বানেছা বেগম, বয়স ৫৫, চার সন্তানের জননী। ছোট্ট একটি মাটির ঘরে পঙ্গু স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে দিন আনতে পান্তা ফুরায় সংসার। বড় ছেলে বিদেশ করে, একমাত্র মেয়েটি সন্তান সম্ভবা, থাকে অন্যগ্রামে। এক অজানা রোগে বানেছা বেগমের স্বামী মনু মিয়া ঘরে পরে আছে প্রায় তিন বছর যাবত। লোকে বলে খারাপ বাতাস, ঝাড় ফুঁক পানি পরা কোন কিছুতেই মনু মিয়ার পায়ের জোর ফেরেনা। প্রতি হাঁট বারে মায়ের বানানো ঝুড়ি, চাঁটাই বিক্রি করে ছোট ছেলে দুটো যা আনে তাই দিয়ে কোন রকমে একবেলা খেয়ে না খেয়ে দিন যায় বানেছা বেগম ও তার পরিবারের।
বলা নাই কওয়া নাই হঠাত বিদেশ যাওয়ার পোকা ঢুকলো বড় ছেলের মাথায়। চলিশ হাজার টাকা হলেই নাকি বিদেশ যাওয়া যায়। আর একবার বিদেশ যেতে পারলেই কোন চিন্তা নাই। এক মাসের বেতনই নাকি চলিশ হাজার। বিদেশ মানেই নাকি প্রতিবেলায় গরম ভাত সাথে মাছ মাংস। বিদেশ মানেই নাকি দোচালা ঘর, বিদেশ মানেই নাকি গোয়াল ঘরে দুই তিনটা গাই গরু। বিদেশ মানেই বাপের পায়ে জোর, বিদেশ মানেই বানেছা বেগমের হাতে সোনার চুড়ি। এরকম কতো কথাই যে বলতো ছেলেটা। দিন নাই রাত নাই ঘ্যান ঘ্যান আর ঘ্যান ঘ্যান। এক চিমটি হলেও নিজের জমি বলে কথা। সেইটা ক্যামনে বন্ধক দিবে!! কিছুতেই রাজী হয়না বানেছা বেগম। শেষমেশ ছেলে যেদিন পানিতে ডুবে মরার ভয় দেখালো, বানেছা বেগম ঠিক করলো যা হওয়ার হবে, দরকার হলে গাছতলায় থাকবে, তবু ছেলে বেঁচে থাক। ভিটে বাড়ি বন্ধক রেখে ছেলের হাতে চলিশ হাজার টাকা তুলে দিলো। ছেলে গেলো বিদেশ করতে। সেই যে গ্যালো আজ পর্যন্ত কোন খবর নাই তার। আহারে, ছেলেটার মুখ মনে হলেই বানেছা বেগমের খালি পেট পোড়ায়।
কুপি জ্বালানোর সাধ্যটুকু পর্যন্ত নাই। দিনের আলো নিভলো কি ঘুটঘুট্টি অন্ধকার নামে বন্ধকি ভিটায়। স্বামী ঘুমায়, ছেলেরা ঘুমায়, বানেছা বেগমের ঘুম আসেনা। গভীর রাতে উঠে বসে। খুব সাবধানে শাড়ীর গিট খোলে। একজোড়া সোনার দুল অন্ধকারে চকচক করে ওঠে। বানেছা বেগম একবার হাতের মুঠো খোলে আবার বন্ধ করে। কানের দুলজোড়া যেনো মুহূর্তেই জোনাকী পোকা। জ্বলে আর নেভে। কি যে ভালো লাগে!! কি ভীষণ ভালোই যে লাগে!! একেক বার বুকের মধ্যে চেপে ধরে। চাপা উত্তেজনায় নিঃশ্বাস বুঝি বন্ধ হয়ে যায়। একেক বার নাকের কাছে এনে ধরে। দুলজোড়া থেকে কেমন সুবাস আসে। একেক বার চোখের সামনে মেলে ধরে। আবেশে চোখ বুজে আসে । রাত ফুরায়, তবু দেখা শেষ হয়না। এক সময় আবার শাড়ির গিটে খুব সাবধানে বেধে রাখে দুলজোড়া। তারপর কতো কথাই যে ভাবে!!
পেটে খাওয়া নাই, তবু নিশ্চিন্ত ঠাঁইটুকু তো ছিল। আজ সেটাও হারাতে বসেছে। দুই ছেলে আর পঙ্গু স্বামীর কথা ভেবে অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে বানেছা বেগমের। বন্ধকী ছাড়িয়ে আনতে হবে। নাহ! এবার কানের দুলজোড়া বিক্রি করে দিতেই হবে। যে টাকা পাওয়া যাবে তাই দিয়ে একটা বড় অংশ তো শোধ হবে। তারপর একটু একটু করে একদিন পুরো জমিটুকুই ছাড়িয়ে আনবে। কানের দুলজোড়া বড় ভরসা দেয় তাকে। বেদম সাহসে তিরতির করে কাঁপতে থাকে বানেছা বেগম।
কোন কোন রাতে মেয়ের কথা ভেবে চোখ ভিজে যায়। ঝাঁপসা চোখে শাড়ির গিট খোলে। অন্ধকারে জ্বলে ওঠে জোনাকী। দুল জোড়া বুকে চেপে ভাবে, আর দেরী না। কালই মধু স্যাকরার কাছে যাবে, বেচে দিবে। মেয়েটা স্বামীর ঘরে বড় কষ্টে আছে। খাওয়ার কষ্ট, পরার কষ্ট, কটু কথার কষ্ট, কালশিটের কষ্ট। আহারে, বড় আদরের মেয়ে ছিলো, একমাত্র মেয়ে বলে বাপের আহ্লাদী ছিলো খুব। কোন দিন গাল মন্দ শোনেনি। কতো কষ্টেই না আছে মেয়েটা। কানের দুল জোড়া বিক্রি করে মেয়েটাকে একটু নিজের কাছে এনে রাখবে। এই সময় মেয়েদের বাপের বাড়ি আসতে মনে চায়। দুল বিক্রির টাকায় দুই একটা ভালো শাড়ি কিনে দিবে। একটু ভালো মন্দ খাওয়াবে। তারপর বাচ্চা হলে একটা ভীষণ কান্ড করবে বানেছা বেগম। বাচ্চার গলায় সোনার তাবিজ বেঁধে দিবে। শ্বশুরবাড়ির সবাই হা হয়ে দেখবে! সদর্পে সন্তান কোলে নিয়ে স্বামীর ঘরে ফিরবে মেয়ে। আহা!! এসব ভাবতেই একরাশ সুখ মাগুর মাছের মতো ঘাই মারে বুকের মধ্যে। শব্দ করে হেসে ওঠে বানেছা বেগম। তারপর আবার শাড়ির আঁচলে দুলজোড়া বেঁধে রাখে।
পঙ্গু স্বামীর কথা ভেবে কতো রাত যে ভোর হয় সে শুধু বানেছা বেগমই জানে। খাওয়া পরার অভাব ছিলো ঠিকই তবে সুখের অভাব ছিলোনা কোনদিন। তাগড়া জোয়ান মানুষটা কেমন জড়িয়ে ধরতো যখন তখন !! ভাবতেই শরীর শিউরে ওঠে বানেছা বেগমের। কি যে হলো, আস্তে আস্তে বিছানা নিলো মনু মিয়া। নিজের উপরে খুব রাগ হয় বানেছার। টাকা পয়সা নাই, ঝাড় ফুঁকের বাইরে আর তো কিছুই করতে পারে নাই। সদরের হাসপাতালে নিলে হয়তো ভালো হয়ে যেতো লোকটা। মুঠোয় বন্দী দুলজোড়া যেনো হাঁসফাঁশ করতে থাকে। বানেছা বেগম ভাবে, আর দেরী না। দুলজোড়া এবার বিক্রি করবেই। সেই টাকায় স্বামীর চিকিৎসা হবে। আবার দুই পায়ে ভর দিয়ে সিনা টান করে উঠে দাঁড়াবে মনু মিয়া। অন্ধকারে মনু মিয়ার ঘুমন্ত শরীরে হাত বুলায় বানেছা বেগম আর থেকে থেকে শিউরে ওঠে।
বানেছা বেগমের মনে বড়ই ইচ্ছা বাপজানের কব্বরটা পাকা করার। ঝড় বর্ষায় বাঁশের বেড়া কবে ভেঙে গেছে। একটা মোবাইল ফোনের বেজায় দরকার। মোবাইল থাকলে বড় ছেলেটার সাথে হয়তো কথা হতো। বানেছা বেগম জানতে পারতো বিদেশে ছেলেটা কেমন আছে। জানাতে পারতো ছেলের চিন্তায় তার কেমন পেট পোড়ে। ছোট ছেলে দুইটার একটা বড়ই দিকদারী আরম্ভ করেছে। ঢাকায় যাবে, গারমেন্সে চাকরী নিবে। বড় ভাইটার মতোই হাত নেড়ে নেড়ে বলে, একবার ঢুকলে খালি টাকা আর টাকা। বাপকে নাকি ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করাবে। এই সেই কতো কি!! এক ছেলের খবর নাই, আরেক ছেলেকে কিছুতেই হারাতে চায়না বানেছা বেগম। ভাবে দুলজোড়া বিক্রি করে ছেলে দুটোকে গ্রামেই একটা মুদি দোকান করে দেবে। শহরে যেতে দেবেনা কিছুতেই। এমন সব হাজারো চিন্তায় রাতের পর রাত কেটে যায়।
এমনি এক অন্ধকার রাতে সোনার দুলজোড়া হাতে নিয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে বানেছা বেগম। ভাবতে ভাবতে রাত প্রায় ভোর। দুলজোড়া শাড়ির আঁচলে বেঁধে একটু সময়ের জন্যে ঘুমিয়ে পরে। ঘুম ভাঙতেই প্রতিদিনের মতো প্রথমে আঁচলে হাত দিয়ে চিৎকার করে ওঠে বানেছা বেগম। গিট খোলা!! কানের দুলজোড়া নেই!! কে যেনো হৃদপিণ্ড খামচে ধরে। বানেছা বেগমের জগত সংসার কেঁপে ওঠে। কে তার এত বড় সর্বনাশ করল!! এই কানের দুলজোড়াই তো তাকে মরতে দেয়নি এতদিন। দুলজোড়া ছিলো বলেই আশায় বুক বেঁধেছে বানেছা বেগম। স্বপ্ন দেখেছে। ছেলের সাথে কথা হবে একদিন। শ্বশুরবাড়িতে মেয়েটা মাথা উঁচু করে হাঁটবে। স্বামী সুস্থ হবে। ছোট ছেলেদুটো মুদি দোকান চালাবে। ভিটাবাড়ী নিজের হবে আবার। রাতের পর রাত স্বপ্ন দেখেছে। ভেবেছে সকালে উঠেই মধু শ্যাকরা। কিন্তু পারেনি। বিক্রি করতে পারেনি। দিনের পর দিন শাড়ীর গিটে বেঁধে রেখে দুলজোড়া। কেমন করে বিক্রি করবে!! বেচে দিলেই তো শেষ। একজোড়া সোনার দুলে কি এত্তগুলো স্বপ্ন পুরন হয়!! তাইতো স্বার্থপরের মতো হাতছাড়া করেনি। শরীরের মধ্যে বেঁধে রেখেছে সারাক্ষন। আজ তার কিছু নাই। ভিটা নাই, স্বামীর দুপায়ে জোর নাই। মেয়ের পরনে নতুন কাপড় নাই, তার অনাগত সন্তানের গলায় ধান তাবিজ নাই। ছেলে নাই, স্বপ্ন নাই। নাই নাই নাই। বানেছা বেগমের স্বপ্ন চুরী হয়ে গেছে। বানেছা বেগমের হাহাকারে কেঁপে উঠছে ছোট্ট মাটির ঘর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন