তিন চাকার নসিমন-করিমন, মোটরচালিত রিকশা ও ইজিবাইকসহ সব ধরণের অবৈধ যান গুরুত্বপূর্ণ সড়ক মহাসড়কে নিষিদ্ধ থাকলেও সেগুলোরই দাপট চলছেই। আইনের তোয়াক্কা না করে এবং হাইকোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষা করে চালানো হচ্ছে এসব অবৈধ যান। ঈদুল আজহা উপলক্ষে মহাসড়কে কড়াকড়ি থাকায় অনেক ইজিবাইক ও তিন চাকার যান শহর ছেড়ে গিয়েছিল। এমনকি ঢাকা শহরও ইজিবাইক মুক্ত ছিল।
কিন্তু ঈদের ছুটি শেষ না হতেও সেগুলো ফিরতে শুরু করেছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক মহাসড়কে এসব যান চলাচল করায় নানা উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার পরেও দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি থামানো যাচ্ছে না। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ইজিবাইকসহ অন্যান্য বাহন নিষিদ্ধের দাবিতে সারাদেশেই আন্দোলন কর্মসূচি চললেও ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে। প্রশাসন ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, রাজনৈতিক প্রভাব, যথাযথ তদারকির অভাব এবং একশ্রেণির অসাধু চক্র হাইকোর্টের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এসব যানবাহন সচল রেখেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঈদুল আজহার আগে-পরে গত কয়েকমাসে নসিমনসহ তিনি চাকার নিষিদ্ধ যানবাহনের দুর্ঘটনায় অনেকের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া আরও অনেকে গুরুতর আহত হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গতকাল শুক্রবার তিন চাকার অটোরিকশা দুর্ঘটনায় চট্টগ্রামের বোয়ালখালী ও টাঙ্গাইলে তিনজন নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে বোয়ালখালীতে টেম্পু ও অটোরিকশার সংঘর্ষে লোকমান (২৬) এবং টাঙ্গাইলে দুটি অটোরিকশার সংঘর্ষে মন্নান ও কুদ্দুস নামে দু’জন নিহত হয়। এছাড়া ১৫ আগস্ট ময়মনসিংহের ফুলপুরে যাত্রীবাহী বাস ও সিএনজি চালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে শিশু জায়েদ (৬) ও সিরাজুল ইসলাম (৪৫) নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও পাঁচজন। একইদিন কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে ট্রাকচাপায় সিএনজি অটোরিকশার তিন যাত্রী নিহত ও চারজন আহত হন।
এছাড়া গত ১৩ আগস্ট গাইবান্ধায় মাইক্রোবাসের সঙ্গে সিএনজির সংঘর্ষে দুইজন নিহত, নরসিংদীর শিবপুরে যাত্রীবাহী বাস ও সিএনজির মুখোমুখি সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীসহ দু’জন নিহত হয়। ১১ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে চট্টগ্রামগামী একটি লবণের ট্রাক ও ভুলতাগামী একটি যাত্রীবাহী সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে এক পুলিশ সদস্যসহ দুইজন নিহত হয়েছেন। ৮ আগস্ট মোটরসাইকেল ও নসিমনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ভোলার তজুমদ্দিন থানার এসআই আবদুল্লাহ আল আজাদ গুরুতর আহত হন। প্রথমে তাকে ভোলা সদর হাসপাতাল ও পরে র্যাবের হেলিকপ্টারে করে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। ৬ আগস্ট বেলা পৌনে ১০টার দিকে ঈশ্বরদী উপজেলার ঈশ্বরদী-পাবনা মহাসড়কে গরু বোঝায় ইঞ্জিনচালিত নসিমনের চাপায় ঋশিতা খাতুন (৬) নামে এক শিশু শিক্ষার্থী প্রাণ হারায়। বাড়ি থেকে বের হয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। ৩০ জুলাই ঈশ্বরদীর উপজেলার ঈশ্বরদী-কুষ্টিয়া সড়কের জয়নগর এলাকায় নসিমন দুর্ঘটনা ঘটে ৮ গরু ব্যবসায়ী গুরুতর আহত হয়। তারা হলেন- উজ্জ্বল হোসেন, আবু বক্কর, আলী আকবর, মনিরুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম, রাশেদুল, শহীদুল ইসলাম ও হাবলু। ঈশ্বরদীর অরোনকোলা গরুর হাট হতে অবিক্রিত ৪টি গরু নসিমনে করে ফেরত নিয়ে মিরপুর যাওয়ার সময় নসিমনের পেছনের চাকার এক্সেল ভেঙ্গে এই দুর্ঘটনা ঘটে। একই মাসের ২৪ জুলাই রাত ৮টার দিকে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা আঞ্চলিক মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও নসিমনের সংঘর্ষে কলেজছাত্র মোটরসাইকেল আরোহী মুন্না হক (১৭) নিহত হয়। এ ঘটনায় আরও দু’জন আহত হয়েছেন।
এদিকে, ২৩ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে পিকআপ ভ্যান ও নসিমনের মুখোমুখি সংঘর্ষে নসিমনের চালক ও দুই পিকআপ যাত্রীসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আরও পাঁচ যাত্রী আহত হয়। নিহতরা হলেন- নসিমনের চালক রাব্বি মিয়া (২২) এবং পিকআপ ভ্যানের যাত্রী গার্মেন্ট কর্মী জাহাঙ্গীর হোসেন (৩৬) ও শাহাবুদ্দিন মিয়া (৩৩)। এছাড়া গত ২৩ এপ্রিল দিনাজপুর সদর উপজেলায় একটি ইজিবাইক ও যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আরও চারজন আহত হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সারাদেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ১২ লাখেরও বেশি ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। নিষিদ্ধ সত্তে¡ও সড়ক-মহাসড়ক ধরে এগুলো ছুটে চলছে। এর কারণে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেই চলছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে গত বছরের দুর্ঘটনার প্রায় ২৬ শতাংশ ঘটেছে নছিমন, ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে।
ভুক্তভোগিদের ভাষ্য, স্থানীয় প্রশাসন ও হাইওয়ে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব এবং কার্যকর তদারকির অভাবে মহাসড়কে থ্রি-হুইলার বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা যাচ্ছে না। সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জোরালো কোনো পদক্ষেপও নেই। এতে করে ঝুঁকি এবং দুর্ঘটনা দুটোই বাড়ছে।
পুলিশের চোখের সামনে দিয়ে চললেও এসব যানবাহন চলাচলে পুলিশ বাধা দেয় না। পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে হাত করে অসাধু সিন্ডিকেট এসব যান সচল রেখেছে বলে ভুক্তভোগীগের অভিযোগ। এছাড়া ঝুঁকি ও দুর্ঘটনা কমানোর জন্যই ২০১৫ সালের ১ আগস্ট দেশের ২২টি মহাসড়কে সব ধরণের থ্রি-হুইলার চলাচল নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। যদিও সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধীতাসহ এসব যানবাহনের বৈধতা দেয়ায় তখন থেকে নানা পাঁয়তারা করে আসছে থ্রি-হুইলার সংশ্লিষ্ট পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো।
সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে দেশের ২২টি মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল নিষিদ্ধ করে সরকার। এর কিছুদিনের মধ্যেই তা অনেকটাই কার্যকর করা হয়। তিন-চার মাস যেতে না যেতে আবার সেগুলো চালু হয়। বাস-ট্রাকসহ বড় পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও মহাসড়কে থ্রি-হুইলার বন্ধের জন্য আলটিমেটাম দেয়া হয়। এছাড়া হাইকোর্টও এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
আদালত সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ১৫ নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে ‘মহাসড়কে দুর্ঘটনার কারণ অবৈধ যানবাহন নছিমন, করিমন ভটভটি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়। পরে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়। সেই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট একই বছরের ২ অক্টোবর এসব অনিবন্ধিত যানবহান চলাচল বন্ধে অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি রুল জারি করেছিলেন। পরবর্তীতে এই রুলকে যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী ইজারুল হক আকন্দের হাইকোর্ট বেঞ্চ সারাদেশের মহাসড়কগুলোতে থ্রি-হুইলার চলাচল বন্ধে পদক্ষেপ নিতে সরকারকে নির্দেশ দেন। সেই রায়ে কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল এবং অগ্রগতির তথ্য প্রতি ছয় মাস পরপর একটা প্রতিবেদনের মাধ্যমে আদালতকে জানাতে বলা হয়েছিল। যদিও সেসব আর মানা হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশার বৈধতা দিলে সড়কে দুর্ঘটনার হার অনেক বেড়ে যাবে। এছাড়া যানবাহনের গতি কমে গিয়ে যানজট ও ভোগান্তি বাড়বে। অটোরিকশার চালকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সরকারদলীয় এক শ্রেণির নেতা এবং পরিবহন সংশ্লিষ্টরা দলীয় প্রভাব খাটিয়ে এসব যান চলাচলের ব্যবস্থা করে দেয়।
সায়েদাবাদে বাস মালিক সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বলেন, মহাসড়কের দুর্ঘটনার প্রধান কারণ এসব অবৈধ যানবাহন। এসবের কারণে যানজট হয়, বাস স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। সময় নষ্ট হয় বলে খরচও বাড়ে। তাই আমরা চাই এগুলো বন্ধ হোক। এজন্য সরকারের সাথে মালিক সমিতির বহুবার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই এসব বন্ধ হচ্ছে না।
ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো: হানিফ খোকন বলেন, এক শ্রেণির শ্রমিক সংগঠন টোকেন বাণিজ্যের মাধ্যমে সড়ক-মহাসড়কগুলোতে এসব নিষিদ্ধ যান সচল রেখেছে। প্রতিটি গাড়ির বিপরীতে এক হাজার টাকা দিয়ে টোকেন নিতে হয়। তার মতে, সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতায় এসব নিষিদ্ধ যান মহাসড়কে চলতে পারছে। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আলাদা লেনের কথা বলা হলেও সেটি এখনো চালু হয়নি। যদিও কিছুদিন আগে একনেকে আলাদা লেন চালুর জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তিনি অনতিবিলম্বে জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে এবং বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আলাদা লেন চালু করে এসব যান চলাচলের ব্যবস্থার দাবি জানান।
এ প্রসঙ্গে হাইওয়ে পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচলের বিরুদ্ধে সব সময় অভিযান চালানো হয়। তবে আগের তুলনায় এখন অনেক কম দেখা যায়। ধীরে ধীরে পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব। এ বিষয়ে
পুলিশের পক্ষ থেকে প্রশাসন ও পরিবহন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সাথে সমন্বয় করে কাজ করা হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন