শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বেপরোয়া মোটরসাইকেল

আবদুল্লাহ আল মামুন | প্রকাশের সময় : ৩ আগস্ট, ২০১৯, ১২:১২ এএম

রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে মোটরসাইকেল চালাতে বাগেরহাটের রায়েন্দা থেকে ঢাকা এসেছেন আলম খলিফা নামে এক যুবক। রাজধানীতে নতুন এবং তার কাছে নগরীর অলিগলি অচেনা হলেও ভালো ইনকামের আশায় এসেছেন তিনি। রাইড শেয়ারিংয়ে বেশি আয়ের লোভে তার মতো হাজারো মানুষ এখন ছুটছেন রাজধানীর দিকে। বাইক কেনার সামার্থ্য না থাকলেও সমস্যা নেই। ২০-২৫ হাজার টাকা ডাউন পেমেন্টে (এককালীন পরিশোধ) মিলছে বিভিন্ন কোম্পানির মোটরসাইকেল। পরবর্তীতে বিআরটিএ’র এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় কোনরকমে কাগজপত্র নিয়ে নেমে পড়ছে রাস্তায়। এছাড়া বিপুল পরিমাণ মাদকাসক্ত তরুণ-যুবক মাদকের টাকা জোগাড়েও রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন।

একদিকে অচেনা, অদক্ষ ও মাদকাসক্ত চালক, অন্যদিকে বেশি ইনকামের লোভে অনেকে রাইড শেয়ারিংয়ে যোগ দেওয়ায় রাজধানীতে অস্বাভাবিকহারে বেড়ে গেছে মোটরসাইকেল। বর্তমানে ঢাকায় মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৭ লাখের কাছাকাছি। এ তালিকায় প্রতিদিন যোগ হচ্ছে আরও আড়াইশ’র অধিক মোটরসাইকেল। কোন রকম নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই নগরীর রাস্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব বাইক। প্রধান সড়ক ও অলিগলির মতো ফ্লাইওভার ও ফুটপাথ দখল করেও চলে তাদের বেপরোয়া আধিপত্য। এতে জনভোগান্তি ছাড়াও নিয়মিতভাবে মারাত্মক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে চলছে। এর বাইরে এত বিপুল পরিমাণ বাইকের ভারে ঢাকার স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত হয়ে তীব্র জানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছে রাজধানী।

সংশ্লিষ্ট তথ্যমতে, বর্তমানে ঢাকায় নিবন্ধিত বাইকের সংখ্যা ৬ লাখ ৬৭ হাজার। ২০১০ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল দুই লাখ ১০ হাজার। অর্থাৎ গত সাড়ে ৮ বছরে ঢাকায় বাইকের সংখ্যা তিনগুণ হয়েছে। তথ্যমতে, ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নিবন্ধন নিয়ে ঢাকায় মোটরবাইক নেমেছে প্রায় দুই লাখ ২৭ হাজার। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন বাইক নামে ১০৩টি করে। অথচ ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আড়াই বছরে ঢাকায় বাইক নেমেছে প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার। এতে গত আড়াই বছরে গড়ে প্রতিদিন বাইক নেমেছে ২৫২টি করে। যার কারণে ঢাকা জানজট আর বেপরোয়া মোটরসাইকেলের নগরীতে পরিণত হয়েছে।

গত কয়েকদিন, রাজধানীর গুলিস্তান, পল্টন, শাহবাগ, ফার্মগেট, মালিবাগ, মগবাজার, রামপুরা, বাড্ডা, গাবতলীসহ বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে মোটরসাইকেলের এমন বেপরোয়া চিত্র দেখা গেছে। সরজমিনকালে দেখা গেছে, রাজধানীর প্রতিটি সিগন্যালে ৩০ থেকে ৪০টি মোটরসাইকেল দেখা যায়। চালকদের অনেকেই রাজধানীর বাইরে থেকে এসেছেন। একটু ফাঁকফোকর পেলেই টান শুরু করে। ফুটপাথ ও আইল্যান্ডের ওপর দিয়েও চলে হরহামেশা। হর্ন বাজিয়ে পথচারীদের সরে যেতে বলে। আবার অনেক সময় উল্টোপথে চালিয়ে সিগন্যালের সামনে এসে অবস্থান নেয়। সুযোগ পেলে হঠাৎ করে সিগন্যাল অমান্য করে চলতে শুরু করে। অনেকে চলন্ত যানবাহনের সামনে দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে একেবেকে চলে যাচ্ছেন। এসব নতুন চালকরা অদক্ষ ও ভালোভাবে নিয়মকানুন না জানায় প্রায়শঃ পথচারীদের সাথে ঝগড়া ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ব্যস্ত রাস্তার পাশে মোটরসাইকেল পার্কিং করে রাখায় অনেক সময় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। সাধারণদের পাশাপাশি পুলিশকে নিয়ম অমান্য করতে দেখা গেছে। কিছু বাইকের পেছনে নম্বর ছাড়া শুধু ‘পুলিশ’ লেখা দেখা গেছে।

লালবাগের বাসিন্দা মোবিন আহমেদ বলেন, রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে মোটরসাইকেল চালানো লোকদের মধ্যে গ্রাম থেকে আসা অদক্ষ চালকদের সংখ্যা অনেক বেশি। তারা নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে মূল রাস্তার পাশাপাশি ফুটপাথ দখল করেও চলাচল করে। তাদের কারণে ফুটপাথ দিয়ে হাটা দায় হয়ে পড়ে।
ফার্মগেটে ইকবাল নামের এক বাইকার বলেন, বাস, লেগুনা বা সিএনজি চালিত অটোরিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন রাস্তায় বেশি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে। তারা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠানামা করালে ট্রাফিক পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। শুধু বাইকারদের পেছনে লেগে না থেকে সবার আগে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কথা বলেন তিনি।

বর্তমানে ঢাকায় উবার, পাঠাও, ওভাই, স্যাম, চলো, ইজিয়ার, আমার বাইক, সহজ রাইডার্স, বাহন, আমার রাইড, ঢাকা রাইডার্স, ঢাকা মটোসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারের সুবিধা দিচ্ছে।
বিআরটিএর এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০১১ সালে ঢাকায় বাইক নিবন্ধন নেয় ৩৪ হাজার ৭০৪টি, ২০১২ সালে ৩২ হাজার ৮১০টি, ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ৩৩১টি, ২০১৪ সালে ৩২ হাজার ৮৯৪টি, ২০১৫ সালে ৪৬ হাজার ৭৬৪টি ও ২০১৬ সালে ৫৩ হাজার ৭৩৮টি। তবে রাইড শেয়ারিং সেবা চালুর পর ২০১৭ সালেই ঢাকায় বাইক নামে ৭৫ হাজার ২৫১টি। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল রেকর্ড এক লাখ চার হাজারের বেশি। আর চলতি বছর জুন পর্যন্ত ৬ মাসেই ৫০ হাজার ৫০০-র বেশি বাইক নিবন্ধন নিয়ে ঢাকার রাস্তায় চলছে।

এদিকে, ঢাকায় বাইকের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়ে গেছে অনেক। বাংলাদেশ অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ঢাকায় বাইক দুর্ঘটনা ঘটে ৪৮টি। এতে ৫৩ জন নিহত ও ১৯ জন আহত হন। আর ২০১৮ সালে ঢাকায় বাইক দুর্ঘটনা ঘটে ৬৯টি। এতে আগের হতাহত ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। ঢাকায় বাইকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের নীতিমালার দুর্বলতার পাশপাশি কর্মস্থানের সঙ্কটকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, গত সাড়ে ৮ বছরে নিবন্ধন নিয়ে ঢাকায় নামা আট লাখ ৬১ হাজার মোটরযানের মধ্যে চার লাখ ৫৭ হাজারই মোটরসাইকেল। সুনিদিষ্ট আইন না থাকায় রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, অন্যকোন উপায় না পেয়েই হয়তো অনেকে মোটরসাইকেলের দিকে ঝুঁকছে। তবে এটা কোনো সমাধান নয়। একটি শহরে কতগুলো মোটরসাইকেল চলার অনুমতি দেওয়া উচিত- কর্তৃপক্ষের সেটি ভাবার সময় হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজধানীর সড়কগুলোতে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে ঢাকার বাইরে থেকে আসা সব বাইক ঢাকায় নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিআরটিএর সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শ করা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (10)
Mohammad Salahuddin ৩ আগস্ট, ২০১৯, ১:৩০ এএম says : 0
রিক্সা বন্ধ বিভিন্ন পথে এখন তো উনাদের ব্যাবসা রমরমা।
Total Reply(0)
Md Sarowar Alam ৩ আগস্ট, ২০১৯, ১:৩১ এএম says : 0
সঠিক বলেছেন ভাই
Total Reply(0)
Pulak Raha ৩ আগস্ট, ২০১৯, ১:৩১ এএম says : 0
সেই সাথে রিক্সা ও সিএনজি অটোরিকশার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে।
Total Reply(0)
Shahidul Islam ৩ আগস্ট, ২০১৯, ১:৩১ এএম says : 0
সহমত। মোটর সাইকেল ও রিক্সার উৎপাত নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই চলবে। জেব্রাক্রসিংয়ের কিছুটা আগেই গাড়ি থামার একটা সীমা রেখা থাকে তা মানা হচ্ছে না। তবে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আরো উন্নত হলে অনেকাংশেই জ্যাম এড়ানো যেতো।
Total Reply(0)
সোয়েব আহমেদ ৩ আগস্ট, ২০১৯, ১:৩৪ এএম says : 0
মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে আনা এখন সময়ের দাবি। নতুবা যেভাবে মোটরসাইকেলে সংখ্যা বাড়ছে তাতে হাটার পথ পাওয়া যাবে না
Total Reply(0)
মেঘদূত পারভেজ ৩ আগস্ট, ২০১৯, ১:৩৫ এএম says : 0
গুড রিপোর্টিং। কর্তৃপক্ষের বিষয়টি নজরে নেওয়া উচিত। িএভাবে চলতে পারে না। রা্জধানী এমনিই যানবাহনের ভারে বিপর্যস্ত।
Total Reply(0)
Akhlasur Rahman ৩ আগস্ট, ২০১৯, ৯:৩৯ এএম says : 0
ঢাকার জেলার বাইক ব্যতিত অন্য জেলার বাইক ঢাকায় বন্ধ করতে হবে। এছাড়া ঢাকায় যানজট বন্ধ হবে না।
Total Reply(0)
পাবেল ৩ আগস্ট, ২০১৯, ১০:৩৫ এএম says : 0
শুধু বাইকারদের পেছনে লেগে না থেকে সবার আগে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে
Total Reply(0)
মাহফুজ আহমেদ ৩ আগস্ট, ২০১৯, ১০:৩৬ এএম says : 0
ঢাকা জানজট আর বেপরোয়া মোটরসাইকেলের নগরীতে পরিণত হয়েছে।
Total Reply(0)
নোমান ৩ আগস্ট, ২০১৯, ১০:৩৭ এএম says : 0
একটি শহরে কতগুলো মোটরসাইকেল চলার অনুমতি দেওয়া উচিত- কর্তৃপক্ষের সেটি ভাবার সময় হয়েছে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন