখ বেয়ে আনন্দের অশ্রু বেয়ে পড়ল। তবুও রাণীমা প্রজাদের উদ্দেশ্যে বললেন- ‘তোমাদের রাজকুমার তো চোখে দেখতে পায় না, তাহলে সে কিভাবে এই রাজ্য পরিচালনা করবে?’। রাণীমার এই প্রশ্নের উত্তরে প্রজারা সবাই একসঙ্গে বলল- ‘অন্ধ রাজকুমার আজ থেকে এই রাজ্যের সকল প্রজাদের চোখ দিয়ে দেখবেন’। রাণীমা ও অন্ধ রাজকুমারের প্রতি প্রজাদের ভালোবাসা ও আনুগত্য দেখে রাণীমা আকাশের দিকে তাকিয়ে তাঁর প্রয়াত স্বামীকে উদ্দেশ্য করে হয়ত এটাই বলছিলেন- ‘হে রাজা, আপনার সৎ জীবন যাপনের পুরস্কার প্রজারা প্রাণের বিনিময়েও দিতে প্রস্তুত’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন