বাংলা বিহার উড়িষ্যার দাপুটে নবাব ছিলেন আলীবর্দি খান। সময়কাল ১৭৪০ থেকে ১৭৫৬। ১৬০০ সালেই ইংরেজ বণিকেরা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ভারত উপমহাদেশে আগমন করে। বণিকদের সাফল্য, প্রাচ্যের ধন-সম্পদের প্রাচুর্য ইংরেজ বণিকদের এ অঞ্চলে ব্যবসায়-বাণিজ্যে উৎসাহিত করে। বাংলার ধন সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তারা সুরাটে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। এর পরের ইতিহাস শুধুই বণিকদের, ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাদের।
ইংরেজ বণিকদের প্রভাব-প্রতিপত্তি এতই বেড়ে যায় যে তারা আর বাংলার স্বাধীন নবাবদের মানতে চান না। প্রায়শঃ লুন্ঠন, হত্যা, বিনা বিচারে জেল-জুলুম চলতে থাকে। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দি খান বিচক্ষণতা ও সফলতার সাথে রাজ্য শাসন করেন। তিনি মারাঠা ও বর্গিদের তাড়াতেও সফল হন। বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ইংরেজ বণিক কোম্পানি নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পরে বাংলার রাজনীতিতে কঠিন দুঃসময় চলতে থাকে। রাজ্যে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
নবাব আলীবর্দি খান মৃত্যুর আগে তার ছোট মেয়ে আমেনা বেগমের পুত্র সিরাজউদ্দৌলাকে বাংলার সিংহাসনে উত্তরাধিকার নির্বাচন করে যান। ১৬৫৬ সালে নবাব আলীবর্দি খানের মৃত্যু হলে তার প্রিয় দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা মাত্র ২২ বছর বৎসর বয়সে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব নেন। অনভিজ্ঞ ও অল্প বয়স হলেও নবাব সিরাজউদ্দৌলা দক্ষ হাতে নানার মতই রাজ্য চালাতে সচেষ্ট হন। চতুর ইংরেজরা নতুন নবাবকে কোন ভাবেই মেনে নিতে চায়না। ইংরেজরা সিরাজউদ্দৌলাকে উপেক্ষা করতে থাকেন। নতুন নবাব নির্বাচিত হওয়ার পর নবাবের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ পর্যন্ত ইংরেজরা করেনি। ইংরেজদের এমন আচরণে নবাব খুব রেগে যান। নবাবকে উপেক্ষা করে ইংরেজরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হয়। তারা দূর্গ পর্যন্ত তৈরী করতে থাকে। বাণিজ্যিক শর্ত ভঙ্গ করে নবাবের আদেশ পর্যন্ত অমান্য করে। সাধারণ মানুষ, দেশীয় বণিকরা ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে। ইংরেজরা রাজ্য জুড়ে একটা ভয়াবহ ত্রাস সৃষ্টি করে। নতুন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে বিদেশী বণিকদের যখন এই অবস্থা তখন দেশীয় দুশমনরা মাথাচারা দিয়ে ওঠে। নবাবের আপন খালা ঘসেটি বেগম ভাগ্নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। সিরাজউদ্দৌলাকে সে কোন ভাবেই নবাব হিসেবে দেখতে চান না। তার স্বপ্ন ছিল সে নবাব হবে। আশাহত ঘসেটি বেগম তার দেওয়ান রাজা রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস, উমি চাঁদ, জগৎশেঠ এরা সবাই মিলে সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এ ষড়যন্ত্রের খবর জানতে পেরে নবাব ঘসেটি বেগমকে বন্দি করেন। খালাতো ভাই শওকত জঙ্গ’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে তাকে নিহত করে পূর্ণিয়া দখল করে নেন। এরপর কিছু ষড়যন্ত্রকারী আতœগোপন করে এবং কিছু সিরাজের সাথে মিশে যেয়ে তার কৃপা লাভের চেষ্টা করে। ইতোমধ্যে বাংলায় ইংরেজরা একটা মজবুত আসন গড়তে সক্ষম হয়েছে। ইংরেজ বণিকদের মধ্যে সব থেকে ধুর্ত-চালবাজ এবং হিং¯্র হিসাবে পরিচিতি লর্ড ক্লাইভ কলকাতায় এসে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ইংরেজদের অপমানজনক আচরণে নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ আর হাত গুটিয়ে বসে থাকলেন না। তিনি একবার ভেবে নিলেন এখনই উপযুক্ত সময় তাদের শায়েস্তা করার। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে জুন মাসের শুরুতে কলকাতা দখল করে নেন। কাশিমবাজার কুঠিও দখলে নেন। সিরাজের হঠাৎ আক্রমনে হতবিহম্বল ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ ছেড়ে পালিয়ে যায়। মিথ্যাবাদী, প্রকারক এবং কুটবুদ্ধির রাজা হলওয়েল সহ বেশ কিছু ইংরেজ নবাবের সেনাদের হাতে বন্দি হন।
নবাবের মনে অল্প সময়ের জন্য স্বস্তি ফিরে এলেও তা আবার উড়ে যেতে সময় লাগেনা। হলওয়েল বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালাতে থাকে যে, - নবাবের সৈন্যরা ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ১৪ ফুট প্রস্থ একটা ছোট ঘরে ১৪৬ জন ইংরেজ বন্দিকে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। প্রচন্ড গরমে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ১২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।’ এই মিথ্যা প্রচার ওয়াটসন এবং ক্লাইভের কান পর্যন্ত পৌছায়। ভারতের অন্যান্য কুঠি থেকে সৈন্য ও অস্ত্র সংগ্রহ করে ক্লাইভ কলকাতা আক্রমণ করে নবাবের সেনাপতি মানিক চাঁদকে পরাজিত করে কলকাতা দখল করে। ইংরেজেদের সাথে নতুন করে যোগ দেয় দেশি বণিক জগৎশেঠ, রায়দূর্লভ, উমিচাঁদ এবং সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীর জাফর প্রমূখ। নবাব সিরাজউদ্দৌলা বুঝতে পারেন তার চারিদিক শত্রæ। তিনি ক্লাইভের সাথে সন্ধি করেন। এটি ইতিহাসে আলীনগর সন্ধি নামে পরিচিত। নবাবের এই নতজানু সন্ধিতে ইংরেজরা বেশি বেশি সুযোগ সুবিধা দাবী করতে থাকে। তারা নবাবকে নানাভাবে পরাজিত করার ফন্দি আটতে থাকে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার দূরদর্শিতা, অভিজ্ঞতা ও দৃঢ়তার অভাব ছিল বলেই ক্লাইভ এতো দ্রæত সিদ্ধান্ত নিয়ে নবাবকে পরাজিত করতে উদ্যেত হয়। নবাবের সামনে যুদ্ধ করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকে না।
পলাশিযুদ্ধ অতঃপর :
পলাশির যুদ্ধ ছিল বাঙালিদের পরাজয়ের ইতিহাস। মুসলমান শাসনের পরাজয়ের ইতিহাস। স্বাধীনতা হারানোর ইতিহাস। এক মহান এবং উদার যুবক শাসকের পরাজয়ের ইতিহাস। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক ঘটনাও বটে। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ২৩ জুন ভাগিরথী নদীর তীরে পলাশির আমবগানে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সন্ধিভঙ্গের অভিযোগ তুলে ক্লাইভও যুদ্ধ ঘোষণা করে। নবাবের পক্ষে দেশ প্রেমিক মীর মদন, মোহন লাল এবং ফরাসি সেনাপতি সিন-ফ্রে প্রাণপণ যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে মীরমদন নিহত হন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সৈন্যরা যুদ্ধে অসীম সাহস প্রদর্শনের মাধ্যমে জয়ের পথে এ সময় সেনাপতি মীর জাফর যুদ্ধ থামিয়ে দেন। নবাব বিচলিত! মীর জাফরের অসহযোগিতা বুঝতে পারলেও নবাবের কিছুই করার থাকে না। মীর জাফর স্বাক্ষী গোপালের মত দাড়িয়ে নবাবের পরাজয়কে ত্বরান্বিত করে তোলে। ধর্ম গ্রন্থ স্পর্শ করে শপথ নেয়ার পরও জাফরের ষড়যন্ত্র থেমেু থাকলো না। নবাবের সৈন্যদের দুর্বলতা বুঝতে পেরে ইংরেজ সৈন্যরা দ্রæতই আক্রমণ করে। যার অনিবার্য পরিণতি নবাবের পরাজয়।
বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সহজ সরল আচরণ ছিল বলেই বারবার ষড়যন্ত্র করা সত্তে¡ও মীর জাফরের প্রতি তাঁর নির্ভরশীলতা দেখা যায়। এটা বাঙালির মজ্জাগত স্বভাব। বারবার তাঁরা শত্রæ চিনতে ভুল করে।
মীর জাফরের পুত্র মিরনের আদেশে মুহম্মদী বেগ নামের এক ঘাতক বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
পলাশির যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ইংরেজরা স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অন্যান্য কাজকর্ম করতে থাকে। এ দেশে ইংরেজদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিজয় অর্জন অভিযান শুরু হয়ে যায়। মধ্যবিত্ত সমাজের উথান ও ইংরেজদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিজয় অভিযান বাঙলার মুসলমানদের যে ক্ষতি সাধন করেছে তা শোধরিয়ে নেওয়া আজও সম্ভব হয়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন